আমার হিরো মেজ আব্বা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি সিডনিতে থাকি মিন্টো এলাকায়। সপ্তাহের পাঁচ দিন আমি মিন্টো স্টেশনে ট্রেন ধরে কর্মস্থলে যাই। মিন্টো স্টেশনে এক শিখ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়। ট্রেন আসার আগ পর্যন্ত আমরা সংসার, আবহাওয়া, সপ্তাহান্তের পরিকল্পনা নিয়ে টুকিটাকি আলাপ করি।

কয়েক দিন আগে তাঁর সঙ্গে তেমনই কথা হচ্ছিল। আমি তাঁকে বললাম, শুক্রবার এলেই আমার কেন জানি মজা লাগে। যদিও কাল ও পরশু (শনি ও রোববার) অফিসের চেয়েও ব্যস্ত থাকতে হবে।

আমার কথা শুনে তিনি বললেন, একদম ঠিক তাই।

আমি তাঁকে আরও বললাম, ছোটবেলায় বৃহস্পতিবার এলেই আমরা একটা ছড়া বলতাম। বৃহস্পতিবার অর্ধেক ক্লাস হতো আর শুক্রবার বন্ধ। শনিবার আবার ক্লাস শুরু হতো তাই আমরা বলতাম—‘আজ হাফ, কাল মাফ, পরশু দিন বাপরে বাপ’।

এই ছড়া শুনে শিখ ভদ্রলোকের হাসি আর থামতেই চায় না। আমি এই ছড়া পেয়েছিলাম আমার মেজ চাচার কাছ থেকে। যাঁকে আমরা মেজ আব্বা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রথম মাধ্যমিক পাস দেওয়া মানুষ।

চর এলাকা থেকে মাধ্যমিক পাস করাটা কতটা কঠিন, পরবর্তী সময়ে আমি বুঝতে পেরেছি। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর ব্যবহৃত জ্যামিতি বক্স থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু পেয়েছিলাম। আর তাঁর সবকিছুতেই ছিল একটা আভিজাত্যের ছাপ। তাঁকেই প্রথম দেখেছিলাম বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় কীভাবে কাপড় ইস্ত্রি করতে হয়। উঠানে কাপড় বিছিয়ে তার ওপর জামাকাপড় রেখে একটা টিনের প্লেটের মধ্যে মাটির চুলার ছাই নিয়ে সেটা দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করতেন।

তিনি তখনো ডাক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করেননি। তবু তাঁর কাছে সবাই আসত বিভিন্ন রকমের সমস্যা নিয়ে। একবার পিয়ারুল দাদা চিৎকার করতে করতে এলেন। কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, তাঁর দাঁতে প্রচণ্ড রকমের ব্যথা। মেজ আব্বা তাঁর টুথপেস্ট বের করে সেখান থেকে একদলা টুথপেস্ট ওনার দাঁতের গোড়ায় লাগিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা ভালো হয়ে গেল।

পিয়ারুল দাদা খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন। জনে জনে সবাইকে সেই কথা বলে বেড়াতে শুরু করলেন। আমি দাঁতের ব্যথা নিয়ে মোশাররফের কাছে গেলাম। ও কী যেন একটা লাগিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যথা গায়েব। চরের লোকজন তখনো জানত না টুথপেস্টের কথা।

আমাদের বাড়ির কুকুরের সুখ্যাতি ছিল সারা পাড়াজুড়ে। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাদের বাড়িতে একটা ফড়িং পর্যন্ত ঢুকতে পারত না। তবে সে কিছু মানুষকে দেখলেই তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিত। পৃথিবীতে কুকুর ও শিশুরা সবার আগে মানুষ চিনতে পারে।

পিয়ারুল দাদার ছোট ভাই রবিউল ছিলেন একজন খারাপ মানুষ। নানা ধরনের অপকর্ম করতেন। রবিউল কোনো কারণে আমাদের বাড়িতে এলে আমাদের কুকুরটা যেন পাগল হয়ে যেত। একবার রবিউল কুকুরটার মাথায় ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করলে গভীর ক্ষত হয়। পরে সেখানে ঘা হয়। মাথায় ঘা। কুকুরটার জিব সেখানে পৌঁছে না।

মেজ আব্বা বলতেন, কুকুর যদি ঘা তার জিব দিয়ে চাটতে পারে, সেই ঘা দ্রুত শুকিয়ে যায়। না হলে সেখানে পোকা হয় এবং একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তাই তিনি সময়-সময় কুকুরটার মাথায় কেরোসিন তেল দিতেন। কিন্তু কুকুর সেটা দিতে দিত না। হয়তোবা জ্বালাপোড়া করত সেই কারণে। তিনি বিভিন্ন কৌশলে কেরোসিনের তেল দিয়ে সেই যাত্রায় কুকুরটাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আমাদের গ্রামে তো বটেই বেশির ভাগ গ্রামেই বিদ্যুৎ ছিল না। আমাদের গ্রামে কারও টিভিও ছিল না। তখন ভিসিআরের বেশ প্রচলন ছিল। ভিসিআরের মাধ্যমে যত ইচ্ছা ছবি দেখা যেত। বিদ্যুৎহীন গ্রামের লোকজন মাঝেমধ্যে এক-দুই দিনের জন্য টেলিভিশন, ভিসিআর ও ডায়নামা ভাড়া নিয়ে এসে ছবি দেখতেন। ডায়নামার বিদ্যুতে ভিসিআর ও টেলিভিশন চলত।

আমার মেজ আব্বাও একদিন ডায়নামাসহ ভিসিআর, টেলিভিশন ভাড়ায় নিয়ে আসেন। তিনি পিয়ারুল দাদাদের বাড়ির উঠানে ছবি দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। একটা ঘরের বারান্দায় টিভি আর ভিসিআর রাখা হয়েছে। আর ডায়নামা বাইরে একটু দূরে। কারণ, ডায়নামা বেশ শব্দ করে চলত। তাই সেটা দূরে রাখা হতো।

সেই প্রথম আমার টিভি ও ভিসিআরের সঙ্গে পরিচয় হলো। ছোটদের দেখার অনুমতি ছিল না। কিন্তু আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল। মেজ আব্বা তাঁর তিন ব্যাটারির টর্চ লাইটটা বাড়িতে ফেলে এসেছিলেন। আমি বাড়ি থেকে টর্চ লাইটটা নিয়ে গিয়েছিলাম।

সারা উঠান মানুষে গিজগিজ করছে। মেয়েরা বসেছে ঘরের বারান্দায়। আর ছেলেরা উঠানে। আমি মেজ আব্বার কাছে টর্চটা পৌঁছে দিয়ে দাদির কোলের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। সেই প্রথম আমার সিনেমা দেখা। তখন ভিসিআরের মাধ্যমে টেলিভিশনে চলছিল আক্রোশ সিনেমাটা। আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো ভিক্টর ব্যানার্জির সঙ্গে দেবশ্রীকে দেখতে পাই।

আরও একটা ব্যাপার সেই ছোট বয়সেই আমার মনে রেখাপাত করেছিল। সেটা হলো আউট বই পড়া। তখন পর্যন্ত প্রাথমিকের বইয়ের বাইরে মায়েদের নতুন শাড়ির ভাঁজে থাকা পুরোনো পেপারই ছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের একমাত্র যোগসূত্র। একবার মেজ আব্বা কোথা থেকে জানি অনেকগুলো চটি বই নিয়ে এলেন। ছোট আকৃতির বই। ভেতরে বড় বড় হরফের লেখা। তাই আমাদের পড়তে অসুবিধা হতো না।

মেজ আব্বার নিষেধ ছিল আমরা যেন ওই সব বই না পড়ি। কিন্তু আমরা লুকিয়ে সেই বইগুলোর সবই পড়ে ফেলেছিলাম। সেই বইগুলোর নাম এখনো আমার মনে আছে। ছোটদের বাইবেল, ইঞ্জিল। এমন আরও বেশ কয়েকটা কিতাব ছিল সেখানে। তখন সেগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই না বুঝলেও নতুন কিছু পড়ার আনন্দে অনেক খুশি হয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম তিনি মনে হয় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও বাড়িতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন।

আমাদের এই মেজ চাচা একবার হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। প্রায় পাঁচ বছর নিখোঁজ ছিলেন। তখন এখনকার মতো ফোন ছিল না। মানুষের মাধ্যমে খবর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হতো। একজন একটা তথ্য জেনে অন্যজনকে গিয়ে বলে আসতেন। তারপর তিনি আবার আরেকজনকে বলতেন। এভাবেই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খবর পাঠানো হতো। এর বাইরে ছিল ডাক যোগাযোগ।

যা হোক, নানাভাবে খবরাখবর নিয়েও তাঁর কোনো হদিস পাওয়া গেল না। দাদি সব রকমভাবে তাঁর খোঁজ নিলেন। কিন্তু সবই বিফলে গেল। মেজ আব্বার খবর জানার জন্য দাদি বিভিন্নজনের কাছে যেতেন। এ সময় আমি তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম। তখন আমি বুঝেছিলাম সন্তান হারানোর বেদনা কতটা গভীর।

অবশেষে মেজ আব্বা পাঁচ বছর পর এক কাকডাকা ভোরে ফিরে এলেন ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে। দাদি তাঁকে পারলে কোলের মধ্যে নিয়ে বসান। দাদি কাঁদছেন আর চিৎকার করে বলছেন, তোমরা সবাই এসে দেখে যাও আমার মোশাররফ ফিরে এসেছে।

মেজ আব্বার এই বৈরাগ্য বোধ হয় আমাদের পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কারণ, আমার ছোট ভাই ইসমাইলও একবার এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে এক সপ্তাহের মাথায় ফিরে এসেছিল। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি ইশ্‌ আমিও যদি ওদের মতো কিছুদিনের জন্য বাস্তব জীবন থেকে হাওয়া হয়ে যেতে পারতাম।

মেজ আব্বার চরিত্রের মজার ও দুষ্টুমির দিকটা আমাকে সব সময়ই আকর্ষণ করে। একবার এক ভদ্রমহিলা দাদির কাছে মেজ আব্বার বিরুদ্ধে একটা মারাত্মক অপরাধের বিচার নিয়ে হাজির হলেন। তিনি নাকি তাঁর ছেলের নাকে গুলি করেছেন। ভদ্রমহিলা দাদির কাছে বলেই চলেছেন, ও বা তোর মেজ ছাওয়াল আমার ছেলের নাকে গুলি করেছে। গুলিটা যদি নাকে না লেগে চোখেই লাগত তাহলে তো আমার ছেলেটা সারা জীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যেত।

গুলির ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেক ভয়ংকর ব্যাপার। তাই আমরা খুবই শঙ্কিত হয়ে গেলাম। দাদি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন তাঁর ছেলে বাড়ি ফিরলেই বিচার বসাবেন। ভদ্রমহিলা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেলেন। মেজ আব্বা বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে দাদি তাঁকে ধরলেন।

ঘটনা শুনে মেজ আব্বার হাসি আর থামতেই চায় না। তিনি বললেন, ঘটনা কী ঘটেছে বলি। তোমরা শোনো তারপর বিচার করো। তিনি আর সেই ভদ্রমহিলার ছেলে কোথাও একসঙ্গে বসে ছিলেন। হঠাৎ মেজ আব্বার বায়ু বেগ চাপে। তখন তিনি সেটা চেপে রাখতে না পেরে বায়ুটা ছেড়েই দেন। যেহেতু ছেড়েই দিয়েছেন তখন তিনি আর রাখঢাক না করে একটা ছড়া বলেছিলেন। যে জন্য ভদ্রমহিলা বিচার নিয়ে এসেছিলেন।

ছড়াটা হচ্ছে: ‘হাওয়ার গুলি, চামড়ার বন্দুক, মারলাম ফাঁকে, লাগল নাকে।’

তখন আমরা বুঝতে পারলাম আসলে এখানে গুলি করা মানে বায়ুকে বোঝানো হয়েছে। এরপর আমরা বহুদিন এই ছড়া বলতাম আর হাসাহাসি করতাম। এমনকি এখনো আমি কোনো কারণে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বায়ু ছেড়ে দিলেই এই ছড়াটার কথা মনে হয় আর নিজের অজান্তেই হেসে উঠি।

এটা তো গেল মেজ আব্বার মজার দিক। এবার আসি দুষ্টুমির বর্ণনাতে। নদীভাঙনের পর কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে দাদি জমি কিনে আমাদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি করেন। সেখানে আমাদের আর মেজো আব্বাকে পাঠিয়ে দেন শহরে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু আমার যত দূর মনে পড়ে তিনি আর পড়াশোনা না করে পল্লিচিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিয়ে আবারও গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। মেজ আব্বা চাইলেই আয়েশি জীবন বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে আবার গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন।

ছোটবেলায় বেশির ভাগেরই একজন হিরো থাকে। সেই হিরোকে তারা ফলো করে। সেই মানুষটা থাকেন অনেকটা সূর্যের মতো। তার আলোয় বাকিরা আলোকিত হয়। মেজ আব্বা ছিলেন আমার জন্য তেমনই একজন। বাস্তবতার কশাঘাতে জর্জরিত জীবন আজ আমাকে তাঁর থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসে ফেলেছে। কিন্তু আমার অবচেতন মন ঠিকই তাঁকে মনে রেখেছে। কয়েক দিন ধরে তাঁর কথা বারবার মনে পড়ছে। ভালো থাকুন আমাদের বাস্তব জীবনের সূর্যরা আর আলো দিয়ে যান আমাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।