হে মহাদেবী ভক্তি-শক্তি-বিবেক জাগ্রত করো

দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা নিয়ে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: দীপু মালাকার
দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা নিয়ে সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: দীপু মালাকার

সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির জীবনে এক ভালো লাগার সকাল আসে শরতের প্রাক-প্রত্যুষে। মশারির ভেতরে আধো ঘুম আধো জাগায় মনে হয়, ঠাকুর ঘরে বসে আছে জগৎ সংসার। হৃদয় আকাশে জাগরিত হোন জ্যোতির্ময়ী। মোহাবিষ্ট হয়ে মর্ত্যের মানুষ শোনে জগম্মাতার আগমন বার্তা।

শারদীয় দুর্গোৎসব শুরুর ইতিহাস থেকে আজকের ইউনেসকোর তালিকায় বাঙালির প্রধানতম উৎসব হয়ে ওঠার পেছনে কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে শারদ প্রাতের ঘুমভাঙানিয়া আকাশবাণীর। বাণী কুমারের অসাধারণ গ্রন্থনা, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের চিরন্তনী সুর, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অনবদ্য স্বরক্ষেপণ ও ভরাট কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর কালিমা মুছে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে।

১৯৩২ সালে নাম ছিল প্রত্যুষ প্রোগ্রাম। এর পরের বছর নাম হয় মহিষাসুর বধ। ১৯৩৭ সালে এ অনুষ্ঠানের নাম হয় মহিষাসুর মর্দিনী। সেই সময় থেকে এই সময়, ৮৭ বছর ধরে যিনি মাতৃত্বের প্রতি আমাদের দায়টুকু জাগিয়ে তোলেন ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির’। মনে হয় ওই বুঝি মা এলেন। আকাশবাণীতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ডাক দিলেই তবে পুজোর দিন গণনা হয় শুরু।

কয়েকটা দিন কাটে কল্পনার কাশের বনে। কমবেশি সবাই হাতড়ে দেখি স্মৃতির ঝাঁপি। কুলকুল বয়ে চলা নদীর পাশ দিয়ে ঘেঁষা আমার ছোট্ট বাজার। ছেলেবেলার ছেলেখেলার আনন্দের পারাপার। শরৎপুর গ্রামের কাশবনে কত দিন হেঁটেছি আনমনে। স্কুল পালানো দুপুরে কুমোর পাড়ায় দেখতে যেতাম ঠাকুর গড়া।

মনে আছে, বাঁশি পাল নিবিষ্ট মনে হাতের ছোঁয়ায় গড়তেন দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী। ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা লগ্নে। চষে বেড়িয়েছি পাশের গ্রামগুলোতে ১০৮টি স্থলপদ্মের আশায়। আর ঘরে ফিরে শিউলি তলায় শিশির ভেজা পায়ে দাঁড়ানো ‘মা’। সনাতন ধর্মাবলম্বী অনেক বাঙালির ‘আমার পুজোয়’ এই গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে।

দেশ ছেড়ে আসার আগে, কী জানি কী ভেবে মায়ের সঙ্গে একখানা ছবি তুলেছিলাম শিউলি তলায়। অভিবাসী জীবনে পুজো আসে, পুজো যায়। দেশের সুনীল আকাশের অস্তগামী সূর্য কোনো একদিন, বিদায়ের শেষ ক্ষণে এই দূরদেশে আমার হৃদয় আকাশের পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে গেছে রক্তিম আভা। তত দিনে শিউলি মালা হয়ে মায়ের ছবিতে।

ঘর মন্দিরের মা এখন হৃদয় মন্দিরে থাকেন। শরীর পুড়ে যায়, স্মৃতিরা বেঁচে থাকে। বছর ঘুরে পুজো আসে, মহালয়ার ভোরে গঙ্গার ধারে কিংবা প্রবাসের কোনো মন্দিরে পূর্বপুরুষদের তর্পণে ব্যস্ত; বৈতরণিতে বিশ্বাসী মানুষের ভিড়। আমি ও আমার মতো যারা, তাদের আশ্রয় দেন রবীন্দ্রনাথ। ‘আশ্বিনে আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে, পুজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে’। মায়ের উদ্দেশে দুই ফোঁটা চোখের জলে দর্পণ দিই।

শরৎ এলেই মাতৃশক্তির পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে ওঠে, কল্পলোক-রূপলোক-ভাবলোকে। আনন্দের ঝরনাধারায় ধুইয়ে দেয় প্রকৃতির মলিনতা, মনের অন্ধকার হয় আলোকিত। আনন্দময়ীর আগমনে আমরা মিলিত হই প্রাণের উৎসবে। এই উৎসব নিজেরা আবার বাঙালি হওয়ার উৎসব। এই উৎসব ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসার। এই উৎসব ‘সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে’ সবার মঙ্গলে অঞ্জলি দেওয়ার পূজা; নিজের জন্য নয়।

অথচ আজ অতিরিক্ত আড়ম্বরে সেজে ওঠেন দুর্গতিনাশিনী। লাখ টাকার চালা বেঁধে, একে অন্যকে টপকে যাওয়ার ঘোরে, পাশের বাড়ির চালবিহীন চালাটি আমাদের নজর কাড়ে না। ভারাক্রান্ত শরীর আর ক্লান্ত চোখে, ভেসে বেড়ানো ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের মতো দুশ্চিন্তার ভেলা, জীবনযুদ্ধে একলা পথ চলা পাড়ার সেলাই দিদিমণি; তাঁর চোখে কেমন দেখতে? শরতের আগমনী। প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে থিমের পূজায় কত স্পটলাইট, আছে হয়তো অনেক বার্তা; আমাদেরই অনাদরে ভাসান হয়েছে আন্তরিকতা।

ধরণির বুকে রক্তবীজ থেকে আজও জন্ম নেয় হাজারো-লাখো রক্তাসুর। ঘরে-বাইরে, বিদ্যাপীঠে, রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে; দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা দাপিয়ে বেড়ায়। আমার-আপনার ঘরের দুর্গা নিরাপদ নয় সাধু-সন্ত কিংবা আলেমের আস্তানায়। দায় আমাদের যাদের গর্জে ওঠার, সব সয়ে যাই নিচু মাথায় আসলে সব সওয়া হয়ে যায়।

হারিয়ে গেছে আশ্বিনের নদী। কাশবন। ফুরিয়ে যাচ্ছে জল। হারিয়ে গেছে বিশুদ্ধ হাওয়া। মরীচিকার দামে বিকোয় ভালোবাসা। ভুলতে বসেছি প্রতিবাদের ভাষা। বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা আর জাত-ধর্মের নামে অসুরেরা রক্তাক্ত করে চলছে মানবতা।

স্বর্গের অসুর পীড়িত দেবতা রক্ষণে যে রণদেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি নিত্য, তাঁর আদি নেই, তাঁর প্রাকৃত মূর্তি নেই, এই বিশ্বের প্রকাশেই তাঁর মূর্তি। তাঁর মহাতেজ চীর জাগরুক আগুন হয়ে কখনো-কখনো জ্বলে ওঠে মাটির পৃথিবীর নারী শক্তির মধ্যে। সেই দুর্গাই দিল্লির নারী কমিশনার স্বাতি মালিয়ালা। যিনি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করিয়ে তবে অনশন ভাঙেন। সেই দুর্গাই অগ্নিলোচনা মেধা পাটেকার। যিনি মণিপুরে নগ্ন মিছিলে হেঁটেছিলেন। সেই দুর্গা কন্যা সাহসিকা নুসরাত সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদ।

ত্রিশূল হাতে স্বর্গের দুর্গাই মর্ত্যের আঁধার ছেঁড়া আলো অগ্নি বর্ণা গ্রেটা থুনবার্গ। যেন মোম হয়ে তারায় অমাবস্যার আঁধার; এঁকে দেয় লক্ষ্মণরেখা। ‘পৃথিবী জেগে উঠছে, পরিবর্তন সমাগত, তুমি পছন্দ করো আর না-ই করো’। এরাই ভবিষ্যতের আশাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে সেই দুর্গাই আবির্ভূত হোন আশ্বিনের উষালগ্নে। ‘হে মহাদেবী, তোমার উদ্বোধনে বাণীর ভক্তি রসপূর্ণ বরণ কোমল আলোক শতদল মেলে বিকশিত হোক দিক-দিগন্তে; হে অমৃত জ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণি হোক প্রাণময়ী’।

দেশে-প্রবাসে মন্দিরে-মন্দিরে প্রতিমার ধ্যানবোধিতায়, প্রার্থনা থাক। আমাদের ভক্তি-শক্তি-বিবেক জাগ্রত হোক।
---

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: সাংস্কৃতিক কর্মী।