রহস্যময়ী যাত্রী

পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। ঘোড়াতে চড়ার দিন প্রায় শেষ। আর গাড়িতে চড়া ছাড়া মানুষের যাতায়াতের খুব বেশি একটা বিকল্প নেই এখন। ছোটবেলায় বাবার একমাত্র হুমকি ছিল পড়ালেখা করা। পড়ালেখা না করলে সারা জীবন রিকশা চালাতে হবে। এই হুমকি বা ভয় এতবার শুনতে হয়েছে যে, কল্পনা জগতে এক সময় নিজেকে রিকশা চালকের আসনে দেখতে শুরু করি। নানা রং দিয়ে সাজানো আমার রিকশা। রিকশার দুই পাশে সাদা অক্ষরে লেখা ‘মায়ের আশীর্বাদ’। বাবার কথামতো পড়ালেখা না করে আমি হই রিকশাচালক। আর মায়ের আশীর্বাদে রিকশার মালিক। বড়ই অদ্ভুত এই দুনিয়ার কেরামতি। আমার রিকশার উল্টো দিকের নিচে বাংলা সিনেমার একটা রঙিন ছবি। শুক্কুর মিস্ত্রির নিজের হাতে আর্ট করা। নায়িকা ববিতা পানি ভর্তি একটা কলসি কাঁখে নদী থেকে মেঠো পথে বাড়ি ফিরছে। অদূরেই একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে নায়ক রাজ্জাক দাঁড়িয়ে। বাঁশি বাজাচ্ছে। ববিতার মুখে শাড়ির আঁচল; লাজুক লাজুক চেহারা। তবে তাঁর গাল আর চোখ দুটো একটু বেশি ফোলা ফোলা। তাতে কী? মানুষ তো একই।
রিকশা নিয়ে আমি ঢাকা শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াই। আমার যাত্রী হয় এক রূপবতী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নারী। রিকশার হুড খোলা থাকায় পাগলা হাওয়ায় তার মাথার চুল আকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই চুলের মিষ্টি গন্ধে বাতাস মাতাল হয়ে ওঠে। রাস্তার মানুষজন আমার রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বীরদর্পে রিকশা চালাই। তারপর হঠাৎ শুরু হয় বৃষ্টি। আমি তড়িঘড়ি করে রিকশা থামিয়ে হুড উঠিয়ে দিতে যাই। কিন্তু যাত্রী আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে হুড তুলবার প্রয়োজন নেই। সে আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় যাবে। আমি নতুন উদ্যমে রিকশায় পা চালাই। ঝোড়ো হাওয়ায় এদিক-ওদিক গাছগাছালির ডাল-পালা রাস্তার পাশে পড়ে থাকে। পানিতে শহরের রাস্তা-ঘাট ঢাকা পড়ে। চারদিকে নেমে আসে আঁধার। আমি তার মধ্যেও রিকশা চালিয়ে যাই। বৈরী আবহাওয়ার প্রতি আমার যাত্রীর লেশমাত্র ভয় নেই। মনে হয় সে ভয়কে জয় করতে শিখেছে। যাত্রীর সাহস দেখে আমি মনে মনে খুশি হই। আমাকে অবাক করে দিয়ে যাত্রী গুনগুন করে গেয়ে ওঠে। কী আশ্চর্য! ওই গানটা তো আমারই। প্রতিদিন রাতে গ্যারেজে শুনি—
‘লাগ যা গালে কি ফির
ইয়ে হাসিন রাত হো না হো’
পুরোনো দিনের সাদা-কালো হিন্দি ছবির গান। ‘ও কোন থি’ ছবির গান। অনেকবার দেখা হয়েছে। আমি কল্পলোকে আমার যাত্রীর গানটা বাংলায় শুনি—
‘আমাকে আলিঙ্গন করো হে প্রিয়, এই সন্ধ্যা হয়তো আর কখনো ফিরবে না
এমনও হতে পারে এ জীবনে আর কখনো সাক্ষাৎ হবে না
আমাকে আলিঙ্গন করো, হে প্রিয়,
ভাগ্য আমাদের এই মুহূর্তটুকু দিয়েছে,
যতটুকু পারো আমকে আপন করে নাও
এই ভাগ্যটুকুও আর কখনো ফিরবে না
তোমার বুকে হাত রেখে অনেকটা সময় কাঁদতে দাও, হে প্রিয়
আমার এই চোখ আর কখনো ভালোবাসার জ্যোতি ছড়াবে না
আমাকে আলিঙ্গন করো হে প্রিয়, হে প্রিয়’
যাত্রী কেন আমার গান পছন্দ করে, তা জানি না। তাতে কী আসে যায়। রিকশাওয়ালা অনেক কিছুই জানে না। জানবার প্রয়োজনও নেই।
হঠাৎ করে খুব জানতে ইচ্ছে করল যাত্রীর পরিচয়। কিন্তু রিকশা চালাই বলে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারি না। তার নামটাও জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস নেই। আমি হলাম রাস্তার। বৃষ্টিবাদল, ঠান্ডা-গরম বাইরে যা-ই থাকুক না কেন, আমার কাজ মানুষকে নিয়ে ছুটে চলা। বিধাতা আমাকে সেই শক্তি ও সাহস দিয়েছেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। যখন রিকশায় পা চালাই, তখন পেশিগুলো ফুলে ওঠে। যখন ঘেমে যাই, তখন মনে হয় আমার দু পায়ের পেশিগুলো বাংলাদেশের আঁকাবাঁকা নদী।
মনে মনে আমি যাত্রীর একটা নাম খুঁজে বেড়াই। কী নাম দেওয়া যায় এই রহস্যময় যাত্রীর। আচ্ছা, আগুনী নামটা কেমন? আগুনের মতো সুন্দর দেখতে। কিন্তু এখন তো ঝড় হচ্ছে। তার নাম দেওয়া যায় তুফানী। তুফানের মতো গতিশীল।
মালিবাগের একটা দেয়াল ঘেরা সাদা বাড়ির সামনে এসে আমার রিকশা থামে। যাত্রী আমাকে একটা পাঁচ শ টাকার নোট দিয়ে বলে, ‘এখান থেকে তোমার ভাড়া রাখ।’
-এত বড় নোটের ভাংতি নাই।
-দু শ টাকা ফেরত দিলেও হবে।’
-আপনিই আমার প্রথম। আমার কাছে কোন ফেরত নাই।
-বেশ, তুমি কি আমাকে আবার আজিমপুর নিয়ে যেতে পারবে।
আমি খুশি হয়ে বলি, ‘জি।’
-তাহলে তুমি এই নোটটা রাখো। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি একজনের সাথে দেখা করে শিগগিরই ফিরে আসব।
ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে আমিও কিছুটা ক্লান্ত। গামছা দিয়ে মাথা ও শরীর মুছে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রিকশার সিটে গিয়ে বসি। অপেক্ষা করি আমার যাত্রীর জন্য। তার দেওয়া বড় নোটটা সযত্নে সিটের নিচে লুকিয়ে রাখি। তারপর রিকশার হুড তুলে একটু মাথা এলিয়ে দিই।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। ঘুম ভাঙলে দেখি চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাতাসে তখনো সুনসান শব্দ। ঝড়ের কারণে শহরের রাস্তাঘাট ও বাড়ি-ঘর আলোহীন। একটা মা কুকুর এসে আমার রিকশার সামনের চাকার দিকে শুয়ে আছে। সে বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু। তার কোলের ওপর একটা বাচ্চা কুকুর মাথা গুঁজে আছে। কিছুটা উষ্ণতা খুঁজছে। আমি ইতস্তত করে সাদা বাড়ির গেটে কিছুক্ষণ পায়চারি করি। কিছুটা ভয়, কিছুটা সংশয় নিয়ে। কেউ যদি আবার চোর ভেবে পুলিশে দেয়। যাত্রী কি আমাকে ঘুমন্ত দেখে চলে গেছে, নাকি এখনো সে বের হয়নি? কতক্ষণ পার হয়েছে তাও বুঝতে পারি না। বাড়ির দোতলার একটি কক্ষ থেকে মোমবাতির টিপটিপ আলো কিছুক্ষণ পরপর ঝিলিক মারে। ওখানেই কি যাত্রী আছে? না কি সে অন্য কোথাও চলে গেছে? সে কি নিরাপদ? নাকি ভয়ংকর কোনো বিপদের সম্মুখীন? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আমার কাছে তার বড় টাকার নোট এখনো আছে। সে তো আমার সাথেই ফিরে যেতে চেয়েছিল। চারদিকের নিস্তব্ধতা আমাকে বিচলিত করে। আমি উপায়ন্তর না দেখে রিকশার সিটে গিয়ে বসি। মা কুকুরটি তখনো পরম স্নেহে তার বাচ্চাকে উষ্ণতা দিচ্ছে। আমি অপেক্ষা করি, অনেক অপেক্ষা। অন্ধকার রাত আরও অন্ধকারে ঢেকে যায়। শহরের সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। সেই মোমবাতির আলোও নিভে যায়। আমার যাত্রী আর ফিরে আসে না।
অবশেষে সাদা বাড়িটিকে পেছনে ফেলে রিকশায় পা চালাই। দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায় সেই সাদা বাড়ি। আমি রিকশা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠি। বৃষ্টিভেজা রাজপথে বারবার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি। এই গভীর রাতেও যাত্রী খুঁজে বেড়াই। টুংটাং ঘণ্টায় বারবার শহরের নীরবতা ভেঙে দিই। আমি জানি আমার যাত্রী আর কখনো ফিরে আসবে না। তবুও এই অন্ধকারে আমি যাত্রী খুঁজে বেড়াই। আমি জানি এই অবেলায় কেউ হয়তো আমাকেই খুঁজছে। স্পষ্টতই শুনতে পাই এই অন্ধকারের শহরে সেই রহস্যময়ী যাত্রীর গান। বাতাসে ভেসে বেড়ায়—
‘আমাকে আলিঙ্গন করো হে প্রিয়, এই সন্ধ্যা হয়তো আর কখনো ফিরবে না
এমনও হতে পারে এ জীবনে আর কখনো সাক্ষাৎ হবে না’