নষ্ট বাচ্চা নাকি নষ্ট সমাজ

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

একজন নারী মা হবেন। তাঁর সন্তান এই সুন্দর পৃথিবীতে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাবে। সুস্থ থাকবে। এটাই সবার কামনা।

কিন্তু আমরা যা চাই, তা কি সব সময় পাই? বিধাতার চাওয়া থাকে হয়তো অন্য রকম।

একটি শিশু মাতৃগর্ভ অথবা তার বাইরে আসার পরও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারে বিভিন্ন কারণে। এমনটি যে কারও ক্ষেত্রে হতে পারে। কিন্তু আমরা কি জানি, ওই শিশুটি বিদায় নেওয়ার পর সেই পরিবারের ওপর বিভিন্ন মানুষের কথার ঝড় কতটুকু বয়ে যায়?

আমাদের দেশে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। ঘরে ঘরে এখন মাস্টার্স পাস করা ছেলেমেয়ে পাওয়া মামুলি ব্যাপার। কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের কতটা মনের দিক থেকে বড় করেছে, সেটি চিন্তার বিষয়।

প্রকৌশলে পাস করার পরই দেশে আমার চাকরির অভিজ্ঞতা হচ্ছে শিক্ষকতা। এই শিক্ষকতা করতে গিয়ে অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয়। দেশে ও দেশের বাইরে তারা খুব ভালো অবস্থায় আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মোটামুটি সবার সঙ্গেই যোগাযোগ আছে।

কয়েক দিন আগে মালয়েশিয়ায় বসবাসরত আমার এক ছাত্রীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার নজরে আসে। স্ট্যাটাসটি পড়ে আমার মনে খুব দাগ কাটে।

মেয়েটি মা হতে চলছিল। সবার মতোই নতুন একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। অনাগত সন্তানের জন্য পছন্দমতো কিছু নামও হয়তো ঠিক করে ফেলেছিল। প্রতিটি মুহূর্তে স্বপ্নের জাল বুনে যাচ্ছিল সেই ছোট্ট মুখটি মনে করে। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। শিশুটি মাতৃগর্ভ ছেড়ে বাইরে আসার পরপরই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

এমনটি আমাদের যে কারও ক্ষেত্রে হতে পারে। শিশুর মা-বাবার তখন কী অবস্থা, সেটি হয়তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমরা মানুষ খুব আজব প্রাণী। কখনো কখনো আমরা বুঝিও না কাউকে কষ্ট দিচ্ছি কি না। অনেকেই হয়তো আবার ইচ্ছা করেই করি। আমাদের সমাজে একটি শিশু এ রকম মাতৃগর্ভ অথবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে, একটা প্রশ্ন আমরা কেন যেন করি, সেটি হচ্ছে ‘তোমার বাচ্চা নষ্ট হলো কী করে?’

‘নষ্ট বাচ্চা’ নামে একটি ট্যাগ দিয়ে দিই খুব সহজে। কিন্তু নষ্ট শব্দটি কতটা দাগ কাটবে সেই সময়ে সন্তানহারা মা-বাবার মনে, সেটি কি আমরা মনে করি?

সন্তানহারা আমার ওই ছাত্রীর সেই স্ট্যাটাস থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি।

‘মায়ের গর্ভে থাকা বাচ্চাটি কি কোনো খেলনা, নাকি মেশিন, যে গর্ভ অথবা পৃথিবীতে এসে মারা গেলে তাকে আমরা নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলি! পৃথিবীতে অনেক দিন বেঁচে থাকা কোনো মানুষের হায়াত শেষ হয়ে গেলে, মারা যাওয়ার বদলে কি আমরা বলি যে, অমুক “নষ্ট” হয়ে গেছে? বলি না তো তাই না? তাহলে মায়ের গর্ভে থাকা একজন বাচ্চার হায়াত শেষ হয়ে গেলে কেন বলি যে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে? সেও তো আমাদের মতো রক্তে-মাংসে গড়া, ছোট্ট ছোট্ট সব কটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়েই তৈরি ছোট্ট একজন মানুষ, তাই না?’

আমার মনে হয়, আমাদের নিজেদের কাছে প্রশ্ন করার সময় হয়ে গেছে। আমরা কি সত্যি মানবিকতা ধরে রাখতে চাই? আমরা কি সত্যি মানুষ হতে চাই? মেয়েটির স্ট্যাটাসে লেখা প্রতিটি লাইন যেন, আমাদের সেই প্রশ্নে চপেটাঘাত করে।

নষ্ট বলেই আমরা থেমে থাকি না। সন্তান হারানো সেই দম্পতিকে আমরা পরবর্তী সময়ে নানাভাবে মনে করিয়ে দিই সেই কথা। স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট শব্দটা ব্যবহার না করে আমরা যেন কোনো কথা বলতেই পারি না। আরও কিছু লাইন মেয়েটির স্ট্যাটাস থেকে লাইন না আনলেই নয়।

‘কোনো একটা দাওয়াত এ গিয়েছি,...আচ্ছা, তোমার বাচ্চাটা কীভাবে নষ্ট হলো? আমি ডিটেলস জানি না। একটু বলবা? বৈশাখ উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে গিয়েছি...আচ্ছা, তোমার কি কোনো সমস্যা ছিল? হরমোন টেস্ট করছিল ঠিকমতো? ফেসবুক মেসেঞ্জারে কেউ আমার খবর নিচ্ছেন, এর মধ্যে প্রশ্ন, Premature ছিল নাকি?...ফেসবুক মেসেঞ্জারে কারও সঙ্গে কথা বলছি অন্য কোনো বিষয়ে, হঠাৎ প্রশ্ন, আপনারা কি নিজেকে সামলে নিতে পারছেন? এ রকম হয়...আবার ট্রাই করেন।’

মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা কি তবে পেছনে হাঁটছি। মানবতায়, শুভবুদ্ধিতে আমরা কি কখনো সামনে এগিয়ে যাব না। এসব কিছুই যেন মনে একটি বড় প্রশ্ন আনে, আমরা কি ‘নষ্ট বাচ্চা’, ‘নষ্ট বাচ্চা’ বলতে গিয়ে নষ্ট সমাজকে প্রকাশ করছি না?

মানবতাবোধ, শুভবুদ্ধি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে দিক। নষ্ট সমাজের প্রতিনিধিত্ব যেন আমাদের কাউকেই না করতে হয়।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সাবেকুন নাহার তানিয়া।

ড. মুহিদুল ইসলাম খান: সিনিয়র লেকচারার, তালিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তালিন, এস্তোনিয়া।