শূন্য বিন্দুতে নারী - ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দিন শেষে একটি অজানা-অচেনা রাস্তায় নিজেকে আবিষ্কার করি। নীল নদের পাড়ঘেঁষা ঝকঝকে পরিষ্কার পাকা রাস্তাটির দুই ধারে উঁচু উঁচু গাছের সারি। বাড়িগুলো সুন্দর করে বেষ্টনী দেওয়া। আর বাগান সুসজ্জিত। ফুসফুসে টেনে নেওয়া বাতাস নির্মল, ধুলোহীন। নদীর দিকে মুখ করা একটি পাথরের বেঞ্চি নজরে আসে। সেখানটায় বসে মুখ উঁচু করে বিমল হাওয়ার স্বাদ নিই।

সবে একটু চোখ বুজেছি, অমনি শুনতে পাই এক নারী জিজ্ঞেস করছেন, ‘কী নাম তোমার?’

চোখ মেলে দেখি, তিনি আমার পাশে বসে আছেন। গায়ে সবুজ শাল জড়ানো। চোখে সবুজ রঙের মেকআপ। তাঁর চোখের কালো মণিতে যেন সেই সবুজের ছায়া পড়েছে—নীল নদের তীরঘেঁষা গাছের সারির মতো গাঢ় সবুজ সেই আভা। গাছের সবুজ, নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে যেন তার চোখের সবুজে একাকার হয়ে ভাসছে।

আমাদের মাথার ওপরের আকাশখানি তার সবটুকু নীল বুকে করে ঝুলে আছে। তারপরও রংগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে আমার চারপাশের সবকিছু থেকে এক তরল সবুজ দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সবুজ আলোটুকু আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে, গ্রাস করছে আর আমি তাতে তলিয়ে যাচ্ছি।

গাঢ় সবুজে তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটি অদ্ভুত। এই গাঢ় সবুজের নিজস্ব তীব্রতা আছে। ঘনত্ব আছে। অনেকটা সাগরের জলের মতো। সেই জলের ওপর আমি ঘুমাচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন আর ঘুমের মাঝে হঠাৎ তলিয়ে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে ডুবতে থাকলেও জল আমায় ভেজাচ্ছে না। ডুবেও যেন ডুবছি না। এক মুহূর্তে মনে হলো সাগরের তলায় শুয়ে আছি। পরমুহূর্তে মনে হলো, হাত-পা না নেড়েই ধীরে ধীরে ভেসে উঠে আসছি সাগরপৃষ্ঠে।

চোখের পাতা ভারী হয়ে মনে হচ্ছিল। যেকোনো মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু কানে তাঁর কণ্ঠস্বর তখন আবারও বেজে ওঠে। মৃদু সেই কণ্ঠস্বর। মসৃণ, মোলায়েম। এতটাই পেলব যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন।

তিনি বলেন, ‘তুমি ক্লান্ত।’

কষ্টেসৃষ্টে চোখের পাতা মেলে বলি, ‘হ্যাঁ।’

তাঁর চোখের সবুজ আরও ঘন হয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করেন, ‘কুত্তার বাচ্চা তোমার সঙ্গে কী করেছে?’

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া মানুষের মতো চমকে উঠে বলি, ‘কার কথা বলছ?’

তিনি শালটি আরও ভালো করে কাঁধে জড়িয়ে, হাই তুলে, সেই মৃদু-মসৃণ-তন্দ্রাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘একটা হলেই হলো, কোনো ফারাক নেই। সব কটিই একই—কুত্তার বাচ্চা। শুধু ভিন্ন ভিন্ন নাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহমুদ, হাসনাইন, ফৌজি, সাব্রি, ইব্রাহিম, আওয়াদিন, বেইউমি।’

আমি তাঁকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠি, ‘বেইউমি?!’

তিনি সশব্দে হেসে ওঠেন। এক পলকের জন্য চোখে পড়ে তাঁর ছোট ছোট-ঝকঝকে-চোখা দাঁতগুলো, মাঝে আবার একটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো।

‘ওদের সব কয়টাকেই চেনা আছে আমার। কিন্তু শুরুটা করল কে? তোমার বাবা, ভাই...মামা, চাচা, খালু, ফুপা?’

এবার আমার সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। ঝাঁকুনির চোটে পাথরের বেঞ্চি থেকে শরীরটি যেন লাফিয়ে ওঠে।

নিচু গলায় বলি, ‘চাচা।’

তিনি আবারও হেসে ওঠেন। সবুজ শালের একটি প্রান্ত কাঁধের ওপর ছুড়ে দেন।

‘আর বেইউমি করলটা কী?’ এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলেন, ‘তুমি কিন্তু তোমার নাম বলোনি। কী নাম তোমার?’

‘ফেরদৌস। আর তুমি? তোমার পরিচয়?’

তিনি অদ্ভুত রকম গর্বভরে পিঠ ও গ্রীবা টান টান করে উত্তর দেন, ‘আমি শরিফা সালাহ আদ-দ্বীন। আমাকে সবাই চেনে।’

তাঁর বাসায় যাওয়ার পথের পুরোটা সময় আমি তাঁকে আমার কাহিনি শোনাতে থাকি। নদীর তীরঘেঁষা রাস্তাটি ছেড়ে আমরা আরেকটি ছোট রাস্তায় মোড় নিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে থামি। লিফটে চড়ে ওপরে ওঠার সময় আমার সারা শরীর থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। তিনি হাতব্যাগ থেকে চাবি বের করেন। পরমুহূর্তেই নিজেকে আবিষ্কার করি কার্পেট মোড়ানো, ঝাঁ-চকচকে এক ফ্ল্যাটে। সামনে নীল নদের দিকে মুখ করা বিশাল বারান্দা। তিনি আমাকে বাথরুমে নিয়ে দেখিয়ে দেন কীভাবে কল ছেড়ে গরম আর ঠান্ডা পানি মেশাতে হয়। যাতে আমি গোসল সেরে নিতে পারি। নিজের কিছু কাপড়ও আমাকে পরতে দেন। পোশাকগুলো ভীষণ পেলব আর সুগন্ধ ছড়ানো। আমার চুল আঁচড়ে দেওয়ার সময় ও জামার কলার পরিপাটি করার সময় টের পাই তার আঙুলগুলোও কোমল ও পেলব। এখানে আমার আশপাশের সবকিছুই কোমল, পেলব। চোখ বুজে কোমলতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিই। মনে হচ্ছিল, আমার শরীরটি যেন সদ্যোজাত শিশুর মতো হয়ে গেছে। ফ্ল্যাটের সবকিছুর মতোই নরম, কোমল, পেলব।


চোখ মেলে আয়নায় তাকালে টের পাই, আমার যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। নতুন শরীর নিয়ে গোলাপ পাপড়ির মতো সতেজ, কোমল। কাপড়চোপড়ে নেই কোনো মালিন্য। সেগুলো এখন পরিচ্ছন্ন-কোমল। বাসাটি একদম ঝকঝকে, পরিষ্কার। বাতাসটা পর্যন্ত তাজা। আমি নির্মল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিই। ঘুরে তাঁর দিকে তাকাই। তিনি কাছেই দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিলেন। তাঁর চোখ উজ্জ্বল-সবুজ আভা ছড়াচ্ছে-গাছগাছালি, আকাশ ও নীল নদের জলের মতো।

আমি তাঁর দুই চোখে হারিয়ে যাই, গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলি: ‘তুমি কে গো?’

তিনি উত্তর দেন, ‘তোমার মা।’

‘আমার মা তো বহু আগেই বিগতা।’

‘তাহলে বোন।’

‘আমার যে কোনো ভাইবোন নেই। ওরা সবাই খুব ছোট থাকতেই মারা গেছে, মুরগি ছানার মতো।’

‘সবাইকেই মরতে হবে, ফেরদৌস। আমাকেও, তোমাকেও। দেখার বিষয় হচ্ছে, মরার আগে তুমি জীবনটা কতটা উপভোগ করছ, সেটা।’

‘জীবন যা কঠিন, উপভোগের আর অবকাশ কই?’

‘তোমাকে জীবনের চেয়েও কঠিন হতে হবে, ফেরদৌস। জীবন তো কঠিনই। কিন্তু ওরাই জীবনকে উপভোগ করতে পারে, যারা জীবনের চেয়েও কঠিন।’

‘কিন্তু তুমি তো কঠিন নও, শরিফা। তাহলে কেমন করে জীবনকে উপভোগ করো?’

‘আমি কঠিন, দুর্দান্ত কঠিন, ফেরদৌস।’

‘মোটেই না। তুমি অনেক নরম, কোমল।’

‘আমার ত্বক কোমল হতে পারে, কিন্তু হৃদয়টা বড়ই নির্মম আর ছোবলে বিষ।’

‘সাপের মতো?’

‘হ্যাঁ একদম সাপের মতো। জীবনটাই তো একটা সাপ। কোনো ফারাক নেই। দুটি একই রকম ফেরদৌস। সাপ যখন বুঝতে পারে তুমি সাপ নও, তখনই ছোবল দেয়। আর জীবন যখন বোঝে, তোমার হুল ফোটানোর ক্ষমতা নেই, তখন তোমাকে আস্ত গিলে সাবাড় করে।’

---

আমি শরিফার এক নবীন শিষ্যা হয়ে উঠি। তিনি আমাকে দেখতে শেখান আমার জীবন, দূর-শৈশবে ফেলে আসা হারিয়ে যাওয়া সব ঘটনা। সার্চলাইটের আলো ফেলে উন্মোচন করেন আমার অস্তিত্বের অস্পষ্ট অংশ, আমার মুখ ও শরীরের অদেখা জায়গা। আমি যেন এই প্রথমবারের মতো সেসব দেখছি, জানছি, অনুভব করছি।

আবিষ্কার করি, আমার চোখ দুটো কালো। আর তাতে এমন চমক আছে, যা অন্য চোখকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। নাকটি বড়ও না, থ্যাবড়াও না, ভরাট ও মসৃণ বরং, যা আবেগের জোয়ার আনতে পারে, ক্ষণে ক্ষণে চাই কি কামনার ঢলও। শরীরের গড়ন একহারা। ঊরু পেশিবহুল, টান টান, যেকোনো মুহূর্তে আরও আঁটসাঁট হতে সদা প্রস্তুত। বুঝতে পারি, আমি আসলে মাকে ঘৃণা করিনি, চাচাকেও ভালোবাসিনি, আর সত্যিকার অর্থে কখনো চিনে উঠতে পারিনি বেইউমি বা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের।

শরিফা একদিন বলেন, ‘বেইউমি ও ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা কেউই তোমার মূল্য বোঝেনি তুমি নিজেই নিজের মূল্য বুঝে ওঠোনি বলেই। পুরুষেরা কখনোই নারীর মূল্য জানে না, ফেরদৌস। নারীকেই নিজের মূল্য স্থির করতে হয়। দাম যত বাড়িয়ে ধরবে, ওদের চোখে তুমি ততই মূল্যবান হয়ে উঠবে এবং সেই মূল্য পরিশোধে ওরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। আর নিজের সাধ্যে না কুলালে, প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে চুরি করে এনে হলেও তোমার দাবি মেটাবে।’

আমি বিস্ময়ে জমে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আমার কি সত্যিই কোনো দাম আছে, শরিফা?’

‘তুমি দেখতে ভালো, শিক্ষিতাও।’

আমি বলি, ‘শিক্ষিতা? আমার তো দৌড় শুধু মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পর্যন্ত।’

‘তুমি সব সময় নিজেকে খাটো করে দেখো, ফেরদৌস। আমার পড়াশোনা তো আরও কম—প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত।’

সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমারও কি তাহলে দাম আছে?’

‘অবশ্যই আছে। চড়া দাম মেটানো ছাড়া কেউ আমাকে ছুঁতে পারে না। বয়সে তুমি আমার চেয়ে ছোট, শিক্ষাদীক্ষায়ও আমাকে ছাড়ানো। আমার দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ না করে কেউ তো তোমার কাছেই ঘেঁষতে পারার কথা না।’

‘কিন্তু পুরুষের কাছে যে আমি কিছু চাইতে পারি না।’

‘তোমাকে কিছু চাইতে হবে না। ওটা তোমার মাথাব্যথার বিষয় না। আমি দেখব ওটা।’

---

নীল নদ, আকাশ ও বৃক্ষরা কি বদলায়? আমি তো বদলেছি, তবে নীল নদ কেন না? বৃক্ষের রং কেন না? প্রতিদিন সকালে যখন জানালা খুলি, দেখি সামনে নীল নদ বয়ে চলছে। নিবিষ্ট মনে দেখি জল ও গাছের সবুজ, যে উজ্জ্বল সবুজ আলোয় সারা বিশ্ব স্নানরত। অনুভব করি প্রচণ্ড জীবনীশক্তি, যা আমার এই দেহের শিরায় শিরায় উষ্ণ রক্তের সঙ্গে বহমান। শরীর কোমল উষ্ণতায় ছেয়ে যায় পরনের রেশমি কাপড় বা বিছানায় পাতা রেশমি চাদরের স্পর্শের মতো কোমলতায়। খোলা প্রান্তর পেরিয়ে নাকে ভেসে আসে তাজা গোলাপের সুবাস। এই উষ্ণ-কোমলতায় নিজেকে সঁপে দিই, বিভোর হই সতেজ গোলাপের সুবাসে। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি মাথার নিচের নরম বালিশ আর রেশমি চাদরের নিচে আড়মোড়া ভাঙার আয়েশ। অসীম তৃষ্ণায় নাক, মুখ, কানসহ শরীরের প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে স্বাদ নিই তরল-কোমলতার।

রাতের বেলা আমার ওপর জ্যোৎস্নার রেশমি সাদা আলোর ঢেউ খেলে যায়—ওই মুহূর্তে পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির আঙুলের মৃদু স্পর্শের মতো। তার নখও পরিষ্কার, সাদা। বেইউমির নখের মতো আঁধার-কালো না, চাচার মতো আগায় ময়লা ঠাসাও না। আমি চোখ বুজে রুপালি আলোয় স্নান করতে থাকি। রেশমি আঙুলগুলোকে আমার মুখ-ঠোঁট ছুঁয়ে, গলা বেয়ে নিচে নেমে, দুই স্তনের মাঝখানে ঠাঁই নিতে দিই।

কিছুক্ষণ আঙুলগুলোকে স্তনের মাঝে রেখে আদর করি, তারপর নেমে যেতে দিই পেটে এবং সেখান থেকে ঊরুসন্ধিতে। শরীরের গভীর থেকে একধরনের কাঁপুনি উঠে আসে। শুরুটি সুখানুভূতির-যন্ত্রণাসম সুখানুভূতির। আর শেষটি হয় যন্ত্রণায়-সুখানুভূতিসম যন্ত্রণায়। এর জন্ম সুদূর অতীতে, আর তা কেমন করে যেন শুরু থেকেই আমার সাথি। বহু আগে এর স্বাদ পেয়েছিলাম, সময়ের পরিক্রমায় যা ভুলে গেছি। তবুও এই অনুভূতি যেন আমার গোটা জীবনের চেয়েও প্রাচীন, এর শুরু যেন আমার আয়ুষ্কালেরও আগ থেকে, এর উৎপত্তি যেন আদিম কোনো ক্ষত থেকে, এর উত্থান যেন এমন এক অঙ্গ থেকে, যা এখন আমার না। এর জন্ম যেন এমন এক নারীর শরীরে, যে আর আমি নই।

একদিন শরিফাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমার কোনো রকম আবেগ আসে না কেন?’

‘এটা আমাদের পেশা, ফেরদৌস, শুধুই পেশা। কাজের সঙ্গে আবেগ মিলিও না।’

বলে উঠি, ‘কিন্তু আমার যে আবেগ চাই, শরিফা!’

‘আবেগ দিয়ে কিছুই পাবে না, কষ্ট ছাড়া।’

‘কোনো সুখই কি নেই? একটুও না?’

শরিফা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। চোখে পড়ে তার ছোট ছোট, ধবধবে, সুচালো দাঁত। মাঝখানের একটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো।

হঠাৎ করেই তিনি চুপ হয়ে গিয়ে আমার দিকে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে বলেন, ‘ভাত আর মুরগির রোস্টে সুখ পাও না? এসব কোমল-রেশমি পোশাকে? নীল নদমুখী জানালাওয়ালা এই উষ্ণ–ঝকঝকে বাসা তোমাকে সুখ দেয় না? প্রতিদিন ভোরে যে জানালা খুলে নীল নদ, আকাশ, গাছগাছালি দেখো, তাতেও তোমার সুখ হয় না? এসব কিছু কি যথেষ্ট না? তাহলে এর বেশি আর চাওয়া কেন, লোভ কেন?’

চাওয়াটা মোটেও লোভ থেকে ছিল না। এক সকালে যথারীতি জানালা খুলে আর নীল নদ দেখতে পাই না। জানি, নীল নদ জায়গামতোই আছে, চোখের সামনেই তার জলরাশির বিস্তার। কিন্তু আমার আর চোখে পড়ছে না। নাগালের মধ্যে থাকা জিনিস যেমন কখনো কখনো মনুষ্য চোখে ধরা পড়ে না, তেমনই। চারপাশের, এমনকি নাকের সামনের সব সুবাসও উধাও। কোনো গন্ধই আর পাই না, চোখের মতো নাকটিও যেন অনুভবের সব ক্ষমতা হারিয়েছে। কোমলতা, রেশমের মসৃণতা, আরামদায়ক বিছানাসহ সবকিছু আগের মতোই আছে জানি, শুধু আমার কাছেই তারা যেন অস্তিত্ব হারিয়েছে।

আমি কখনো ঘর ছেড়ে বের হতাম না। শোয়ার ঘরের বাইরেও না। দিনরাত বিছানায় পড়ে থাকতাম—ক্রুশবিদ্ধের মতো, আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় আগমন ঘটত পুরুষের। অগুনতি পুরুষ। মাথায় আসত না, এত পুরুষ আসে কোত্থেকে। এরা আবার সবাই বিবাহিত, শিক্ষিত, হাতে চামড়ার ভারী ব্যাগ, আর ভেতরের পকেটে চামড়ার ফোলা মানিব্যাগ। অতিরিক্ত খাবার খেয়ে খেয়ে তাদের ভুঁড়ি ফুলে, ফেঁপে, ঝুলে-পড়া। গলগল করে তাদের শরীর বেয়ে নেমে আসা ঘামের বোটকা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগত। গন্ধটি অনেকটা বদ্ধ জলাশয়ের পানির মতো, এত দিন যেন তাদের শরীরের কোথাও জমে ছিল। আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখতে চাইলে তারা জোর করে আমার নাক তাদের শরীরে ঠেসে ধরত। তাদের বড় বড় নখ আমার মাংসে গেঁথে বসলে ঠোঁট চেপে আর্তনাদ করতাম এবং কষ্টের চেহারাটি লুকানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু তারপরও ঠোঁটের ফাঁক গলে চাপা গোঙানি বের হয়ে যেত।

প্রায়ই তারা সেই গোঙানি শুনে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বেকুবের মতো জানতে চাইত, ‘মজা পাচ্ছ?’

জবাবে ঠোঁট চোখা করে তাদের মুখে থুতু ছিটাতে উদ্যত হলে তারা উল্টো হামলে পড়ে আমার ঠোঁট কামড়ে ধরত। নিজের ঠোঁটের ফাঁকে তাদের লালা টের পেলে জিব দিয়ে ঠেলে তা তাদের মুখে পুরে দিতাম।

এত পুরুষের মধ্যে শুধু একজনই ছিল ব্যতিক্রম। বেকুবের মতো জানতে চাইত না, মজা পাচ্ছি কি না।

উল্টো বরং একদিন জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যথা পাচ্ছ?’

আমি বলি, ‘হ্যাঁ।’

‘নাম কী তোমার?’

‘ফেরদৌস। তুমি?’

‘ফৌজি।’

‘জানলে কেমন করে ব্যথা পাচ্ছি?’

‘আমি যে তোমাকে বুঝতে পারি।’

‘বুঝতে পারো?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।

সে বলে, ‘হ্যাঁ, বুঝি তো। আর তুমি? তুমিও আমাকে বোঝো?’

‘আমি কোনো কিছুই বুঝি না।’

‘কেন?’

‘জানি না। শরিফা বলেছে, কাজের জায়গায় কাজ। আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।’

সে ছোট্ট করে হেসে আমার ঠোঁটে চুমু খায়। ‘শরিফা তোমাকে বোকা বানিয়ে তোমাকে দিয়ে টাকাপয়সা কামিয়ে নিচ্ছে, আর বিনিময়ে তুমি পাচ্ছ শুধু যন্ত্রণা।’

আমি কেঁদে ফেলি। সে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বুকে টেনে নেয়। আমি চোখ বন্ধ করি। সে আমার চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খায়।

শুনি ফিসফিসিয়ে বলছে: ‘ঘুমাতে চাও?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার হাতের ওপরই ঘুমাও।’

‘আর শরিফা?’

‘ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

‘তুমি? তুমি ওকে ডরাও না?’

সে আবারও তার সেই ছোট্ট হাসিটি হেসে বলে, ‘ওই বরং আমাকে ভয় পায়।’

আমার তখনো পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। চোখ বোজা। শরিফার আর আমার কামরার মাঝখানের দেয়াল ভেদ করে মৃদু কণ্ঠের আলাপ কানে ভেসে আসে। শরিফা কোনো লোকের সঙ্গে যেন কথা বলছে। লোকটির কণ্ঠ পরিচিত ঠেকে।

‘তুমি ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে?’

‘আমি ওকে বিয়ে করব, শরিফা।’

‘তুমি! তুমি তো বিয়ে করার বান্দা না।’

‘ওসব দিন আর নেই। আমার এখন বয়স হয়েছে। ছেলেসন্তান চাই আমার।’

‘সে যাতে তোমার সম্পত্তি পায়?’

‘আমার সঙ্গে মশকরা কোরো না, শরিফা। তুমি ভালো করেই জানো, চাইলে এত দিনে কোটিপতি হতে পারতাম। কিন্তু আমি ফুর্তির জন্য বাঁচি। টাকা কামাই উড়ানোর জন্য। দাসত্ব আমার ধাতে নেই, সেটা সম্পদের জন্যই হোক কিংবা ভালোবাসার।’

‘তুমি ওকে ভালোবাসো, ফৌজি?’

‘সেটা কি আমি আর পারি? তুমিই তো একবার বলেছিলে, আমি নাকি ভালোবাসার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছি।’

‘তুমি কাউকে ভালোওবাসো না, বিয়েও করো না। শুধু ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাইছ, যেমনটা নিয়েছ ক্যামেলিয়াকে।’

‘ক্যামেলিয়াই বরং আমার সঙ্গে গিয়েছিল।’

‘সে তো তোমার প্রেমে পড়েছিল, পড়েনি?’

‘মেয়েরা আমার প্রেমে পড়ে, এটা আমার দোষ?’

‘পোড়াকপালিরা তোমার প্রেমে পড়ে, ফৌজি।’

‘হতে পারে, যখন আমি তাদের প্রেমে পড়ি না।’

‘তুমি প্রেমে পড়ো!’

‘হ্যাঁ, পড়ি তো, মাঝেমধ্যে।’

‘আমার প্রেমেও কি কখনো পড়েছিলে?’

‘আবারও সেই পুরোনো প্যাঁচাল শুরু করলে? জানোই তো, নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। ফেরদৌসকে নিয়ে যাচ্ছি।’

‘না, তুমি ওকে নিচ্ছ না।’

‘নিচ্ছি।’

‘ভয় দেখাচ্ছ, ফৌজি? তোমার হুমকি-ধমকিতে আর ডরাই না। আমার পেছনে পুলিশও লাগাতে পারবে না। পুলিশ মহলে এখন তোমার চেয়ে আমার বেশি খাতির।’

‘আমাকে দেখে পুলিশের কাছে ছুটে যাওয়ার বান্দা মনে হয় নাকি? ওটা তো দুর্বলেরা করে। আমাকে তোমার সে রকম মনে হয়, শরিফা?’

‘কী বোঝাতে চাইছ?’

‘তুমি সেটা ভালো করেই জানো।’

‘আমাকে মারধর করবে, তাই তো?’

‘বহু দিন মার খাও না। মনে হচ্ছে, ভালো রকম একটা উত্তম–মধ্যমের জন্য মুখিয়ে আছ।’

‘আমার গায়ে হাত উঠলে আমিও ওঠাব, ফৌজি।’

‘ঠিক আছে। দেখা যাক কার জোর বেশি।’

‘একটা আঙুল ছুঁয়ে দেখো, তোমার পেছনে শাওকিকে লাগিয়ে দেব।’

‘শাওকিটা আবার কে? আরেক মরদ নাকি? তার প্রেমে পড়েছ? অতটা সাহস তোমার?’

দেয়াল ভেদ করে শরিফার উত্তর আর কানে এসে পৌঁছে না। হয়তোবা শরিফা খুব নিচু গলায় কথা বলছিল বলে শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিংবা আরও কিছু বলার আগেই ফৌজি হয়তো ওর মুখ চেপে ধরেছে। কারণ, কানে ভেসে আসে, কেউ যেন কারও মুখ হাত দিয়ে ঠেসে ধরছে আর তার পরপরই অনেকটা যেন গাল চাপড়ানোর মতো শব্দ। এরপর ভেসে আসে একটানা কিছু চাপা শব্দ। বুঝতে পারি না, ওগুলো কি কারও গালে মৃদু চাপড়, নাকি জোরপূর্বক চুমু খাওয়ার শব্দ।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই শরিফার প্রতিবাদ কানে আসে: ‘না, ফৌজি, না!’

ফৌজি ক্রুদ্ধ সাপের মতো হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘না, না কী আবার, মাগি?’

তাদের শরীরের নিচে বিছানাটি ককিয়ে ওঠে। আবারও শরিফার কণ্ঠ শুনতে পাই—লাগাতার হেঁচকির সঙ্গে একই প্রতিবাদ।

‘না, ফৌজি। দোহাই লাগে। এভাবে না, এভাবে না!’

দেয়াল ভেদ করে আবার ফৌজির হাঁপ–ধরা, ক্রুদ্ধ হিসহিসানি ভেসে আসে। ‘কী বলিস বেটি? কীভাবে না, আর কিসের দোহাই?

তাদের দুজনের শরীরের ভারে বিছানার ক্যাঁচক্যাঁচানি বাড়তেই থাকে। জড়াজড়ি, ধস্তাধস্তি ও দুটো শরীরের বারবার আলাদা হওয়া ও ফের আছড়ে পড়ার শব্দ বাড়তে বাড়তে, দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে হতে উন্মত্ত রূপ ধারণ করে বিছানা লন্ডভন্ড করতে থাকে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে হাঁপ–ধরা জন্তুর মতো বিছানাটি খটখটাতে থাকে। হাঁপানি আর ঝাঁকুনি যেন মেঝেতেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দেয়ালে। আমার খাটটি পর্যন্ত উন্মত্ত তালে যোগ দিয়ে কাঁপতে থাকে।

একপর্যায়ে সেই প্রবল ঝাঁকুনি আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে মনে হয়, আমি যেন এক প্রলয়ের মধ্যে আচমকা জেগে উঠেছি। স্বপ্নের মতো চোখের সামনে ফৌজির মুখের ধোঁয়াটে অবয়ব ভেসে ওঠে। তার কণ্ঠ আমার কানে আবারও প্রতিধ্বনি তুলতে থাকে, ‘শরিফা তোমাকে বোকা বানিয়ে তোমাকে দিয়ে টাকাপয়সা কামিয়ে নিচ্ছে।’

তখন শুনতে পাই, শরিফা বলছে, ‘আমার গায়ে হাত ওঠালে আমিও…।’

আমি চোখ মেলে তাকাই। বিছানাজুড়ে আমার শরীরটি ছড়িয়ে আছে। পাশে কোনো পুরুষ নেই। কামরাজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও শূন্যতা। পা টিপে টিপে শরিফার ওখানে গিয়ে দেখি, শরিফা নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে, পাশে ফৌজি। আমি আবারও পা টিপে টিপে নিজ কামরায় ফিরে হাতের কাছের জামাটি গায়ে চাপিয়ে ছোট্ট ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে, দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়ি। (চলবে)


ফারহানা আজিম শিউলী: কানাডার টরন্টোপ্রবাসী

ধারাবাহিক এই উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন