ইস্তাম্বুলে সুফিবাদ ও বাউলমত নিয়ে আলোচনা

স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছেন বিদোষ চন্দ্র বর্মন
স্বাগত বক্তব্য দিচ্ছেন বিদোষ চন্দ্র বর্মন

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ ও তুরস্কের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন: প্রেক্ষিত সুফিবাদ ও বাউলমত’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় কনস্যুলেটে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।

এতে আলোচনা করেন তুরস্ক সফররত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, দেশটির লেখক ও অনুবাদক রেফিক এলগান এবং লেখক ও চিত্রনির্মাতা ফেরহাত আতিক। স্বাগত বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত কনসাল জেনারেল বিদোষ চন্দ্র বর্মন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে দেশটির সংগীতজ্ঞ ও সুফি বিশেষজ্ঞ হাকান মেনজুচ, শিল্পী জেইনেপ ইনানলিসহ তুরস্কের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন।

শাহরিয়ার কবির বলেন, বাংলাদেশ ও তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক সাম্প্রতিক। তবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়েছে বহু আগে। সুফিসাধক জালাল উদ্দিন রুমির শিষ্য হজরত শাহজালাল (রহ.) কর্তৃক বাংলার সমাজে সুফিবাদের অমিয় সুধা প্রচারের মাধ্যমে বাঙালি ও তুর্কি সংস্কৃতির সাঁকো স্থাপিত হয়।

বক্তব্য দিচ্ছেন শাহরিয়ার কবির
বক্তব্য দিচ্ছেন শাহরিয়ার কবির

বাংলায় সুফিবাদের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, বৈষ্ণববাদের মতো সুফিবাদও বাংলার সংস্কৃতিতে নানা মাত্রায় সমন্বয়ের ধারা সূচিত করে। সুফিরা বাংলার বৈষম্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় হিংসা-দ্বেষমুক্ত উদার সমাজ বিনির্মাণে ব্রতী ছিলেন।

বাঙালি সংস্কৃতির মাধ্যমে সুফিবাদ প্রভাবিত হওয়ার ঐতিহাসিক ও বস্তুগত প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলার সুফিবাদ ছিল উত্তর ভারতের সুফিবাদের বিস্তৃতি। কালক্রমে বাংলায় সুফিবাদ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। তিনি যোগ করেন, বাংলাদেশের সুফিরা হিন্দুর যোগ-ভক্তি, বৈষ্ণব সহজিয়া ও বৌদ্ধ সহজিয়া চিন্তাধারার সংস্পর্শে সান্নিধ্যে আসেন।। প্রভাবিত হন সহজিয়া সাধন পন্থায়। সুফিবাদের সংশ্লেষ ঘটে বাংলার সংস্কার ও লোকাচারের সঙ্গেও।

বাংলায় বাউলমত উদ্ভবের পেছনে সামাজিক ও ধর্মীয় আচারের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, গোড়াতেই বাংলার মাটি ও মানুষের এবং প্রাকৃতিক বিন্যাসের কারণে সুফিবাদ একটি নতুন চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। হাজার বছর ধরে বাংলায় লোকধর্ম, বৌদ্ধ তান্ত্রিক, বৌদ্ধ সহজিয়া ও বৈষ্ণবের প্রেম ধর্ম আচরিত হওয়ার ফলে বাংলার ধর্মীয় জীবনে সুফিবাদ নতুন চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়। ক্রমান্বয়ে ভাবের সম্মিলন ও সমন্বয়ের ধারাবাহিকতায় আবির্ভাব হয় ‘বাউলমত’ নামের এক লোকায়ত দর্শনের।

প্রসঙ্গক্রমে শাহরিয়ার কবির বলেন, সুফিবাদ শুধু বাংলাদেশ ও তুরস্কের জনগণকে ভাবগতভাবে একাত্ম করেনি, ধর্মের নামে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ও সন্ত্রাসের এ বিরূপ বিশ্বে আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করে চলেছে। একইভাবে বাউলমতও উদারনৈতিক জীবনাচরণের মাধ্যমে মানবপ্রেমে সিক্ত করে চলেছে ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে।

স্বাগত বক্তব্যে বিদোষ চন্দ্র বর্মন সুফিবাদের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, নির্জ্ঞেয় সন্ধানী সুফিরা যুগ যুগ ধরে আত্মোৎকর্ষ লাভে নিজেদের নিয়োজিত রাখার পাশাপাশি মানবহিতৈষণামূলক কাজেও নিজেদের উৎসর্গ করে চলেছেন।

তিনি বলেন, তাপসী রাবেয়া, শামস তাবরেজ, জালাল উদ্দিন রুমি ও শেখ সাদি থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশের লালন শাহ প্রমুখ সুফি সাধক জ্ঞান, চিন্তা ও ভাবের ঐশ্বর্যে রেখে গেছেন এক অতুলনীয় অবদান।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

বিশ্বে সুফিবাদের প্রসারের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বিদোষ চন্দ্র বর্মন বলেন, মহান সুফি সাধক জালাল উদ্দিন রুমি তৎকালীন আনাতোলিয়া বা বর্তমান সময়ের তুরস্কের কনিয়ায় সুফিবাদের যে মানবতাবাদী ও মাঙ্গলিক বাণী প্রচার শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর অনুসারীরা তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সিরিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, ভারতসহ গোটা বিশ্বে।

বাংলা তথা ভারতবর্ষে সুফিবাদের বিস্তারের ঐতিহাসিক যোগসূত্র সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর ভারত থেকে বিভিন্ন সময়ে শত শত সুফি-দরবেশ ভারতে আসেন। হজরত মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.), হজরত শাহ সফি সুলতান (রহ.) প্রমুখ সুফি সাধক মরমিবাদী বাণী প্রচার শুরু করেন ভারতে। কালক্রমে সুফিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলায়। নির্মিত হয় খানকা-দরগাহ। তিনি আরও বলেন, হজরত শাহজালালের (রহ.) বাংলায় আগমনের মধ্য দিয়ে সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার শুরু হয়, যা তৎকালীন বাংলার সমাজ-মানসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

সুফিবাদ ও বাউলমতের সমন্বয়ী চেতনার সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে বিদোষ চন্দ্র বর্মন বলেন, বাঙালির হাজার বছরের সমাজজীবনে আদর্শগত গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলার সংস্কৃতির যে রূপান্তর ঘটেছে, তার পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছে সুফিবাদ ও বাউলমত। এতে তৈরি হয়েছে বাঙালির সমন্বয়ধর্মী সমাজ চেতনা, অহিংসা ও মানব প্রেমের ভিত। তিনি বলেন, কালের ধারাবাহিকতায় সুফিসাধক ও কৃচ্ছ্রসাধকদের ভাবের মিথস্ক্রিয়ায় ও ধর্মীয় প্রশ্নে তাঁদের মতভেদ বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে যে উদারনৈতিক ও সমন্বয়ধর্মী বাউলমতের উদ্ভব হয়েছে, তা বাংলার ভাবসম্পদকে আরাধ্য করে তুলেছে। বাঙালির মানবিক চৈতন্যে তা আজও ভাস্বর।

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক সময় থেকে বাংলাদেশ ও তুরস্কের যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, তা কালের পরিক্রমায় গভীরতর, প্রসারিত ও আরও শক্তিশালী হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে, তিনি তুরস্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এবং বাংলাদেশে কামাল আতাতুর্কের নামে সড়কের নামকরণের বিষয়টিকে দুই দেশের ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের প্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।

আলোচনা শেষে হাকান মেনজুচের পরিচালনায় রুমি ও লালনের ওপর দলীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। বিজ্ঞপ্তি