বনঘেরা আসরে শিল্পী মোহাম্মদ সুলতান

ঘরোয়া আসরে শিশুশিল্পী অর্পিতা হাজরা
ঘরোয়া আসরে শিশুশিল্পী অর্পিতা হাজরা

গাছপালায় ঘেরা এক বাড়ি।

সেখানকারই আয়োজন। তড়িঘড়ি প্রস্তুতি সবার। শুনলাম, অতিথি আসছে। সত্যিই এসে গেল শিশুশিল্পী অর্পিতা হাজরা। বসে পড়ল। হাতে এল তাজা ফুল। হারমোনিয়াম এসে গেল সামনে। শিল্পী গাইল ভালো লাগার গান। তার আগে কথা।

শিল্পীর জন্মস্থান বাংলাদেশের নড়াইল। আলোচনায় আসেন দেশের বিখ্যাত শিল্পী মোহাম্মদ সুলতান। অনিবার্য এক নাম। মা অনুরাধা রায় সাহায্য করলেন অর্পিতাকে। সুলতান মঞ্চ তার প্রিয় পীঠ। অনুরাধা রায় ভিক্টোরিয়া কলেজ চত্বরের এ জায়গায় তিনি গান গেয়েছেন ও নেচেছেন।

কী যে আনন্দ! শিল্পীর জন্মদিনে বেলুন আর কবুতর উড়িয়ে উদ্বোধন করা হলো। প্রতিবছরই সুলতান মেলার আয়োজন করা হয়। শিশুরা নাচে, গায় ও চিত্রাঙ্কনে অংশ নেয়। অর্পিতা এর আনন্দ নেয় ষোলো আনা।

শেষ বয়সে সুলতান একটি দ্বিতল নৌকা নির্মাণ করেছিলেন। চিত্রা নদী ভ্রমণ করবে ছোটরা। প্রকৃতি ও জীবজন্তুর ছবি আঁকবে, এই উদ্দেশ্য থেকে। এটার নাম ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ।

নিজ বাড়ি নড়াইলে শিশুদের জন্য করেন একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিষ্ঠান। এই চারু পিঠ ছোটদের জন্য তীর্থস্থান। নন্দন কানন করেছেন। শিশুরা কাটায় সেখানে আনন্দময় শৈশব। প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, আর্ট স্কুল নিয়ে এই বাগান।

মায়ের সঙ্গে অর্পিতা হাজরা
মায়ের সঙ্গে অর্পিতা হাজরা

অর্পিতা গাইল, বিহুর এ লগন মধুর এ লগন। আকাশে-বাতাসে লাগালে।

আনন্দ আর ধরে না! চম্পা চামেলি ফুটেছে, তার গন্ধে ময়না তার ভাসছে।

তুষার দের কথা। বিশ্বজিৎ দাসগুপ্ত ও মৌ-এর কণ্ঠে গানটি শোনেন শ্রোতারা। আজ মনপ্রাণ উজাড় করে গাইলেন এই শিল্পী।

সুলতান কৃষক পুরুষের শরীরকে পেশিবহুল ও বলশালী করে এঁকেছেন। তেমনি কৃষক নারীকেও লাবণ্য ও শক্তির মিশেলে হাজির করেন ক্যানভাসে। আদিবাসীর বিয়ে বা এমন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুলতান গ্রামকে তুলে এনেছেন। গ্রামেই তিনি জীবনের ঠিকানা খুঁজে পান। নিজে বাঁশি বাজাতেন। এর সুর প্রকৃতি দিয়ে গাঁথা।

ময়নার কোমরবন্ধনী সুষমা দেয়। লাল ওড়নার আড়াল দিয়ে তাকালে অন্য রকম দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। একজন মনে করে, তাকেই খুঁজছে বুঝি! কন্যার মন ভরা যৌবন বিয়ের সাজে সবার মাঝে দ্যুতি ছড়ায়।

অর্পিতা গেয়ে চলেছে। ময়নার নাচ দেখে দর্শক আত্মহারা হয়ে পড়েন। সুলতান গ্রামের মহিমা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বাস করতেন, কৃষক রূপকার। গ্রামীণ জীবন কৃষক ও কৃষিকাজের মধ্যে আমাদের আত্মারা চলমান। তারাই ধারণ করেন আমাদের ঐতিহ্য।

অর্পিতা হাজরার সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তে কয়েকজন
অর্পিতা হাজরার সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তে কয়েকজন

নড়াইলের গ্রাম মুশুরিয়া। ওখানেই অর্পিতার জন্ম।

সন্ধ্যাকাল। গল্প থেমে থাকে না। মা অনুরাধাও ওখানকার আর এক গ্রাম টাবরার কন্যা। লোককবি বিজয় সরকারের নাম আসে। ক্ষণজন্মা এই মনীষীর জন্মস্থান ডুমরি। এরই পার্শ্ববর্তী গ্রাম।

ওই আসরে আরও শিল্পী গান গাইল। সবাইকে সুরে ভাসাল শুভ ও তূর্য। আবার জমবে মেলা বটতলা হাটতলা...। এমন আরও গান গাইল অর্পিতা।

অর্পিতার বাবা উৎপল হাজরার চাকরি নদী সংস্কার প্রকল্পে। সেই সুবাদে বেলেশ্বর সরকারি স্কুলে ভর্তি। শিল্পী এখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

আলো ঝলমল পরিবেশ। গান আর মিষ্টি খাওয়ার আনন্দ সবার। মিষ্টিময় হয়ে ওঠে অনুষ্ঠান। তাঁরা যেন শেষ করতে চান না। না মিষ্টি, না আসর। গানের আবহে তখনো আমরা। মুখে তাঁদের তৃপ্তির হাসি। আমারও মুগ্ধতা। ভাবি, আজকের অর্পিতারাই বাঁচিয়ে রাখবে সুলতানকে। গ্রামের এই আনন্দময় বনঘেরা আসরকে।