শূন্য বিন্দুতে নারী - সাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তখন রাত। নিকষ কালো রাত। আকাশে চাঁদের অস্তিত্ব নেই। প্রচণ্ড ঠান্ডা শীতের রাত। শহরের পথঘাট জনমানবশূন্য, বাড়িঘরের জানালা-দরজার কপাট শক্ত করে আটকানো যাতে একটু বাতাসও না ঢোকে।

এই ঠান্ডায় প্রায় শরীর দেখা যাওয়া ফিনফিনে পোশাকে হেঁটে চলছি, কিন্তু কিছুই টের পাচ্ছি না। চারপাশ ঘন অন্ধকারের চাদরে মোড়া, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তবু মনে কোনো রকম ভয় নেই।

রাস্তাঘাটের কোনো কিছুরই সাধ্য নেই আমাকে আর ভয় পাওয়ায়। শীতেরও সাধ্য নেই আমার গায়ে কামড় বসায়। আমার শরীর কি পালটে গেল তাহলে? আমাকে কি অন্য নারীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে? তাহলে আমার, মানে নিজের শরীর গেল কই?

হাতের আঙুল খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। এগুলো তো আমারই আঙুল, একটুও বদলায়নি। সেই একই লম্বা-সরু আঙুল। একবার এক লোক বলেছিল, এমন আঙুল নাকি সে জীবনেও দেখেনি। বলেছিল, আঙুলগুলো দেখতে ভীষণ সবল ও চতুর। এগুলোর নিজস্ব ভাষাও আছে। আঙুলে চুমু খেলে এগুলো নাকি তার সঙ্গে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত, যা সে প্রায় শুনতে পেত। ভেবে আমার হাসি পায়। আঙুল কানের কাছে আনি, কিন্তু কিছুই শুনতে পাই না।

আবারও হেসে উঠি, কিন্তু এবারে হাসির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। নিস্তব্ধ রাতে নিজের হাসির শব্দে নিজেই চমকে উঠি। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক দ্রুত দেখে নিই। কেউ আমাকে একা একা হাসতে দেখলে নির্ঘাত ‘আব্বাসিয়া মানসিক হাসপাতালে’ তুলে নিয়ে যাবে। প্রথমে কিছুই চোখে পড়ে না, কিন্তু পরমুহূর্তে আবছা দেখি, এক পুলিশ অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে আসছে।

একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে, আমার কবজি পাকড়াও করে সে বলে, ‘যাচ্ছ কই?’

‘জানি না।’

‘যাবে আমার সঙ্গে?’

‘কোথায়?’

‘আমার বাসায়।’

‘না...পুরুষের ওপর আমার আর বিশ্বাস নেই।’

আমি হাতের ছোট ব্যাগটা খুলে তাকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেটটি দেখাই। বলি, চাকরি খুঁজছি, মাধ্যমিক বা প্রাথমিক সার্টিফিকেট একটা দিয়ে হলেই হলো। আর এগুলোতেও যদি চাকরি না জোটে, তাহলে অন্য যেকোনো কাজ করতেও রাজি।

সে বলে, ‘আমি তোমাকে পয়সা দেব। ভেব না মাগনা চাইছি। আমি অন্য পুলিশের মতো না। কত চাও, বলো?’

‘কত চাই? জানি না তো।’

‘ন্যাকামি কোরো না, আর দরাদরিও করতে এসো না। একদম থানায় ধরে নিয়ে যাব।’

‘কেন? আমি তো কিছু করিনি।’

‘তুমি একটা বেশ্যা। তোমার মতো বেশ্যাদের গ্রেপ্তার করে দেশ সাফসুতরো করা, আর তোমাদের হাত থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো রক্ষা করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমি জোর খাটাতে চাইছি না। আমরা বোধ হয় ঝুটঝামেলা ছাড়াই একটা সমঝোতায় আসতে পারি। এক পাউন্ড পাবে: একটা আস্ত পাউন্ড। কী বলো?’

আমি ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাই, কিন্তু সে আমার হাত শক্ত করে ধরে এগোতে শুরু করে। আমাকে একের পর এক অন্ধকার সরু গলির ভেতর দিয়ে হাঁটিয়ে, একটি কাঠের দরজা পার করিয়ে একটি কামরায় নিয়ে গিয়ে বিছানায় জোর করে শুইয়ে দেয়। সে নিজের কাপড়চোপড় খুলে ফেলে।

আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। টের পাই, আমার ওপর চেপে বসা সেই পরিচিত ভার, নোংরা নখের আঙুলগুলোর আমার শরীরজুড়ে সেই পরিচিত বিচরণ, হাঁপ ধরা শ্বাসপ্রশ্বাস, বোটকা আঠালো ঘাম, খাট-মেঝে আর দেওয়ালের ক্রমাগত ঝাঁকুনি—সারা পৃথিবীটাই যেন বনবন করে ঘুরছে।

চোখ মেলে তাকাই। কোনোমতে শরীর বিছানা থেকে টেনে তুলি। গায়ে জামা চড়াই। বেরোনোর আগে ক্ষণিকের জন্য মাথাটা—আমার ক্লান্ত মাথাটা—দরজায় ঠেকাই।

শুনতে পাই পেছন থেকে সে বলছে: ‘কিসের অপেক্ষায় আছ? আজ সঙ্গে পয়সা নেই। পরেরবার পাবে।’

সরু অলিগলি ধরে হেঁটে চলি। তখনো রাত। হিম হাওয়া বইছে। একটু পর বৃষ্টি শুরু হলে পায়ের নিচের ধুলাবালু কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। বাসাবাড়ির সামনে আবর্জনার স্তূপ, আর পচা-দুর্গন্ধ চারদিক থেকে আমাকে চেপে ধরতে চাইছে, গ্রাস করতে চাইছে, তলিয়ে দিতে চাইছে। আমার হাঁটার গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে—দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার আশায়, এই গলিঘুপচি পেরিয়ে যে কোনো এক পিচঢালা রাস্তার খোঁজে, যেখানে আমাকে অন্তত কাদায় পা ডুবিয়ে হাঁটতে হবে না।

বড় রাস্তায় যখন পৌঁছাই, তখনো মাথার ওপর অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। একটি যাত্রীছাউনিতে আশ্রয় নিয়ে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মাথা-মুখ-চোখ মুছতে শুরু করি। হঠাৎ করে সাদা আলো চোখে এসে পড়ে। প্রথমে ভাবি, আমার সাদা রুমাল থেকে বুঝি। কিন্তু রুমাল সরানোর পরও আলোটা বাসের হেডলাইটের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ভাবি, ভোর হয়ে গেছে, হয়তোবা বাস চলাচল শুরু হয়েছে। কিন্তু দেখি, ওটা বাস না, একটা গাড়ি, হেডলাইট আমার দিকে তাক করে দাঁড়ানো।

এক লোক নেমে দ্রুত গাড়ির কোনা ঘুরে এসে আমার সামনের দরজাটি খুলে ধরে, মাথা মৃদু নুইয়ে, নম্র গলায় বলে: ‘বৃষ্টিতে না ভিজে, ভেতরে বসো।’

আমি তখন শীতে কাঁপছি। চুপচুপে ভেজা ফিনফিনে জামা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। স্তন প্রায় স্পষ্ট, কালো বৃত্তের মতো বোঁটা দুটো বোঝা যাচ্ছে। আমি গাড়িতে ওঠার সময় সাহায্য করার ছলে সেগুলোতে হাত দিয়ে সে চাপ দেয়।

তার বাসার ভেতরটি বেশ উষ্ণ। সে আমার গায়ের জামা ও কাদা মাখানো জুতো জোড়া খুলে নিয়ে সাবান ও গরম জল দিয়ে আমার সারা শরীর ধুইয়ে দেয়। তারপর কোলে করে বিছানায় নিয়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করি। টের পাই, বুক-পেটের ওপর নেমে আসা ভারী ওজন, সারা শরীরে আঙুলের বিচরণ। নখগুলো কিন্তু পরিষ্কার ও সুন্দর করে কাটা, ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসে সুগন্ধ, আর ঝরতে থাকা আঠালো ঘামেও দুর্গন্ধ নেই।

চোখ মেলে দেখি, সূর্যকিরণে স্নান করছি। আশপাশে তাকাই। সব অপরিচিত ঠেকে। শুয়ে আছি আলিশান কামরায়, সামনে এক আগন্তুক দাঁড়িয়ে। দ্রুত উঠে ঝটপট জুতা, জামা পরে নিই। ছোট্ট ব্যাগটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সে হাত বাড়িয়ে ১০ পাউন্ডের একটি নোট আমার আঙুলের ফাঁকে গুঁজে দেয়। সে আমার সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, আমি যেন প্রথমবারের মতো ঠিকঠাক দেখতে পাই।

আঙুলের ফাঁকে আঁকড়ে ধরা ১০ পাউন্ডের নোটের স্পর্শ মনে করিয়ে দেয় সেদিনটির কথা, বাবা যেদিন প্রথম আমার হাতে একটি পয়সা গুঁজে দিয়েছিলেন এবং যা ছিল একান্তই আমার। আর তক্ষুনি এক লহমায় সব রহস্য কেটে গিয়ে শাশ্বত সত্যটি আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাবা এমনিতে কখনোই টাকাপয়সা দিতেন না। ঘরে-মাঠে খেটে, বাবার উচ্ছিষ্ট খেয়ে, আমার আর মায়ের দিন কাটত। আর উচ্ছিষ্টও না জুটলে খালি পেটে রাত কাটত। এক রোজার ঈদের দিন, বাচ্চাদের মিঠাই কিনতে দেখে আমি মায়ের কাছে গিয়ে ভীষণ কান্না জুড়ি, ‘একটা পিয়াস্তার চাই।’

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কি পয়সা থাকে? বাবার কাছে যাও।’

আমি তা-ই করি। তিনি এক ধাক্কায় আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কাছে পিয়াস্তার নেই।’

কিন্তু পরমুহূর্তেই ডেকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে, মরে যাওয়ার আগেই যদি মহিষটা বেচে একটা গতি করতে পারি, তাহলে পিয়াস্তার পাবে।’

এরপর থেকেই দেখতাম, তিনি মহিষটির আয়ু আরও কিছুদিন বাড়াতে, দোয়াদরুদ পড়ছেন। কিন্তু কিছু করে ওঠার আগেই সেটি পটল তোলে। ঈদের বাকি সময়টায় তাঁর দোয়াদরুদ থেমে যায়, আর মা তাঁকে কিছু বলতে গেলেই রীতিমতো ফুঁসে উঠে মারধর শুরু করেন। কয়েকটা দিন চুপচাপ থাকি, পয়সা চাই না।

কিন্তু কোরবানি ঈদ এলে দোকানের সামনে থরে থরে সাজানো মিঠাই দেখে ফের তাঁকে গিয়ে বলি, ‘একটা পিয়াস্তার চাই।’

এবারে তিনি বলেন, ‘সাতসকালে উঠেই পয়সা চাওয়া? আগে যাও, পশুপাখির খোঁয়াড় পরিষ্কার করো, গাধার পিঠে গোবর চাপিয়ে মাঠে নিয়ে যাও। দিন শেষে পয়সা পাবে।’

মাঠের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে সেদিন কিন্তু সত্যি সত্যিই একটা পিয়াস্তার পাই। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া জীবনের প্রথম পিয়াস্তার, যে পিয়াস্তার একান্তই আমার। আমি সেটি হাতের তালুতে রাখি, আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরি, মুঠিবদ্ধ করি। এই পিয়াস্তার বাবারও না, মায়েরও না, এই পিয়াস্তার ‘আমার’। এটি দিয়ে যা খুশি তা-ই করতে পারি, যা খুশি তা-ই কিনে খেতে পারি—মিঠাই, ক্যারবদানা, কটকটি, যা মন চায়।

সেদিন ছিল উজ্জ্বল, সূর্যস্নাত। আমি দ্রুত অনায়াস কদম ফেলে এগিয়ে চলি। ডান হাতের মুঠোয় কিছু একটা আঁকড়ে ধরা অতি মূল্যবান কিছু। একটি পিয়াস্তার না, আস্ত একটি ১০ পাউন্ডের নোট। জীবনে এই প্রথম এত বড় নোট হাতে পাওয়া। সত্যি বলতে, এ রকম নোটের স্পর্শ এই প্রথম। এই হঠাৎ স্পর্শ আমার শরীরজুড়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। দেহের গভীরে মোচড় অনুভব করি, ভেতরে কিছু একটা লাফিয়ে ওঠে, শরীরটিকে প্রায় যন্ত্রণাদায়ক প্রবল ঝাঁকুনি দিচ্ছে যেন। নাড়িভুঁড়ির কোনো পুরোনো ক্ষত যেন দপদপিয়ে উঠছে। পিঠ টান করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা দম নিলে ব্যথাটা চিড়চিড়িয়ে ওঠে। সেটি ধমনিতে রক্তের দপদপানির মতো কাঁপুনি দিয়ে পেটে উঠে আসে। বুকের গরম রক্ত ঘাড় বেয়ে, গলা পেরিয়ে, উষ্ণ-তাজা লালার স্রোত হয়ে এক সুখানুভূতির স্বাদে আমার মুখ ভরিয়ে দেয়। স্বাদটি এতই তীব্র যে অনেকটা তেতো ঠেকে।

একটি কাচের পার্টিশনের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার ঢোঁক গিলতে থাকি। ওপাশে জ্বলন্ত উনুনে মুরগি ঝলসানো হচ্ছে। শিকের ভেতর মুরগি ধীরে ধীরে ঘুরছে, জ্বলন্ত শিখা মুরগিগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে—একদৃষ্টে সেসব দেখতে থাকি। রোদ পেতে জানালার পাশের টেবিল বেছে নিই, আর মোটাসোটা একটি ঝলসানো মুরগি দিতে বলি। শান্ত হয়ে বসে ধীরেসুস্থে খেতে শুরু করি। প্রতিটি কণা ভালো করে চিবিয়ে গেলার আগে প্রতিটি গ্রাস অনেকক্ষণ ধরে মুখে রেখে, তারিয়ে তারিয়ে স্বাদ উপভোগ করতে থাকি। বাচ্চারা যেমন মুখ ভর্তি করে মিষ্টি খায়, আমারও তেমনি খাবার দিয়ে মুখ ঠাসা। খাবার তো দারুণ সুস্বাদুই, কিন্তু আরও বেশি যেন মধুর হয়ে উঠছিল—অনেকটা ছেলেবেলায় প্রথম নিজের পয়সায় কেনা কটকটির মতো। কটকটি আগেও খেয়েছি, মা মাঝেমধ্যে কিনে দিতেন। কিন্তু সেবারই প্রথম—দোকানের অন্য সব মিঠাই থেকে নিজের খুশিমতো বেছে নিয়েছিলাম। সেবারই প্রথম—নিজের পয়সায়।

ওয়েটার আমার টেবিলে ঝুঁকে খাবারের প্লেটগুলো রাখে। খাবার ভরা প্লেট সে আমার দিকে এগিয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু তার নজর এদিকে না। আমার প্লেটের দিকে তার এই না-তাকানো, আমার চোখের সামনে ঝুলে থাকা পর্দা চিরতরে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে দিব্যদৃষ্টি খুলে দেয়। জীবনে এই প্রথম একজোড়া শাণিত চোখ হিসাব রাখছে না—আমি কী খেলাম, কতটুকু খেলাম। জন্মাবধি যে চোখ দুটি সদা উপস্থিত, সদা সতর্ক—অপলক দৃষ্টিতে আমার প্লেটের প্রতিটি খাবারের কণার হিসেব রাখত।

সামান্য একটি কাগজের টুকরো সবকিছু এতটা বদলে দিতে পারে? আমি কেন আগে বুঝিনি? এতগুলো বছর ধরে বিষয়টি আমার চোখ এড়িয়ে গেল? না। আসলে ভেবে দেখলাম, আমি একেবারে শুরু থেকেই ব্যাপারটি জানি। জন্মের পর প্রথম যখন চোখ খুলে বাবার দিকে তাকিয়েছি, তখন থেকেই শুধু চোখে পড়ত তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত, আঙুলগুলো তালুতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আছে। মুঠো কখনো শিথিল হতো না, হলেও তালুতে কী যেন একটা রয়েই যেত—চকচকে, গোল। বিশাল-কর্কশ আঙুল দিয়েও খুব আলতোভাবে তা তিনি নাড়াচাড়া করতেন, আর কখনো সযত্নে কোনো মসৃণ পাথরের ওপর ফেললে সেটি টুং করে একটি শব্দ তুলত।

আমি তখনো রোদে বসে। ১০ পাউন্ডের নোটটি আমার ব্যাগে, খাবারের দাম তখনো মেটানো হয়নি। টাকা বের করতে ব্যাগ খুলি। ওয়েটার টেবিলের সামনে এসে খুব নম্রভাবে মাথা নিচু করে, টেবিল থেকে প্লেটগুলো সরাতে থাকে। তার নজর আমার ব্যাগের দিকে না। পুরো সময়টুকুই সে অন্য সবকিছু দেখছে, কিন্তু যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যাগটি এড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমার ১০ পাউন্ডের নোট রাখা। এমন দৃষ্টি আমি আগেও দেখেছি—এমন আধবোজা চোখ, আড়চোখে আমার হাতের দিকে তাকানো।

মনে পড়ে যায় স্বামী শেখ মাহমুদের কথা। নামাজের রুকুতে গিয়ে সে এভাবেই আমার প্লেটের দিকে তাকাত। আরও মনে পড়ে বইয়ের ওপর সরু চোখে চাচার চোখ বোলানো, আর পেছন থেকে আমার ঊরু হাতড়ে বেড়ানো তার হাত। ওয়েটার তখনো আমার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়ানো। তার চোখ আধবোজা, কিন্তু চোখে সেই একই চোরা চাহনি। আমার হাতে ১০ পাউন্ডের নোট। সে এক চোখের কোনা দিয়ে নোটটি দেখে কিন্তু আরেক চোখ অন্য দিকে, নারীদেহের নিষিদ্ধ কোনো অঙ্গ থেকে যেন সচেতনভাবে চোখ ফিরিয়ে আছে। আমি ভাবনায় পড়ে যাই। তবে কি আমার হাতে ধরা ১০ পাউন্ডের নোটটি ব্যভিচারের সুখের রোমাঞ্চকর অনুভূতির মতোই অবৈধ ও নিষিদ্ধ?

ওয়েটারকে প্রায় বলতে যাই, ‘কে বলল ১০ পাউন্ডের নোট একটা নিষিদ্ধ জিনিস?’ কিন্তু তা না বলে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকি। কারণ, সত্যি বলতে, এর উত্তর বহু আগে থেকেই আমার জানা—সেদিন থেকে, যেদিন বাবার কাছে প্রথম হাত পেতেছিলাম একটি পয়সার জন্য এবং বাড়ি মেরে তিনি হাত সরিয়ে দিয়েছিলেন। এই শিক্ষা আমি জীবনে বারবার পেয়েছি। একদিন বাজারে পিয়াস্তার হারিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরে মায়ের মার খেতে হয়েছিল। চাচা মাঝেমধ্যে পয়সাকড়ি দিলেও পই পই করে নিষেধ করে দিতেন, মায়ের কানে যাতে না যায়। টাকা গোনা অবস্থায় আমি আসছি টের পেলেই চাচি অন্তর্বাসের ভেতর টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলতেন। আমার স্বামী প্রতিদিনই টাকা গুনতে বসত, কিন্তু আমাকে আসতে দেখলে একইভাবে সরিয়ে ফেলত।

শরিফাও পাউন্ডের আস্ত নোটগুলো গোনার সময় আমার গলার শব্দ পেলেই কোনো এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে ফেলত। তাই সময়ের সঙ্গে আমিও শিখে যাই—কেউ টাকা গোনার সময়, এমনকি পকেট থেকে দু-একটি পয়সা বের করার সময়ও কীভাবে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে হয়। টাকা যেন লজ্জার বস্তু, যা লুকিয়ে রাখতে হয়। যেন পাপের একটা কিছু, যা আমার জন্য নিষিদ্ধ কিন্তু অন্য কারও জন্য না, অন্যদের জন্যই শুধু যেন বৈধ। আমি ওয়েটারকে প্রায় জিজ্ঞেস করে বসি, এ নিয়ম কাদের বানানো? কে ঠিক করেছে কার জন্য এটি নিষিদ্ধ, আর কার জন্য বৈধ? কিন্তু কিছু না বলে আরও শক্ত করে ঠোঁট চেপে বসে থাকি। উল্টো বরং ১০ পাউন্ডের নোট বাড়িয়ে ধরি। সে মাথা নিচু রেখেই অন্য কোথাও যেন তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার কাছ থেকে নোটটি নেয়।

(উপন্যাসের বাকি অংশ পড়ুন প্রকাশিত বইয়ে।)


ফারহানা আজিম শিউলী: কানাডার টরন্টোপ্রবাসী

ধারাবাহিক এই উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1615616