অহংকার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমি তখন রাশিয়ায় ছিলাম। হেলিকপ্টার চালাতাম।

যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, কতবার মুড়ির টিনের বাসে চেপে গুলিস্তান-সদরঘাট গিয়েছি, তার হিসাব নেই।

যা হোক, আমার হেলিকপ্টারটি মুড়ির টিনের বাসের চেয়ে বেশ বড় ছিল। ২৪ জন প্যাসেঞ্জার নিতে পারতাম (এমআই-৮ হেলিকপ্টার)।

পাইলটের ইউনিফর্ম পরে যখন ঘুরে বেড়াতাম, সবাই তাকিয়ে দেখত। বিশেষ করে মেয়েরা। গর্বে বুক ফুলে উঠত। নাক উঁচু হয়ে যেত।

আমার পাশের বাড়িতে থাকতেন গালিনা নামের এক রাশিয়ান ভদ্রমহিলা। ষাটের ওপরে বয়স। বিধবা। একা থাকতেন। ভদ্রমহিলা খুব যে একটা সুন্দরী ছিলেন, তাও না।

ভদ্রমহিলা কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন আমার সঙ্গে আলাপ করতে। আমি পাত্তা দিইনি।

আমি তো পাইলট, তাই না!

কাজের শেষে বাসায় ফিরে দেখতাম, তিনি দুয়ারে দাঁড়িয়ে দূর থেকে একটি গোলাকার ফলকের দিকে ছুরি নিক্ষেপ করছেন। এই ধরনের খেলা আমি শুধু সার্কাসে দেখেছি। একজন সুন্দরী যুবতী ঘুরন্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখ বন্ধ করে একজন তাঁর দিকে ছুরি ছোড়েন।

প্রতিবারই দর্শকেরা ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। ছুরি কিন্তু একটাও গায়ে লাগে না।

যা হোক, মনে মনে ভাবি আমার প্রতিবেশিনী কি এই বৃদ্ধ বয়সে সার্কাসে নামবেন? মানুষের কত ধরনের শখই না থাকে।

আমার চেনা এক পাকিস্তানি পাইলট একটি ক্যালকুলেটর কিনেছিলেন। সেটা কথা বলে। ৪ দিয়ে ৪ পূরণ করলে সেই ক্যালকুলেটর কথা বলে উঠত ৪ বাই ৪ সমান ১৬।

আমি জানি, অনেক মানুষের মাথায় স্ক্রু থাকে না। কিন্তু এ রকম মাথা খারাপ আমি জীবনে দেখিনি। যিনি কিনা হিসাব করতে কথা বলা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করেন।

তো এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ আমার প্রতিবেশিনী ভদ্রমহিলা একদিন নক করলেন আমার দরজায়।

দরজা খুলতেই বললেন, আমি কালকে কয়েক দিনের জন্য ফ্রান্সে যাচ্ছি। আপনি দয়া করে আমার বাড়িটির দিকে একটু নজর রাখবেন? আমি হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে বলে দরজা বন্ধ করলাম।

ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেসও করলাম না ফ্রান্সের কোথায় যাচ্ছেন। কত দিনের জন্য যাচ্ছেন। আমি তো পাইলট, আকাশে উড়ি। এ ধরনের সাধারণ লোকের সঙ্গে আমার কথা বলার কি আর সময় আছে?

কয়েক দিন পর দেখলাম, ভদ্রমহিলা একটি বিরাট বড় গাড়িতে ফিরে এলেন। মনে মনে বললাম, আমার বয়েই গেছে জানতে তিনি ফ্রান্সের কোন সার্কাসে গিয়েছিলেন।

এর মধ্যে একদিন প্রচুর বরফ–বৃষ্টির মধ্যে আমাকে ফ্লাই করতে হয়েছিল। অনেক কষ্টে যখন ল্যান্ড করতে গেলাম, হেলিকপ্টারের পাখা টাচ করল ইলেকট্রিক তারে। বেকায়দায় ল্যান্ড করতে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম।

যা হোক, মাথা গেলে কী হবে, হেলিকপ্টারকে তো বাঁচালাম! মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় বসে ইন্টারনেটে ঢুঁ মারছি।

হঠাৎ একটি ছবি দেখে চোখগুলো থেমে গেল। আমার প্রতিবেশিনীর ছবি। World championship in knife throwing–এ তৃতীয় আর European championship–এ প্রথম।

ভুল দেখছি না তো?

যে নারীকে আমি পাত্তাই দিতাম না, তিনি পৃথিবীতে সেরা তিনজনের মধ্যে একজন। সেই মুহূর্তে কড়া নেড়ে উঠল। কে এল এই অসময়ে? কে আবার? আমার প্রতিবেশিনী।

আমাকে দেখে বলে উঠলেন, আপনাকে কয়েক দিন ধরে দেখি না। অফিসে যান না। আপনি ভালো আছেন তো?

আমি কিছু না বলে তাঁর ছবিটি এগিয়ে দিলাম। বললাম, এটা আপনি? তিনি লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, হ্যাঁ।

আপনি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন, ওয়ার্ল্ড কমপিটিশনে ব্রোঞ্জ মেডেলের অধিকারিণী, অথচ আমাকে একবারও বলেননি।

ভদ্রমহিলা আমার পাইলটীয় উন্নাসিকতাকে ভেঙে চুরমার করে বললেন, এতে বলার কী আছে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ভারতেও ‘চন্দ্র’ নামের এক বৃদ্ধা শুটার রয়েছেন, যিনি ৩০ বারের ওপরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। তাই পাঠক অহংকার করবেন না। অহংকার পতনের মূল।