একটি দীর্ঘ চুমুক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পৃথুলার ঘুম ভাঙল দেরিতে। কাল রাতে টাকিলা শর্ট বেশ জমে গিয়েছিল...রাত জাগার ফল। ভালো করে চোখ খোলার আগেই বুঝতে পারল। বাথরুমে শমীকের ছেঁড়া ছেঁড়া গানের কথা কানে আসছে। তার শাওয়ার নেওয়া হয়েছে। জামাকাপড় পরে মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য রেডি।

: এ মা, আমাকে ডাকোনি কেন? কত্ত দেরি হয়ে গেছে!

হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পৃথুলা। বলল, এতবেলা অবধি ঘুমোচ্ছি, ছি ছি। কি-না–কি ভাবছ তুমি।

: ধুর বোকা। আমি এসব ভাবতে যাব কেন বলো তো...আর এখানে সংসারের আর পাঁচজন নেই। শুধু তুমি আর আমি। কোথাও কেউ নেই। শুয়ে থাকো আরও একটু।

শমীক আদরের জবরদস্তিতে আবার শুইয়ে দিল ওকে। নিজেও জামাকাপড়সুদ্ধ শুয়ে পড়ল পাশে। পৃথুলার ঘুমে ফোলা চোখের পাতা, ঠোঁটে চুমু খেল কয়েকটা।

পৃথুলার কপালের উষ্কখুষ্ক চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে শমীক বলল, ধুর, যেতে ইচ্ছা করছে না। থেকে যাই আজ।

: থাকো না। ভালোই তো, এখানকার শহরটা তো দেখাই হলো না, চলো আজ ঘুরি। আপাতত আজকের কাগজটা দেখি। ওরে ব্বাপ! সকালে উঠেই আবার মার্ডার মিস্ট্রি, পরকীয়ার জের। এসব কেমন যেন হজম হয় না।

: শহর ঘোরা বা শপিং বাদে যদি অন্য কোনো এজেন্ডা থাকে সেটা বলো। তাহলে থাকি।

শমীকের মাথার মতলবটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পৃথুলা ওর কাঁধে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করল। বলল, কিন্তু শমীক, তুমি অফিসের কাজে চলে গেলে আমি পত্রিকা পড়ব কী করে।

: সে কী, তুমি নিচে গিয়ে কিনে নিয়ে আসো না।

পায়ে জুতা পরতে পরতে শমীক মুচকি হেসে বলে উঠল, তুমি এত ভিতুর ডিম জানা ছিল না তো। দেখে তো দিব্যি বাঘিনী মনে হয়, অবশ্য বাঘিনীই বটে...সেটা রাতে! দিনে বিড়াল।

: কেন, ভিতু হলে বিয়ে করবে না বুঝি?

পৃথুলার ভ্রু কুঁচকানো দেখে শমীক মুচকি হেসে জবাব দিল, বলা যায় না! শুধু মিষ্টি মুখ দেখে তো সংসার চলে না।

: এই প্লিজ, তুমি একটা পত্রিকা কিনে দিয়ে যাও না। নইলে আমি পাব কোথায়। তা ছাড়া আমি চাই না বের হতে।

: শোনো শোনো সোনা, আমি এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি। রাস্তায় নেমেই দেখবে সামনের রোডটাতে একটা পেপার স্ট্যান্ড আছে। ওটার স্লটে কয়েন ফেলে দরজা টানলেই খুলে যাবে।

: যা, একটা কিনে দিয়ে যাও না, যদি না পারি?

: শোনো, পারবে না কেন, এখানকার সব জিনিসই খুব ইউজার ফ্রেন্ডলি। অফিস যেতে হলে আমার আর সময় নেই। থাকলে তোমার পেপার পড়া চলবে না সারা দিন। কোনটা চাই বলো, যাই না থাকি?

পৃথুলার আদুরে মুখটা দেখে শমীকের মনে হলো, সত্যি থেকে গেলে মন্দ হতো না।

: ধেৎ যাও তো। তাড়াতাড়ি চলে এসো।

শমীকের যাওয়ার পর হোটেল রুমটাকে পৃথুলার ছোট্ট সংসার মনে হলো। জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরটাকে আলোয় আলোয় করে দিল পৃথুলা।

দিনের আলোয় রাতের সেই অদ্ভুত কাণ্ডটা স্বপ্নের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেসে গেল। বাস্তব বলে মনেই হয় না যেন। পৃথুলা কি ঘোরের মধ্যে ছিল?

কী রকম যেন একটা শান্ত ভাব রুমটায়। গায়ে একটা চাদর চেপে সে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই দেখল করিডরে একজন ভদ্রমহিলা বোরকা পরা।

নিজেই প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা।

অবাক পৃথুলার হাসিতে এক মুঠো হাসি ছড়িয়ে গেল।

ভদ্রমহিলা বললেন, নিশ্চয় আপনি বাঙালি?

: আরে হ্যাঁ। বা, কী দারুণ! বিদেশ–বিভুঁইয়ে বাঙালির দেখা, কী দারুণ হলো দেখুন তো!

: আমি একেবারে নতুন এই দেশে, এই প্রথম। কিছুই চিনি না, গতকাল এসেছি দুপুরে...।

পৃথুলা খুব অবাক হয়ে বলল আরে, আমরাও তো এসেছি কাল, একই ফ্লাইটে। আপনার সঙ্গে আলাপ হলো আর আপনিও বাঙালি। আমার হাজব্যান্ডের অফিস ট্যুরে এসেছি। তবে ও এর আগেও এসেছে বহুবার, আমি এই প্রথম। এই দেখুন নিজের কথা বকবক করতেই আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপই হলো না।

: হবে অবশ্যই, তো কোথাও যাচ্ছিলেন বুঝি?

: জি বোর হচ্ছিলাম রুমে, হাবি চলে গেল অফিস মিটিংয়ে। তাই ভাবছিলাম একটা পেপার নিয়ে আসি।

: ও ভালো তো! আপনি চাইলে আমি গল্প করতে পারি, চা খেতে খেতে।

পৃথুলা খুব আপন ভঙ্গিতেই বলল...প্লিজ আসুন না আপা, গল্প করতে করতে কফি নিতে পারি। প্লিজ আসুন, দরজা খুলে ভদ্রমহিলার প্রবেশের অপেক্ষায় দরজা দাঁড়িয়ে থাকল।

ভদ্রমহিলা রুমে ঢুকেই খুব চুপচাপ হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে খুব আস্তে বললেন, আপনার স্বামীর রুচি ভালো...সুন্দর একটা রুমে উঠেছেন, বাইরের ভিউটা খুব দারুণ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।

পৃথুলা কফি বানাতে গেল। ভদ্রমহিলাকে দূর থেকে দেখে পৃথুলা বলল, আপনি ভীষণ পর্দানশিন...ভালো লাগে...একটা অদ্ভুত পবিত্রতা ঘিরে থাকে।

ভদ্রমহিলা ভোঁ দৌড়ে দরজা নক করে এলেন। এবার কিচেনে এসে পৃথুলার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললেন, অনেক স্বামীসোহাগিনীর অ্যাক্টিং করেছ, পৃথুলা। আর তো নিতে পারছি না। এবার খেলা সাঙ্গ করার পালা। কেউ এত সোহাগ পাবে আর কেউ অবহেলা...এই হিসাব আমি মিলাতে পারছি না।

: আপা প্লিজ, আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতেছি না...।

: বুঝবে...এই যে যা বলছি করো। এই প্যাকেটের মেডিসিনটা কাপে ঢেলে দাও শিগগিরই। যা বলছি করো। নতুবা গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।

পৃথুলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেডিসিন কাপে ঢেলে ঢক ঢক করে গিলে ফেলল। তার শরীর কাঁপছে। আপা প্লিজ, এখানে আমাদের কিছু নেই। আপনি যা চান আমি তা–ই দেব। প্লিজ আপা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমার একটা ছোট বাচ্চা আছে। ওর কথা ভেবে আমাকে মারবেন না। আমি আপনার কিছু ক্ষতি করিনি।

: এই, তোর বাচ্চা কোথায় বল...ওই নারীর চোখে মুখে ক্রোধ।

: বাবার কাছে।

বলেই পৃথুলা এক ঝটকায় সত্য বলে ফেলল, আপা, আমার অফিসের বসের সঙ্গে আমি এখানে এসেছি। সবাই জানে আমি অফিস ট্যুরে...।

ওই নারীর কটমট করে বলেন, আমি জানি। তুই অফিস ট্যুরে না...রাসলীলা করতে আসছিস।

পৃথুলা অবাক হচ্ছে...চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, সন্তান, শাহেদের কথা মনে পড়ছে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। মাথাটা ভার। পেটের সবকিছু যেন গলে যাচ্ছে...।

ওই নারী চিৎকার করে বলছেন, তোকে আমি ছোঁব না...যা শিগগিরই বিছানায় শুয়ে পড়। শুতেই আসছিস...শুয়েই থাক।

পৃথুলা শুয়ে পড়ল টলতে টলতে।

ওই নারীর চিৎকার করে বলছেন, তোর ভবলীলা সাঙ্গ করতেই আমি এত দূর এসেছি।

লেখিকা
লেখিকা

তারপর দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে থাকল পৃথুলার দিকে। যাক, কষ্ট ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথুলা। যেন তেন বিষ নয়, বিষাক্ত সাপের বিষ...পৃথুলার ঠোঁটের কোণ বেয়ে সাদা ফেনার মতো কী যেন বের হচ্ছে...। এই ঠোঁটেই তো চুমু খেয়েছে শমীক। তারপর একটু একটু করে শরীরের কম্পন থেমে গেল পৃথুলার।

ওই নারীর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল। তার শরীর উত্তেজনায় থির থির করে উঠল। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে চেপে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ পৃথুলার শরীরটা দেখছেন।

হঠাৎ গুনগুন গানের আওয়াজ কানে এল। বুঝতে দেরি হলো না এই ভরাট কণ্ঠ কার। ১৭ বছরের অভ্যাস। দরজার কাছে আসতেই শমীক গুনগুন করে গান গায়। এবার হাতের পিস্তলটা তাক করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।

দরজার খুলেই শমীক বিছানার দিকে তাকিয়ে...বলছিল, পৃথুলা, আমি চলে এসেছি...আবার ঘুম। তুমি পারো বটে। এবার ওঠো।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা শুধু দেখছিলেন শমীকের আদিখ্যেতা, রোমান্টিকতা...অন্যের স্ত্রীর জন্য এমন অঢেল মায়া।

হঠাৎ দরজার ওপাশে চোখ পড়তেই শমীক চিৎকার করে উঠল, এই যে কে আপনি...ভেতরে কী করে এলেন...।

ঠিক তক্ষুনি ওই নারীর নেকাব খুলে পিস্তল উঁচিয়ে সামনে এলেন। শমীক হতভম্ব হয়ে শুধু তোতলাতে তোতলাতে বলল, না সীমা, তুমি...ভুটানে কী করে এলে...।

এবার সীমা মারমুখী হয়ে বলল, আসতে হলো। তোর আজরাইল এখানে আসছে আমার রূপ ধরে...তোর রক্ষা নেই। মুভ...যা কিচেনে গিয়ে চায়ের কাপে চা বানিয়ে রাখছি...শেষবারের মতো আমার হাতে চা খেয়ে নে...।

: যাচ্ছি যাচ্ছি, সীমা প্লিজ, এমন পাগলামো কোরো না...আমার কিছু হলে আমাদের বাচ্চারা...ওদের কে দেখবে?

: কুত্তার বাচ্চা...চা খা...আর তোর সঙ্গীর সঙ্গে স্বর্গে যা...। তোর মতো নষ্ট লোকের বাচ্চার জন্য মায়া দেখে হাসি পেল...যে কিনা জানেই না কোন সন্তান কোন ক্লাসে পড়ে। খা শিগগিরই।

ঢক ঢক আওয়াজ তুলে শমীক চায়ের কাপের পুরো চা খেয়ে ফেলল। মুহূর্তেই মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করল।

সীমার সীমাহীন হাসিতে ফেটে পড়ছে ঘরের দেয়াল-আসবাব। চোখের সামনে শুধু মনে পড়ছে শমীকের গভীর চুম্বন...শমীকের নিকৃষ্টতম অত্যাচারী আচরণ...।

এবার খেলনা পিস্তলটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে জানালার পাশে...দাঁড়িয়ে দেখতেই থাকল দূরে আরও দূরে যত দূর দৃষ্টি যায়।

নাজমীন মর্তুজা: লেখক, গবেষক ও কবি।
অ্যাডিলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়া।