ঠাটবাট

আজ রুবি ভাবির বাসায় পার্টি। তাদের বাসায় প্রায়ই পার্টি থাকে। রুবি ভাবির স্বামী দিদার ভাইয়ের বাড়ি বিক্রমপুরে। আতিথেয়তা তার শখ ও জীবনের অনুষঙ্গ। প্রায়ই পার্টি দেন তারা। অনেক মানুষ এসেছে। অনেকে কেউ কাউকে চেনেন না।

মুনা দেশ থেকে এসেছে তিন মাসের বেশি হয়। বলা চলে হানিমুন পিরিয়ড চলছে। নতুন সংসার, হাঁড়িকুড়ি, ইউটিউব রেসিপি অ্যাপ্লাই ও আশপাশে ঘোরাঘুরি চলছে।। সম্প্রতি সে ফেসবুক অ্যাকাউন্টও খুলেছে। প্রতিদিনই ছবি দেয়—রান্নার, নতুন ফ্রাইপ্যান, শপিং ট্রলি ইত্যাদি। বিষয়বস্তুর অভাব নেই। আত্মীয়-বন্ধু সবাই লাইক দেয়। বড় সুখে আছে সে।

তবে এখানে সে কিছুটা নিঃসঙ্গ। গ্রামে সে এক ঘর ভরা মানুষের মাঝে থেকে অভ্যস্ত। এখন এক ফ্ল্যাটে বন্দী। গল্প করার মতো লোক নেই। ফোনে আর কাঁহাতক গল্প করা যায়? রক্তমাংসের কারও সঙ্গে গল্প করতে মন চায়।

তার স্বামী হাসান সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে। কাজের রুটিনের রাতদিন নেই। বাসায় থাকলে সে স্পোর্টস, টকশো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এটা-সেটা রান্নাবাড়া করতে বলে। এত বছরের একা ব্যাচেলর জীবন শেষে একটু আরাম করতে চায়।

হাসানের বয়স ৩৫। মুনার ২০। দুজনের কথা বলার মতো এমন কিছু নেই, যা দুজনই উপভোগ করবে। মুনার এ নিয়ে দুঃখ নেই। তার বান্ধবীদের একজন প্রেম করে বিয়ে করেছে। চ্যাংড়া জামাই। টাকাপয়সা নেই। মুনার সেই বান্ধবী তিনটা থ্রিপিসই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে। সাজগোজের জিনিস নেই। মুনা আসার আগে তার কিছু জিনিস বান্ধবীকে দিয়ে এসেছে।

মুনার গল্প করার জন্য মেয়ে বন্ধু চাই। স্বামীর সঙ্গে মেয়েলি আলাপ চলে?

তাই সে অন্যের সঙ্গে মিশতে চায়। তবে তার স্বামী হাসান সতর্ক করে দিয়েছে যার–তার সঙ্গে না মিশতে। কিছু বাঙালি ভাবির চলাচলতি ভালো নয়। শেষে মুনা বিগড়ে যেতে পারে। না, না, মুনা একেবারেই বিগড়াতে চায় না। সে সংসারের শান্তি বজায় রাখায় বিশ্বাসী।

পার্টিতে সে সবাইকে তার অনভিজ্ঞ চোখে পরিমাপ করে। কার সঙ্গে কথা বলা যায়? পার্টিতে যারা পূর্বপরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। যাদের বাচ্চা ছোট তারা বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। তাদের খাওয়াতে হচ্ছে বা পাহারা না দিলে হয় জিনিসপত্র নষ্ট করছে অথবা বাইরে চলে যাচ্ছে। রুবি ভাবি আয়োজন তদারকি নিয়ে খুবই ব্যস্ত। তিনি কারও সঙ্গে ভিড়তে পারছেন না। মুনা মনে মনে ভাবে, আগ বাড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলবে?

: আপনি অন ট্রে আইটেম নিয়েছেন?

একজন স্মার্ট ও পরিপাটি ভাবি মুনাকে জিজ্ঞেস করেন।

: জি, কী নেব বললেন?

: ওই যে, স্প্রিং রোল, চিপস নিয়েছেন?

: জি নিয়েছি।

: আমি তানিয়া, আপনি?

: মুনা, আমার হাজবেন্ডের নাম হাসান।

তানিয়া হেসে ফেলে। মেয়েটা মনে হয় এ দেশে নতুন। এখনো আইডেনটিটি নিয়ে কনফিডেন্ট হতে পারেনি। স্বামীর পরিচয়টা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তানিয়াও এমন ছিল। বলল, আপনি একা বসে আছেন, তাই আলাপ করতে এলাম।

: জি, খুব ভালো হলো। আমি এখানে কাউকে চিনি না তেমন।

: কয়েক বছর হলো এখানে এলেন?

: তিন মাস আগে এসেছি। আপনি?

: এই বছর তিনেক।

: তা হলে তো অনেক দিন।

মুনা অবাক হয়।

: হু, আপনার তুলনায় তো অনেকই।

হাসে তানিয়া।

: ছেলেমেয়ে নেই?

: প্ল্যান করিনি এখনো। দেখি আরেকটু গুছিয়ে নিই।

মুনা খুব অবাক হয়। তিন বছরেও বাচ্চা চায় না? বলে গুছিয়ে নিই। নাকি বাচ্চা হয় না? সমস্যা আছে? কৌতূহল হয় তার।

: ও আচ্ছা, জব করেন?

: হ্যাঁ।

: কোথায়?

: একটা ইউনিতে। ক্লিনিং করি।


: ক্লিনিং? কী ক্লিন করেন?

মুনা আরও অবাক।

: ফ্লোর, টয়লেট সবই করা লাগে।

মুনার একটু গা ঘিনঘিন করে। এই মহিলা সুইপার! মেথর! ছি। এর পাশে বসতেও অস্বস্তি লাগছে। তার একটু শুচিবাই আছে। হোক বিদেশি সুইপার। সুইপার তো সুইপারই। অথচ পোশাকআশাক, গয়নাগাটি বেশ দামি। কে বুঝবে বাইরে থেকে। এতক্ষণ যে আন্তরিক গলায় কথা বলছিল, তাতে ভাটা পড়ে।

মুনার চেহারার পরিবর্তনটা তানিয়ার চোখ এড়ায় না। সে মনে মনে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। তানিয়ার স্বামী এখনো স্টুডেন্ট। তাদের রেসিডেন্সি নেই। এ অবস্থায় জব নিয়ে খুঁতখুঁত করার অবস্থায় সে নেই। তার টাকা দরকার। তারা তিন বোন। ভাই নেই। একজনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেকজন এখনো পড়ছে। মা-বাবা গ্রামে থাকেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলমাস্টার। সে এখান থেকে সাহায্য না করলে তারা চলতে পারবেন না। তার স্বামী আতিকের ওয়ার্কিং আওয়ার পারমিট সপ্তাহে মাত্র ২০ ঘণ্টা। ম্যাক্সিমাম ইনকাম তানিয়াই করে। খেতে পরতে চলতে খরচ প্রচুর। শৌখিন গৃহবধূ হওয়ার মতো অবস্থা তার নেই। আর এ অবস্থায় বাচ্চা নেওয়ার মতো বিবেচনাহীন কাজও সম্ভব নয়। বাইরের লোকে এসব কিছুই বোঝে না।

: ভাইয়া কী করেন ভাবি?

মুনা জিজ্ঞেস করে।

: ও স্টুডেন্ট। পার্টটাইম কাজ করে এজড কেয়ারে।

: এজড কেয়ার কী?

: ওল্ড হোম।

সংক্ষেপে বলে তানিয়া।

: সেখানে কী করতে হয়?

: সব। গোসল, খাওয়ানো, বাথরুম করানো। সব।

তানিয়া রাখঢাক করার চেষ্টা করে না। সে তার পেশা বা স্বামীর অবস্থা নিয়ে লজ্জিত নয়। কেন রাখঢাক করবে?

মুনা আরও গম্ভীর হয়ে যায়। হাসবেন্ড-ওয়াইফ দুজনই খবিশ। দেশে আর কাজ নেই? একজন সুইপার আরেকজন আয়াবুয়ার কাজ করে, ছি।

এমন সময় রুবি ভাবি ডিনার খেতে ডাকেন। মুনা হাঁপ ছাড়ে। তাড়াতাড়ি ডিনার নিতে চলে যায়। এই সুইপার মহিলার ছোঁয়াছুঁয়ি এড়াতে চায় সে।

তানিয়া মুচকি হাসে। তার কাজের প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে। ক্লিনিংয়ের জিনিসপত্র হাতে নিয়ে এমন কান্না পেয়েছিল। আজও মনটা খারাপ হচ্ছে। জানে সে বেকার থাকার চেয়ে শ্রমের গুরুত্ব অনেক বেশি। তবু কারও অসম্মানের দৃষ্টি বড় কষ্ট দেয়।

: কী, নতুন গাড়ি কিনছেন বলে?

রুবির ডাকে বাস্তবে ফিরে তানিয়া।

: জি ভাবি, এই আর কী?

: ব্র্যান্ড নিউ?

: না, ২০১৬–এর। ফক্সওয়াগন।

: প্রায় নতুনই তো। আমি তো লাইসেন্সই নিতে পারলাম না। গাড়ি তো স্বপ্নই।

: নিয়ে নেন। অনেক ভালো ইনস্ট্রাক্টর আছে এখন।

: তোমার ভাই ব্যাটা ইনস্ট্রাক্টর পছন্দ করে না।

: নারীও আছে। রকডেলের আঞ্জুমান ভাবি। বেশ ভালো শেখান শুনেছি।

: আচ্ছা, নম্বরটা দিয়েন। এখন ডিনার করেন। আসেন। ডেজার্টে আজকে তিন পদের মিষ্টি করেছি। খাইয়েন মনে করে। আপনে তো আবার ডায়েট কন্ট্রোল করেন।

: আরে না, দাওয়াতে আবার কিসের ডায়েট?

খাওয়া, গল্প, পার্টি শেষে যে যার বাড়ি চলে যান।

–––

পাঁচ বছর পর তানিয়া এখন একটা অফিসের পার্টটাইম রিসেপশনিস্ট। ব্যাংকিং কোর্সে অ্যাডমিশন নিয়েছে। বাচ্চার বয়স দুই। সিটিজেনশিপ হয়ে গেছে। ওলাইক্রিকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে তারা। আতিক এখন নভোটেল হোটেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড শেফ। সব গুছিয়ে নিয়েছে তারা। সামনের বছর নিউজিল্যান্ড বেড়াতে যাবে। এমনিতে বছরে তিন–চারবার এদিক–ওদিক ঘোরাঘুরি হয়। ভালো আছে তারা। তানিয়ার ছোট বোনও এখানে এখন। দুই বোনের ইনকামে গ্রামে একটা ভালো বাড়ি আর বাজারে দুটি দোকান আছে। তার মা–বাবা ভালোই আছেন।

মুনার বাচ্চা দুটি। সংসারের খরচও বেড়েছে অনেক। হাসানের বয়স ৪০। কাজকর্ম সে রকম করতে পারে না। মুনা কাজ করতে চায়। কিন্তু প্রায় অসম্ভব মনে হয়। ঘরের সব কাজ সামলে বাইরে কীভাবে কাজ করবে? ঘরের কাজ সামলে কী কাজই বা করবে? ভালো ইংরেজিও জানে না। তা ছাড়া এখন নাকি কোর্স ছাড়া কাজও পাওয়া যায় না? ভরসা যে, সেন্টার লিংক থেকে দুই বাচ্চা বাবদ মাসে হাজার ডলার। সেটা সংসারেই লেগে যায়। গত বছর তার বাবা মারা গেছেন। স্ট্রোক করে আইসিউতে ছিলেন ১৫ দিন। অত খরচ আর জোগানো যায়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল সবাই। এর দুই মাস পর বাসাতেই মারা যান। তার খুব ইচ্ছে ছিল বাবার জন্য কিছু চিকিৎসা খরচ দেওয়ার। কিন্তু হাসানের হাত একেবারেই খালি ছিল। অনেক কেঁদেছিল সে। দেশে যেতে চেয়েছিল বাবাকে দেখতে। টিকিটের দাম জোগাতে পারেনি।

মুনার মাঝেমধ্যেই তানিয়ার কথা মনে হয় তার। সুইপার হোক আর যাই হোক, তার নিজের ইনকাম ছিল। সে হয়তো প্রয়োজনে নিজের পরিবারকে সাহায্য করতে পারে। দেশে যাওয়ার টিকিটের জন্য স্বামীর মুখাপেক্ষী হতে হয় না। বাচ্চাকাচ্চা বড় হলে, সে ঠিক একটা জব করবে। এটা তার একটা স্বপ্ন।

যদিও সেটা আসলে বাস্তব হয় না। অভ্যাস, অভ্যস্ততা এসব ছেড়ে বেড় হওয়াটা শুনতে যত সহজ, করতে ততটাই কঠিন। জীবন একটি ওয়ান ওয়ে জার্নি। পালটাতে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে হয়।
–––

ডা. আমেনা বেগম ছোটন: বেক্সলি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।