মুখচোরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রানু হাসপাতালে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আসার সময় আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল।

তার মুখচ্ছবি, চোখ বলছিল, প্লিজ যেও না, আমার পাশে আজ থাক।

কিন্তু তা সম্ভব নয়। মা বলে দিয়েছেন, তুই পুরুষ মানুষ এখানে থেকে কী করবি, ডাক্তার, নার্সরা তো বারবার টহল দিয়ে যাচ্ছে। আর আসল ব্যথা উঠতে দেরি আছে। যা, সকালে তাড়াতাড়ি আসিস। বাচ্চা হতে কাল দুপুরও হতে পারে।

হুম, বাচ্চা, আমাদের প্রথম সন্তান। খুব খুশি লাগছে আমার। আবার কষ্টও লাগছে রানুর জন্য। বেচারি কষ্ট পাচ্ছে। সকাল থেকে রানু মুখ কালো করে ঘোরাঘুরি করছিল। মাঝে মাঝেই তার এমন খারাপ লাগছে। তাই অত মনোযোগ দিইনি। অফিসে চলে গিয়েছিলাম। বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা। খুব বেশি ট্রাফিক ছিল। এসেই দেখি সে বিছানায় ছটফট করছে। মাকে জানালাম।

মা বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, গাড়ি নিয়ে আয়।

–––

চলে এলাম রানুকে মায়ের সঙ্গে রেখে। কিন্তু ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছি। এত বড় খালি বিছানায় কোনোভাবে ঘুম আসছে না আমার।

রানু প্রতি রাতে খুবই সংকোচের সঙ্গে তার এক পা আমার পায়ের ওপর দিয়ে বলত, আপনার কি কষ্ট হচ্ছে? নামিয়ে ফেলব?

আমি বলতাম, না, ঠিক আছে।

: আসলে কোনোভাবে রেখে আরাম পাচ্ছি না।

: ঠিক আছে রাখ, সমস্যা নেই।

: আপনার ভারী লাগলে বলবেন।

: হুম।

: ঘুমিয়ে পড়েছেন?

: না, কিছু বলবে?

জানতে চাইতাম।

: না।

রানু আরও কিছু বলত হয়তো। আমার নির্লিপ্ততা হয়তো ওকে থামিয়ে দিত। আমি খুব ভালো বক্তা নই। দুই–এক কথার পর কী বলব বুঝতে পারি না। চুপচাপই থাকি বেশি। কিন্তু রানু কথা বলতে পছন্দ করত, বুঝতে পারি।

মাঝেমধ্যে আমার থেকে লুকিয়ে কী সব লিখতও।

ওর লেখার কথা মনে পড়ায় উঠে বাতি জ্বালালাম। রাতে ভালো খাওয়া হয়নি। খিদেও লেগেছে প্রচুর। রানুর জন্য রাখা বিস্কুট আছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই এনেছি।

খিদেয় কষ্ট পেত। মুখ ফুটে বলেনি কোনো দিন। লজ্জা লাগত মনে হয়। হয়তো আমার স্বভাবের কারণেই সে অত বেশি সহজ হতে পারে না আমার সঙ্গে।

কয়েক দিন আগে বারবার উঠছে–বসছে। লাইট জ্বালাল। পানিও খেয়ে এল নাকি জানাল।

: এমন করছ কেন? ঘুম আসছে না? খারাপ লাগছে? মাকে ডাকব?

জানতে চাই।

: না, না।

ওর জবাব।

: তাহলে?

: খিদে লেগেছে।

: কিছু খেয়ে আস।

: লজ্জা করছে, পানি খেয়েছি।

: লজ্জা কিসের?

: প্রতিদিন খিদে লাগে এখন।

পরদিন আমি টিনসহ বিস্কুট পাওয়া যায়, তা এনে রাখলাম আলমারির ওপর। কিছু বললাম না।

অনেক রাতে উঠে দেখি, রানু বসে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। আহারে বেচারি, কত দিন ধরে যে খিদেয় কষ্ট পাচ্ছিল!

আমাকে জাগতে দেখে হেসে বলে, থ্যাংক ইউ।

আমি একটু মুচকি হেসে পাশ ফিরে শুলাম।

এখন উঠে আমিও বিস্কুট খাওয়ার জন্য নিলাম, রানুর কথা মনে পড়ল আবার।

ওরও কি খিদে লাগেনি? মায়ের সামনে খেতে বেচারির নিশ্চয় লজ্জা লাগবে। ফোন করব নাকি, জিজ্ঞেস করব? না, থাক, আমারও লজ্জা করছে।

ড্রয়ার খুলে দেখলাম, একটা ডায়েরি। প্রথম পৃষ্ঠা ওলটাতেই লেখা—‘প্রিয় বান্ধবী রানুর শুভবিবাহে আমার ক্ষুদ্র উপহার। শুভেচ্ছাসহ ভালোবাসায়—সাবিহা।’

তারপর রানুর হাতের লেখা। প্রায় সব লেখাই আমাকে ঘিরে। তার আগে তার প্রিয় সব জিনিসের তালিকা। একেবারে ধাপে ধাপে রচনা করে লেখা।

প্রিয় ফুল: টকটকে লাল গোলাপ।

প্রিয় পাখি: হলদে পাখি।

প্রিয় ফল: আম।

প্রিয় রং: লাল।

প্রিয় লেখক: হুমায়ূন আহমেদ।

প্রিয় কবি: জীবনানন্দ দাশ, পূর্ণেন্দু পত্রী।

একদম শেষে লেখা, প্রিয় মানুষ: কবির

অর্থাৎ, আমি!

কীভাবে? আমার মতো রসকষহীন মানুষ কীভাবে তার প্রিয় মানুষের জায়গা দখল করে নিতে পারে। আমি তো ঠিকমতো নিজের আবেগ অনুভূতিও প্রকাশ করতে পারি না। সবকিছুতেই আমার সংকোচ, কী এক লজ্জা বাধা হয়ে এসে দাঁড়ায়।

তারপর শুরু করলাম রানুর ডায়েরি পড়া।

মানুষটা এত মুখচোরা কেন? খুব ইচ্ছে করে সময়ে–অসময়ে তাকে একটু জড়িয়ে ধরি। বিশেষ করে তার ছুটির দিনে, বৃষ্টির দুপুরে।

আর এখন রাতে। শরীর ভারী হওয়ায় কখনোই আরাম করে শুতে পারি না, কখনো তার গায়ের ওপর পা তুলে দিই। ভয়ও করে, সংকোচও, সে কিছু ভাববে নাতো!

জিজ্ঞেস করলে, ঠিক আছে বলে। কিন্তু বলে না যে, ইচ্ছে হলে ভালোভাবে জড়িয়ে ধর কিংবা দুই পা তুলে দাও।

কখনো সেও তো জড়িয়ে ধরতে পারে, তা না!

সে যখন কাজে চলে যেতে বের হয়, ইচ্ছে করে বলি, আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে যাও। নয়তো বলি, এদিকে এসো, তোমার কপালে একটা চুমু খাই, একটু নিচু হও তো...বলা হয় না। তার গাম্ভীর্য, আমাকে বাধা দেয়।

কখনো ইচ্ছে করে তার হাতটি ধরে ছাদে হাঁটি। শাশুড়ি মা তো সারাক্ষণ আমাদের পাহারা দিয়ে নেই। তিনি তো সন্ধ্যায় তাঁর রুমেই বেশি থাকেন।

আজকাল একটু বেশিই খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, সারাক্ষণ সে ফোন করে জানতে চাইবে, আমার কেমন লাগছে, কিছু খেতে মন চাইছে কি না।

রাতে ইচ্ছে করে আমার বাবুসোনাটা পেটে কেমন সুন্দর নড়াচড়া করছে, সে তা হাত দিয়ে বারবার দেখুক। পেটে কান ঠেকিয়ে শুনুক, বাবু কী বলছে, লজ্জায় কিছু বলা হয় না তাকে।

কিন্তু, কাল লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে খিদে লাগার কথা বলে ফেললাম। সকালে দেখি সে বিস্কুট এনে রেখে দিল আমার জন্য, কী যে ভালো লেগেছে!

ওকে খুব তুমি করে বলতে ইচ্ছে করে। নিজে থেকে একবারও বলছে না কেন, বছর পেরিয়ে গেল। আর কত আপনি আপনি করবে?

আপনি সম্বোধন কেমন পর পর লাগে আমার!

এরপরও, অপেক্ষায় বসে থাকি, কখন তার ছুটি হবে, কবে বাসায় এসে কলিং বেল দেবে, আর আমি দৌড়ে দরজা খুলে দেব।

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং সে প্রতিদিনই আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। যেন জানতে চায়, সব ঠিক আছে তো? তুমি ভালো আছ?

আমার ঠোঁটের কোণে তখন বিশ্বজয়ী হাসি।

আমার খুব ভালো লাগে তার এই চাহনি।

সারা দিনের ক্লান্তি, অসুস্থতা নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। আমি প্রাণবন্ত হয়ে পড়ি। তখন ভাবি, সব কথা মুখে না বললেও চলে!

কিন্তু কয়েক দিন ধরে দুঃস্বপ্ন দেখছি বারবার। মনে হচ্ছে মরে যাব। কিন্তু মরতে ইচ্ছে করছে না। আমার সোনাবাবুকে কী আমার দেখা হবে না?

কবিরের সঙ্গে কল্পনা করা ইচ্ছেগুলো কী পূরণ করতে পারব না?

আর কিছু লেখা নেই। এসব লেখাও একসঙ্গে নয়, একেক দিন কিছু কিছু করে লেখা।

হঠাৎ রানুর জন্য বুকে খুব কষ্ট হতে লাগল। ঘড়ি দেখলাম। একটা বাজে। এমন কিছু রাত নয়।

রাতে কিছু রিকশা পাওয়া যায়। বেশি ভাড়া দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে একটা ফুলের দোকান থেকে তাজা টকটকে লাল গোলাপ ফুল নিলাম কয়েকটা।

অনেক কষ্ট করে কৈফিয়ত দিয়ে ঢুকলাম হাসপাতালে।

দেখি রানু তখনো জেগে। তার ব্যথা নাকি বাড়ছে আর কমছে।

আমাকে দেখে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কষ্টের পরিবর্তে সেখানে হাজারো সুখ খেলা করছে। এখন না এলে তার এই সুন্দর স্বর্গীয় মুখ আমার কখনোই দেখা হতো না।

মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জেগে উঠেই বললেন, কিরে বাবু তো এখনো আসেনি, ফুল কেন!

আমি আবারও লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইলাম। আর ভাবছি, মনে মনে নিশ্চয় রানু ডায়েরিতে লিখছে, অবশেষে মুখচোরা মানুষটা মানুষ হলো!
–––

ফারহানা বহ্নি শিখা: পশ্চিম লন্ডন, যুক্তরাজ্য।