ভালোবাসার দাবি

লেখিকা
লেখিকা

সুরাইয়ার সন্তান হবে। নিতান্তই একটা ভালো খবর। কিন্তু বিষয়টা সুরভি কিছুতেই মানতে পারছে না। ঘটনা শোনার পর থেকেই সুরভি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছে। ডাক্তার তাকে বারবার বলে দিয়েছেন একদম দুশ্চিন্তা না করতে। সুরভির শারীরিক অবস্থায় প্যানিক অ্যাটাক হলে আর রক্ষা নেই।

সুরভি নিজেও অন্তঃসত্ত্বা। তার অনেক সাধের বাচ্চা। কত দেশ-বিদেশের চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে পাওয়া এই অমূল্য রতন। যদিও অমূল্য রতনের দুনিয়াতে আসতে সময় লাগবে আরও আট মাসের মতো। এই প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন সুরভির যে কীভাবে যাচ্ছে, তা শুধু সে নিজেই জানে। ডাক্তার তাকে বলেছেন, তার শারীরিক অবস্থা বেশ জটিল। সম্পূর্ণ বিশ্রাম তার একমাত্র ওষুধ।

সুরাইয়া তার দেখাশোনা করে। সুরভির বিয়ের পরদিন থেকেই সুরাইয়া এই বাসায় কাজ করে। সুরাইয়া হলো সুরভির মায়ের কাজের বুয়ার মেয়ে। সুরভির মা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরাইয়াকেও মেয়ের কাছে বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন কেবল এই ভেবে, মেয়ের কোনো প্রকার কষ্ট না হয়।

সুরভির শ্বশুরবাড়িতে চাপ নেই কোনো। শ্বশুর-শাশুড়ি খুব আদর করেন তাকে। কিন্তু বিগত দুই বছর ধরে তাঁরা আমেরিকায়। বড় ছেলের কাছে। আরও তিন বছর নাকি থাকতে হবে। এরপর সুরভির স্বামী শামীমও আবেদন করতে পারবে। পুরো পরিবারকে আমেরিকায় অভিবাসী করানোর জন্য সুরভির বড় ভাশুর শাহিনের অবদান ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।

বিষয়টাতে সুরভির আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু সুরভি যেদিন থেকে জানল শামীমেরও আমেরিকা যাওয়ার ইচ্ছা, তখন থেকেই তার মনে ভিন্ন এক চিন্তা—সুরাইয়াকে সঙ্গে নেবে কীভাবে? সুরাইয়া সারা দিন সুরভির ফুটফরমাশ খেটে রাতে বাড়ি চলে যায়। সুরাইয়ার মতো ভালো কাজের মেয়ে হয় না। সুরভির প্রতিটা পছন্দ–অপছন্দ মাথায় রেখে সুরাইয়া কাজ করে। দশ বছর ধরে সুরাইয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সুরভির অভ্যাস। তবে সুরভি নিশ্চিত, সুরাইয়া তার সঙ্গে আমেরিকা কখনোই যেতে চাইবে না বা পারবে না। তারও স্বামী–সন্তান আছে। কিন্তু সুরাইয়াকে ছাড়া তো সুরভির দিনলিপি সম্ভব নয়।

দশ বছরের সংসারজীবনে সে এত চিন্তিত কখনো ছিল না। শ্বশুর-শাশুড়ি আমেরিকা পাড়ি জমানোর পর সে আসল পরিস্থিতি বুঝল। এমনিতেই সন্তানহীন থাকায় ব্যক্তিগতভাবে সে ভীষণ হতাশ আর দুঃখী ছিল। তার মনের অবস্থা শ্বশুরবাড়ির সবাই বুঝত। এ রকম শ্বশুরবাড়ি পাওয়াও যেন ভাগ্য। কেউ বিরক্ত করত না তাকে। কোনো চাপ প্রয়োগ করত না। শ্বশুর-শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর যেন দশ হাত বাড়িয়ে সুরভিকে আগলে রাখল সুরাইয়া। নিজের স্বামী–সন্তানের কথা না ভেবে সুরাইয়া সুরভির দেখভাল করে গিয়েছে।

আল্লাহর অশেষ রহমতে দুই সপ্তাহ আগে সুরভি সুখবরটা সম্পর্কে নিশ্চিত হলো। বাবা-মা বেঁচে না থাকায় একমাত্র মেয়ে সুরভির বাপের বাড়ি বলতে আর কিছু ছিল না। শামীমকে বলার পর সে বলল আপাতত কাউকে না বলতে। বেশি উত্তেজিত হলে আবার খারাপ কিছুও হতে পারে। কয়েকটি মাস যাক। শামীম আর সুরাইয়া ছাড়া তার সন্তান হওয়ার বিষয়টি কাউকে জানানো হয়নি।

বলা বাহুল্য, খবরটা শুনে সুরাইয়ার আনন্দ ছিল দেখার মতো। সে একপ্রকার রাতের বেলাও বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিল। সারাক্ষণ সুরভির পাশে। শামীমও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল। নইলে এ অবস্থায় আমেরিকা থেকে বাবা-মা এলে আর আমেরিকা যেতে পারতেন না। বড় ভাইয়ার সব কষ্ট বিফলে যেত।

চিত্রকর্ম: কাইয়ুম চৌধুরী
চিত্রকর্ম: কাইয়ুম চৌধুরী

দিনগুলো সুন্দর কেটে যাচ্ছিল। সুরভির মেজাজটা গরম হলো সুরাইয়ার সন্তান হওয়ার কথাটা শুনে।

সে বলেই বসল, দুই–দুইটা না বাচ্চা আছে তোমার বুবু! আবার কেন? জানো তো আমার কী অবস্থা। তুমি অসুস্থ হলে আমাকে দেখবে কে?

সুরাইয়া এতটুকু বিচলিত না হয়ে সুরভিকে আশ্বাস দিতে থাকল। ভরসার কথা বলল।

কিন্তু সুরভির মন মানল না। সে বলল, ফেলে দাও ওটা। আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব তোমাকে। তোমার তো আর আমার মতো এত জটিল সমস্যা নেই। আমার অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। আমার কোল আলো করতে দাও বুবু।

সুরাইয়ার যেন মাথায় হাত! সে বলল, সুরভি আপা এইটা কী কন? এত বড় পাপ আমি করার পারুম না। আমি আপনেরে কথা দিতাসি, আপনার কাজে আর শইলে কোনো ক্ষতি হইবার দিমু না। আপনের বাবু হওনের আগ পর্যন্ত আমি আমার ঘরেও যামু না। আপনে আমারে বিশ্বাস করেন।

সুরভির মন গলল না। সে বলতে থাকল, বুবু তুমি জানো না, এখন তুমি হয়তো আমার দেখভাল করতে পারবে। কিন্তু আর কদিন পর তোমাকেই দেখার জন্য লোক রাখা লাগবে। আমার কী হবে তখন? আমার কোনো ভাইবোন নেই। বাবা-মা কবে মরে গেলেন। শ্বশুরবাড়ির সবাই দেশের বাইরে। সব বান্ধবীর বাচ্চারা স্কুলে যায়, সবাই ব্যস্ত। আমার দেখাশোনা করার কেউ নেই। তোমায় আমি অনেক টাকা দেব। তুমি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেল।

সুরাইয়া গত দশ বছরে যা করেনি, আজ তা করল। নিঃশব্দে সুরভির সামনে থেকে চলে গেল।

রাতে শামীম ফিরলে সুরভি সব খুলে বলল। শামীমও ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। স্বামী-স্ত্রী আলাপ করে বুঝল সুরাইয়ার বাচ্চা হয়তো সুরভির বাচ্চার এক মাস বা পনেরো দিন আগে পৃথিবীতে আসবে। শামীম সুরভিকে আশ্বাস দিল, সুরাইয়া কখনোই তার সঙ্গে বিট্রে করবে না। টাইমিংটা এমন যে সুরাইয়া বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরও সুরভিকে সময় দিতে পারবে। সুরভির বাচ্চা হওয়ার ওই সন্ধিক্ষণে সুরাইয়া পাশে থাকতে পারবে। এসব বুঝিয়ে শামীম ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু সারাটা রাত সুরভির ঘুম হলো না। সেদিনের পর থেকেই সুরভির দুশ্চিন্তা ভয়ানক বেড়ে গেল। স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা গেল। সুরভির প্রতি সুরাইয়ার সেবা দেখলে আদিম যুগের দাসীরাও ভয় পেত। কিন্তু তাতেও সুরভির মন ভরে না। তার চোখ থাকে সুরাইয়ার পেটের দিকে। খুব বেড়ে যাচ্ছে সুরাইয়ার পেট। এই বড় পেট নিয়েও সে অনবরত সকাল থেকে রাত অবধি সেবা করেই যাচ্ছে। সুরভি বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের পেটের ওপর হাত বোলায়। তার পেট সুরাইয়ার মতো বাড়ে না কেন?

সুরাইয়া এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সুরভির সাত মাস চলছে। যেকোনো একজনের এখন-তখন হয়ে যেতে পারে। শামীমও এখন ছুটি নিয়ে বাসায় বেশি থাকে। আমেরিকায়ও জানানো হয়েছে। সব জায়গায় আনন্দ আর আনন্দ। সুরাইয়া নিজের অনাগত বাচ্চার কথা ভুলে সুরভি আপার বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করে, কোরআন শরিফ পাঠ করে, আরবি নাম খুঁজে বেড়ায়। তার মনেও আনন্দের সীমা নেই।

দুঃখী কেবল সুরভি। তার মন বলছে সুরাইয়ার যেদিন ব্যথা উঠবে, ওই দিনই সুরভি মারা যাবে। তার মৃত্যুর সময় সুরাইয়া পাশেও থাকতে পারবে না। একটা সন্তানের চাহিদা মানুষের মনে কেমন আলোড়নের সৃষ্টি করে, তা কল্পনা করা সত্যিই দুষ্কর। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়; বিষয়টা যেন সুরভির ক্ষেত্রে খাপে খাপে মিলে যায়। সন্তানের অভাব সুরভিকে করেছে হিংসুক ও লোভী। ডাক্তার তাকে বলেছেন, তার সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় যেকোনো খারাপ কিছুই হতে পারে। সুরভিকে প্রস্তুত থাকতে হবে সবকিছুর জন্য। সুরভি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছে না। সুরাইয়ার উঁচু পেটের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, মানুষের একাধিক আছে আর তার একটাও নেই।

দিন গড়িয়ে যায়। সবকিছু পরিকল্পনামতো হয় না। হঠাৎ সুরভির অবস্থার অবনতি হয়। ডাক্তার বলেন, অপারেশন করতে হবে জলদি। বেবি প্রিম্যাচিউরড। কিন্তু কিছুই করার নেই। অন্যদিকে সুরাইয়া তার আট মাসের পেট নিয়ে হাসপাতালে দিব্যি সুরভির সেবা করে যাচ্ছে।

অপারেশনে সুরভিকে বাঁচানো গেলেও তার অনাগত শিশুটি অনাগতই রয়ে গেল। এরপরের দিনগুলো কেমন হবে কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। শামীম ও সুরাইয়া অবাক হয়ে দেখল সুরভির পাগলামি। নাহ, সে কাঁদেনি, কোনো চিৎকার করেনি। সে কেবল সুরাইয়াকে ডাকল। খুব মিষ্টি করে সুরাইয়াকে তার পাশে বসতে বলল। সুরাইয়ার উঁচু পেটে হাত বুলিয়ে বলল, বাচ্চাটা আমায় দিয়ে দাও বুবু।

সুরাইয়ার পেটের বাচ্চাকে মেরে ফেলার জন্য সুরভি পাগলামি করত। আজ সেই বাচ্চাকেই নিজের করে পাওয়ার জন্য তার পাগলামি শুরু হলো। শামীম কিংবা কোনো ডাক্তারকেই সে চিনতে পারল না। শুধু সুরাইয়ার কাছে আকুতি–মিনতি করতে থাকল পাগলের মতো।

সুরাইয়া নিশ্চুপ বনে গেল। তার দুটি সন্তান রয়েছে। সুরভি আপার একটিও নেই। সুরভি আপাকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসার পরিমাণ কি তার অনাগত তৃতীয় সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে বেশি না কম? এই প্রশ্নের উত্তর সুরাইয়ার অজানা।

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি