কচ্ছপ-কাহিনি

ছোটবেলায় চপচপ (৫ এপ্রিল ২০১৯ তোলা ছবি)
ছোটবেলায় চপচপ (৫ এপ্রিল ২০১৯ তোলা ছবি)

কচ্ছপের নাম চপচপ। বেশির ভাগ সময় পানিতে থাকে। মাঝেমধ্যে পানির ওপর উঠে আসে শ্বাস নেওয়ার জন্য।

‘বন্ধু কী করো’—এই প্রশ্নের জবাবে আমরা অনেক সময় মজা করে বলে থাকি ‘বাতাস খাই’।

কথাটা মজা করে বললেও ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। আমরা সব সময়ই বাতাস খাই। কিন্তু বাতাসের মাঝে থাকি বলে সেভাবে বুঝতে পারি না অথবা আলাদাভাবে বলার দরকার পড়ে না।

চপচপের জন্য ব্যাপারটা আলাদা। তাকে বাতাস খাওয়ার ব্যাপারটা আলাদাভাবে মনে রাখতে হয়।

এ–সম্পর্কিত একটা ঘটনা বলি। চপচপের সাঁতার কাটার সঙ্গী হিসেবে ট্যাংকে কিছু মাছ রেখেছি। মাছগুলোকে সে মাঝেমধ্যে লাঞ্চ আর ডিনার হিসেবে তাড়া করে। একদিন দেখলাম, সে একটা মাছের পেছনে ট্যাংকের এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে লাঞ্চ করার উদ্দেশে। যে মুহূর্তে সে মাছের নাগাল পেল, অমনি সে রণেভঙ্গ দিয়ে পানির ওপরে চলে এল। বাতাস খাওয়ার জন্য। ব্যাপারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের পোষা কচ্ছপের গল্প এটি। আগেই বলেছি তার নাম চপচপ। এই নামের একটা কাহিনি আছে। প্রথম যখন কচ্ছপটা নিই, তখন তার কোনো নাম ছিল না। তার বাসাও ছিল না। আমাদের বাসার কর্তৃপক্ষ, মানে আমার সহধর্মিণী এই কচ্ছপ বাসায় নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। বলেছে, কচ্ছপ বাসায় আনলে সে গৌরব দাদাকে দাওয়াত দিয়ে কচ্ছপ দিয়ে ডিনার করাবে।

এ জন্য কচ্ছপকে আমার অফিসে রাখতে হয়েছে এক সপ্তাহের মতো। এই এক সপ্তাহে অফিসের সবাই এসে তাকে দেখে আর জিজ্ঞেস করে তার নাম কী। ভাবলাম নাম তো একটা রাখা দরকার। অফিসের সহকর্মীদের কাছ থেকে নামের পরামর্শ নিলাম। সুন্দর সুন্দর নাম প্রস্তাব করলেন তাঁরা। কিন্তু কোনোটাই মনে ধরেনি। এর মধ্যে বাসার কর্তৃপক্ষ কচ্ছপকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিল।

এক বিকেলে আমি কচ্ছপের জন্য সদ্য কেনা অ্যাকুয়ারিয়াম সাজাচ্ছিলাম আর প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে শামীমের (কর্তৃপক্ষ) সঙ্গে কথা বলছিলাম। শামীম তখন আমাদের বিকেলের নাশতা হিসেবে আলুর চপ বানাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম পিচ্ছি কচ্ছপটা তো দেখতে পুরোই আলুর চপ। তখন ভাবলাম এর নাম রাখব চপচপ। বেগুনি আর আলুর চপ, চপচপ দ্য কচ্ছপ। পরে আমার বন্ধুদের আলুর চপ খাইয়ে কচ্ছপের নামের আকিকা দিয়েছিলাম।

চপচপের সঙ্গে ইরিনা
চপচপের সঙ্গে ইরিনা

চপচপ ন্যাশভিলে খুব বিখ্যাত। বিশেষ করে পিচ্ছিদের মধ্যে চপচপের জনপ্রিয়তা সবকিছুর ওপরে। আরাফাত ভাই আর হানি আপুর মেয়ে উরশিয়া চপচপকে খুব পছন্দ করত। সে একদিন চপচপের একটা ছবি এঁকে দিয়েছিল আমাকে। কুয়েটের সিনিয়র ইকবাল ভাই আর সহকর্মী জোহরা আপুর মেয়ে ইরিনার বেড়াতে যাওয়ার প্রিয় জায়গা ছিল আমাদের বাসা। সে এসে চপচপকে খুব যত্ন করে খাবার খাওয়াত। ইরিনা নাকি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ডে-কেয়ারে না গিয়ে চপচপের বাসায় আসার জন্য বায়না ধরত।

চপচপের সবচেয়ে বড় ফ্যান হলো আহিয়ান। আমার বন্ধু রনির ছোট ছেলে আহিয়ান। আহিয়ান আর তার বড় ভাই আহনাফ যতক্ষণ বাসায় ছিল তার ৯০ ভাগ সময় চপচপের প্রশংসা করে কাটিয়েছে। দুই বছরের একটু কমবয়সী আহিয়ান খুব সুন্দর করে ‘হ্যালো’ বলে আর চপচপকে ধরার চেষ্টা করে। চপচপ তো ধরা দেয় না। কিন্তু পানিতে আহিয়ানের হাতটা ভিজে যায়। পরে সেই ভেজা হাত মুখের ওপর দিয়ে আহিয়ান বলে, ওয়াশ ইওর ফেস।’ প্রতি দুই মিনিট পরপর রনি অথবা ভাবি এসে আহিয়ানের হাত মুছে দেয়। ব্যাপারটা খুবই উপভোগ্য।

অন্যদিকে, আবুধাবি থেকে হিমা আর উমাইর দুই দিন পরপর শামীমকে ফোন করে চপচপকে দেখার জন্য। ওদের দাবি হলো, ফোনটা সব সময় অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে ধরে রাখতে হবে। দেশ থেকে আমার ভাতিজি নিমরা ফোন করে আর বলে চপচপকে নিয়ে যেন দেশে চলে যাই। এটা ওর লাগবে।

বড়দের মধ্যেও চপচপের জনপ্রিয়তা তেমন খারাপ না। যে–কেউ আমাকে ফোন করলে আগে চপচপ কেমন আছে জিজ্ঞেস করেন। পরে আমাদের খবর নেন। তাঁদের মধ্যে বড় ভাই রনি (তিনি আরেক রনি। এখানকার দুজন বড় ভাইয়ের মধ্যে রনি ভাই একজন) আর শাহনাজ ভাবি অন্যতম। রায়কা আপু হলেন চপচপের জেনুইন ফ্যান। তিনি আলাবামা থেকে বেড়াতে আসবেন বলছেন চপচপকে দেখতে। চপচপের আরেকজন আন্তরিক ফ্যান হলেন নাফিস। তিনি সম্প্রতি দেশে গিয়েছিলেন বেড়াতে। আসার সময় ব্যাগে করে ফিটকিরি নিয়ে এসেছেন যাতে চপচপের ট্যাংকের পানি পরিশোধনে সুবিধা হয়।

উল্লেখ্য, আমেরিকাতে কোনো দোকানে ফিটকিরি খুঁজে পাইনি। এখানে মনে হয় শেভ করে কেউ কখনো মুখে ফিটকিরি মাখেনি।

যা হোক, এবার আসি চপচপের খাবার–বৃত্তান্তে। খাবারদাবারের বেলায় চপচপ খুব খানদানি। সে সবজি খায় না। কত চেষ্টা করলাম। চপচপ উভচর প্রাণী, জাতের নাম ‘পন্ড স্লাইডার’। এরা বেশির ভাগ সময় পানিতে থাকে। ভালো সাঁতার কাটতে পারে। জলজ উদ্ভিদ আর ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে। ইন্টারনেট ঘেঁটে এই তথ্য বের করলাম। ভাবলাম, ভালোই তো হলো তাহলে। রান্নাবান্নায় কত শাকসবজি থাকে, চলে যাবে ঝামেলা ছাড়া।

সাঁতার কাটার সঙ্গীদের সঙ্গে চপচপ
সাঁতার কাটার সঙ্গীদের সঙ্গে চপচপ

কিন্তু বাস্তবে সে সবজি খায় না। শাকও খায় না। দোকান থেকে কিনে আনা ‘স্টিক’ খায়। তখন মনে হলো, চপচপেরও মানুষের মতো কিছু স্বভাব আছে। দোকানের খাবার বেশি ভালো লাগে।

তো বাসায় আনার মাস খানেক পরে একদিন মনে হলো সে খুব একা। একাকিত্বের কারণে হয়তো জীবনের ওপর বিরক্তি চলে আসছে তার। এই একাকিত্ব দূর করতে দোকান থেকে পাঁচটা গোল্ডফিশ কিনে এনে অ্যাকুয়ারিয়ামে দিলাম। ভাবলাম একসঙ্গে সাঁতার কাটবে। মাঝেমধ্যে খিদে লাগলে একটা-দুইটা খাবে।

প্রথম দিনেই চপচপ দুটি মাছ খেয়ে ফেলেছিল। মজার ব্যাপার হলো, দুটি মাছই লম্বায় চপচপের চেয়ে বড় ছিল। চপচপ তখন খুব ছোট ছিল। দেড় ইঞ্চি হবে হয়তো লম্বায়। পরদিন আরেকটা। শেষে বাকি দুটি মাছের একটা মান্না আরেকটা উড়শিয়াকে দিয়ে দিয়েছিলাম।

চপচপ এখন অনেক বড় হয়েছে। লম্বায় ৪ ইঞ্চি। ভাবলাম অনেক দিন তো সে মাছ খায়নি। আমি আর শামীম গিয়ে চপচপের জন্য উপহারস্বরূপ ২০টি ছোট মাছ নিয়ে এলাম এসল্যান্ড সিটি থেকে। ট্যাংকে দেওয়ার পর ২০টা মাছের মধ্যে দুটি বাকি ছিল। বাকি মাছগুলো প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শেষ করেছিল চপচপ। বলেছিলাম না, মানুষের কিছু স্বভাব ওর মধ্যে আছে। মেজবানে গেলে সবাই একটু বেশি খায়।

এখন চপচপের ট্যাংকে পাঁচটা মাছ আছে। তিনটা গোল্ডফিশ আর দুটি ছোট মাছ। অনেক দিন ধরেই আছে। বন্ধু হয়ে গেছে। এখন আর খেতে চায় না। খেতে চাইলেও মাছেরা বুঝে গেছে কখন দৌড়াতে হবে, কীভাবে দৌড়াতে হবে। চপচপের মতো শামীমও এখন বদলে গেছে। প্রথমে সে তো চপচপকে বাসায় আনার বিরোধিতা করেছিল। আর এখন সে নিয়মিত চপচপকে খাবার দেওয়া হয়েছে কি না, তার তদারকি করে।