বিপর্যস্ত এক পরকীয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আতহার আবাদির প্রবাসজীবন প্রায় এক যুগেরও বেশি।

সিরিয়ার আলেপ্পো শহর থেকে ভিজিটর ভিসায় প্রথমে আমেরিকা এসে সেখানে লিগ্যাল কাগজপত্র করতে না পেরে ইমিগ্রান্ট হয়ে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমায় কানাডায়।

আবাস্থল হিসেবে বেছে নেয় টরন্টো মেগা শহরের স্কারবোরো সিটিতে। কেনেডি রোড ও হাইওয়ে ৪০১-এর কাছে অ্যানট্রিম ক্রিসেন্টের এক ২০ তলা ভবনের অ্যাপার্টমেন্টে বাসা ভাড়া নেয়।

আতহার আবাদি অল্প শিক্ষিত সুদর্শন পুরুষ। তবে ছোটবেলা থেকে তাঁর দুটি ইস্যু ছিল। এক, খুব অল্প বয়স থেকে সে তাঁর নিজ মহল্লায় শুধু মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, মেলামেশা ও খেলতে পছন্দ করত। দুই, তাঁর চোখের সমস্যা ছিল সেই ছেলেবেলা থেকেই।

মায়োপিয়ার কারণে চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখত। এমনকি কাছের জিনিসও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেত না। চশমা লাগত সেই ছোটবেলা থেকেই। এই বয়সেও সারাক্ষণ তাঁর চোখে থাকে খুব পাওয়ারওয়ালা চশমা।

কমিউনিটির সবাই তাকে ‘চশমা আবাদি’ বলেই জানে। বিশেষ করে অল্পবয়স্ক ও বিবাহিত নারীরা তো তাই বলেই চেনে তাকে।

নারীদের সঙ্গে ভাব জমানো তার অনেক শখের মধ্যে একটি প্রিয় শখ। নিজের কমিউনিটির যেকোনো যুবতী, বিবাহিত বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে কথা বলতে তার কোনো দ্বিধা বা জড়তা লাগে না।

পুরুষদের সঙ্গে কথা না বললেও নারীদের সঙ্গে মেয়েলি ঢঙে তার হাই-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম অথবা মারহাবা বলা চাই। এহেন আচরণের কারণে অনেকে বলে থাকে, চশমা আবাদির লজ্জাশরমের বালাই নেই।

কিন্তু পেছনে কে কী বলল, তাতে তার কিছু যায়-আসে না। কোনো নারী দেখলেই হলো। ‘কিফিক’ অথবা ‘মারহাবা কিফিক হালাক’ বলবেই। মানে কেমন আছেন। তারপর আপু বা ভাবি বলে খাতির জমিয়ে ফেলে। ভাবখানা এমন যে কত দিনের চেনা।

বিবাহিত নারীদের সঙ্গে ভাব জমাতে তার আগ্রহ বেশি। একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলা তার কাছে এক চুটকির ব্যাপার মাত্র। সে নারী যত সুন্দরী বা দেমাগি বা মেজাজিই হোক না কেন, কোনো এক সম্মোহন বলে আতহার আবাদি সেই নারীর সঙ্গে নিমেষেই আলাপ জমাতে সক্ষম।

আতহার আবাদি কথা বলে খুব গুছিয়ে। কোন কথার সূত্র ধরে কীভাবে কোথা থেকে আলাপ শুরু করতে হয়ম তা তার খুব ভালো করে জানা।

আরব দেশ থেকে আসা কিছু মেয়ে ও নারীও কেমন যেন বোকার মতো তার সঙ্গে কথা বলতে বা আলাপ জমাতেও আগ্রহ দেখায়।

আতহার আবাদি বিবাহিত। এক কন্যাসন্তানের জনক। মেয়েটি ছোট। গ্রেড ওয়ানে পড়ে মাত্র। মেয়ের মা সহজ-সরল অতি সাধারণ একজন মানুষ। হাউস ওয়াইফ। আরব দেশীয় কায়দাকানুনে রক্ষণশীল ও পর্দানশিন। বাইরে খুব একটা বের হয় না। বের হলেও গায়ে কালো বোরকা সেঁটে ও মাথায় হিজাব দিয়ে বের হয়।

স্বামীর এহেন আচরণ বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে যেচে কথা বলে ভাব জমানোর বেহায়াপনা লোকমুখে শুনে থাকে। কিন্তু স্বামীকে এ ব্যাপারে কিছুই বলে না। সে মনে করে, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। আবার তা মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করে। সদাসর্বদা ঘরসংসার আর ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না। ইংরেজিতে কথা বলতে বা বুঝতে খুব অল্পই পারে। বিধায় কোনো কাজ করতে ঘরের বাইরে বের হয় না।

এ জন্য বাইরের সব কাজ আতহারকেই সারতে হয়। প্রতিদিনকার বাজারঘাট ছাড়াও আতহার আবাদি সকালে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যায়।

একদিন স্কুল কম্পাউন্ডে হঠাৎ গিয়ে চোখ পড়ে কালো স্কার্ফ মাথায় বেশ সুন্দরী অল্পবয়স্ক এক নারীর দিকে। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলতে শুনে আতহার আবাদি বুঝতে পারে যে তারাও আরব-দেশীয়।

আতহার ভাবে, এই এলাকায় নতুন বোধ হয়। তাই ছেলেকে স্কুলে দিতে এসেছে।

অ্যানট্রিম ক্রিসেন্ট এলাকা থেকে আরও দুই-চারজন অ্যারাবিয়ান নারীও বাচ্চা নিয়ে স্কুলে আসে। আতহার আবাদি তাদের দেখলেই ‘সাবাহ এল খায়ের’ বলে গুড মর্নিং জানায়। একই এলাকার বলে তারা সবাই চশমা আবাদিকে স্বভাবের জন্য খুব ভালো করে চেনে।

প্রবাসে সাধারণত একই ভৌগোলিক এলাকা থেকে আসা প্রবাসীদের মধ্যে আলাপ হয়। পরিচয় হয়। কথা হয়। চেনাজানা হয় সহজেই। একে অপরকে এই চেনাজানার সুবাদে এবং আতহার আবাদির মেয়েলিঘেঁষা স্বভাবের কারণে খুব সহজেই পরিচয় হয় ওই নতুন নারীর সঙ্গে।

লেবাননের বৈরুত থেকে আসা ওই নারীর নাম মারিয়াম হাদ্দাদি। এত দিন অন্য এলাকায় থাকত। এদিকে এসেছে গত সামারে। অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই বাচ্চাদের স্কুল বলে।

মারিয়ামের দেহ পাতলা গড়নের। খাড়া নাক। গায়ের রং উজ্জ্বল ফরসা। একটিই ছেলে। গ্রেড টুয়ে পড়ে। ছেলের বাবা দেশে ভালো জব করলেও এখানে তেমন সুবিধা করতে না পারায় এখন ট্যাক্সি ক্যাব চালায়। নগদ ডলার আয় করে। তার সুন্দরী স্ত্রী মারিয়াম হাদ্দাদি সেসব ডলার দুই হাতে খরচ করে বেড়ায়।

মারিয়াম হাদ্দাদি নিয়মিত বিউটি পারলারে গিয়ে রূপচর্চা করে। আরও সুন্দর দেখানোর জন্য ভ্রু-জোড়া ধনুকের মতো চিকন বানিয়ে মুখে ফেসিয়াল করে সাজে। চুল স্টেপ কাট করে। হাই লাইট কালারও করে। আর শপিং মলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। মাথায় ওড়না জড়ায় তবে হিজাব পরে না। টাইট জিনস আর খাটখাটো আঁটসাঁট জামা পরতে পছন্দ করে।

মলে মলে ঘুরে বেড়ানো যেন তার এক নেশা। একদিন ফেয়ারভিউ মলে তো পরের দিন ইয়র্কডেল মলে। নতুবা স্কারবোরো টাউন সেন্টারের মলে। কখনো আবার সাবওয়ে করে ডাউন টাউনের ইটন সেন্টার অথবা ভন মিলস পর্যন্ত চলে যায়।

ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র কেনে ক্যাশ ডলারে। মাইকেল কোর, প্রাডা, লুই ভিটন—এসব। সেপোরা থেকে দামি দামি মেকআপ কিটস। অযথা পয়সা খরচ করে।

স্বদেশীয় অন্য নারীদের সঙ্গে খুব অহংকারের গল্পও মারে। নিজেকে স্বামীসোহাগি বলে জাহির করে বেড়ায়। কিন্তু মনেপ্রাণে স্বামীকে পছন্দ করে না মারিয়াম হাদ্দাদি।

কারণ, স্বামী রাতে বাড়ি থাকে না। রাতের শিফটে ট্যাক্সি ক্যাব চালায় বলে সারা রাত বাইরে কাটায় সে।

প্রতিদিন মেয়েকে ড্রপ করার কারণে সকালে স্কুল চত্বরে মারিয়াম হাদ্দাদির সঙ্গে দেখা হয় কথা হয়। গল্পও হয় আতহার আবাদির।

এভাবে দিনে দিনে মারিয়ামের খুব কাছে চলে আসে সে। বাসার ঠিকানা, বাজ নম্বর থেকে শুরু করে সেলফোন নম্বরও পেয়ে যায় খুব সহজে। সোশ্যাল মিডিয়ার ফেসবুকেও ফ্রেন্ডশিপ গড়ে তোলে। উইকএন্ডে দিনের বেলায় স্বামী-ছেলেকে ঘরে রেখে মারিয়াম হাদ্দাদি আতহারের সঙ্গে বের হয় সংগোপনে। মলে মলে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখে। হলিউড বলিউডের মুভি।

মাঝেমধ্যে দুজনা মিলে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চও সারে। কোনো কোনো দিন আরব দেশীয় শিশা শপে গিয়ে হুঁকা টানে। আবার মারিয়াম হাদ্দাদি কখনোবা ডিনার খেয়ে অতিমাত্রায় ড্রিংক করে ঘরে ফেরে।

এভাবে চলতে থাকে আতহার আবাদি ও মারিয়াম হাদ্দাদির পরকীয়া, যা আস্তে আস্তে বড়ই গভীর ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

দুই. 

ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাতে মারিয়াম হাদ্দাদির খুব নিঃসঙ্গ লাগে। আতহার আবাদিকে তাই নিজের বাসায় আসতে ফোন করে আমন্ত্রণ জানায়।

বিশেষ করে প্রতি ফ্রাইডে নাইটে। কারণ তার স্বামী ফ্রাইডে নাইটে বাড়ি থাকেন না। ফ্রাইডে নাইটে ট্যাক্সি ক্যাবের ব্যবসা খুব রমরমাভাবে চলে। এ ছাড়া পরের দিন উইকএন্ডে স্ত্রীর হাতখরচ লাগবে শপিংমলে ঘুরতে। তাই সারা রাত ভীষণ ব্যস্ত থাকে মারিয়ামের স্বামী।

ক্যাশ ডলারের নেশা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই ডাউন টাউনের নাইট ক্লাবগুলোর সামনে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে নির্ঘুম চোখে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে প্যাসেঞ্জারের প্রতীক্ষায়।

ওদিকে মারিয়াম হাদ্দাদি টেক্সট করে আতহার আবাদিকে রাতে আমন্ত্রণ জানায় অ্যাপার্টমেন্টে আসতে। আর সে নিজে কোনো অন্তর্বাস ছাড়া এক হালকা–পাতলা স্বচ্ছ সাদা একটি নাইটি পরে নিজ বেডরুমে আতহারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

আতহার সময়মতো হাজির হয় সেখানে। সময় কাটায় মারিয়াম হাদ্দাদির সঙ্গে। মউজ–মাস্তি করে রাতের শেষ প্রহরের আগেই আতহার আবাদি নিজ গৃহে যখন ফেরে, তখন ভেতরে ঢুকে দেখে তাঁর স্ত্রী আবছা আলো–আঁধারে লিভিং রুমের এক কোনায় জায়নামাজে বসে প্রতি রাতের মতো তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে দুই হাত তুলে প্রভুর কাছে সব গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছে। দোয়া করছে সংসারের আয়–উন্নতির জন্য। পরিবারের বরকত ও রহমত লাভের জন্য। একমাত্র মেয়েটির জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য। স্বামীর মঙ্গল ও দীর্ঘায়ুর জন্য।

তিন.

গ্রীষ্মকালে এই প্রবাসের অভিবাসী ফ্যামিলিরা প্রায় দল বেঁধে শহরের উপকণ্ঠের বাইরে একটু দূরে ফ্রুট পিক করতে যায় নানান অর্চারড ও আপেলবাগানে। ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু এনজয় ও ফান করার উদ্দেশ্যে। তারপর ফ্রুট পিকিংয়ের আনন্দময় সব ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে দেশি বিদেশি বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে শেয়ার করে।

একদিন ফেসবুকে এমনই এক ফ্রুট পিকিংয়ের পোস্ট দেখে মারিয়াম হাদ্দাদির খুব সাধ জাগে ফ্রুট পিকিংয়ে যাওয়ার। সেও যেতে চায় শহরের বাইরে কোথাও কোনো এক নিরিবিলি আপেলবাগানে।

স্বামী সারা রাত ট্যাক্সি চালিয়ে দিনের বেলায় প্রায় সারাক্ষণই ঘুমান। তাই সে বায়না ধরে আতহার আবাদির সঙ্গে দূরের কোনো এক আপেলবাগানে যাওয়ার। দিনক্ষণও ঠিক করে।

একদিন প্রায় সোয়া ঘণ্টার ড্রাইভ শেষ করে দুজনে গিয়ে পৌঁছায় টরন্টো শহরের উত্তরে বেরি হিল ফ্রুট ফার্মে। বিশাল ফার্মের প্রবেশপথ থেকে ট্রাক্টর ট্রেলারে করে দর্শনার্থী ও পিকারদের নিয়ে যাওয়া হয় মূল বাগানে।

মাথায় ডোরাকাটা এক ওড়না প্যাঁচানো ও কালো রঙের সানগ্লাস পরিহিত মারিয়ামের মনে আজ খুবই আনন্দ। এই তাঁর প্রথম আপেলবাগানে আসা।

আতহার আবাদির হাত ধরে গুনগুন করে অ্যারাবিক গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যায় বাগানের অভ্যন্তরে। বাগান ভরা আপেলগাছে ঝুলন্ত সব আপেল দেখে সে পাগলপ্রায় হয়ে যায়।

আতহারের হাত ধরে এসে দাঁড়ায় আপেলবাগানের একদম শেষ সীমানার কাছে মাঝবয়সী একটা ছোট্ট গালা জাতের আপেলগাছের তলায়। অসংখ্য রঙিন গালা আপেল ধরে আছে গাছটির ডালে ডালে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল রঙের আপেলগুলো দেখতে কী যে সুন্দর! মারিয়াম হাদ্দাদির শুধুই হাত দিয়ে পাড়তে ইচ্ছা হয়।

চার.

বেরি হিল ফ্রুট ফার্ম প্রায় শত বছরের পুরোনো একটি ফ্যামিলি ফার্ম। প্রায় ৩০০ একরের ভূমির ওপর এই ফার্মে রয়েছে রাসবেরি, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরির খেত। কর্ন ফিল্ডসহ আছে চেরিগাছের বাগান। আছে কয়েক ভ্যারাইটির আপেলবাগান। মাঠজুড়ে আরও রয়েছে ভূমির ওপর সবুজ লতানো পামকিনের গাছ।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই বিশাল আপেলবাগানে বহুদিন ধরে বসবাস করছে দুই শয়তান ও এক শয়তানি। ওরা সম্পর্কে ভাই আর বোন। বড়, মেজ ও ছোট।

বড় ভাইটির নাম ইবলিস। মেজটি বোন। নাম ইসলিস। আর ছোটটিও ভাই। নাম তিবলিস। ইবলিস আর ইসলিস বড় ও ম্যাচিউরড। শয়তানের যা কাজ, তা–ই তারা করে বেড়ায় সারাক্ষণ।

সারা দিন লোকালয় চষে বেড়ায়। লোকদের ধোঁকা দিয়ে কুকাজ করায়। এলাকার মানুষকে বিভ্রান্ত করে বিপথে নিয়ে যায়। তারপর সন্ধ্যার দিকে বাগানে ফিরে আসে। রাত কাটায় সেখানে।

বড় দুজন মনুষ্যকুলকে ধোঁকা দিয়ে বিপথগামী করতে খুবই পটু। কিন্তু তিবলিস কেমন যেন আলসে ও ভিন্ন স্বভাবের। মানুষের মধ্যে যেমন ভালো–মন্দ দুই আছে, শয়তানদের মধ্যেও তা–ই।

তাই হয়তো তিবলিস কিছুটা ভালো গুণে গুণান্বিত। সে খুবই অলস প্রকৃতির। সারা দিন বাগানেই থাকে আর ঘুমায়। মাঝেমধ্যে দু-একটা ভালো কাজও করে ফেলে সে।

তিবলিসের আলসেমি ও তার ভালো কাজের জন্য বড় ভাই ইবলিস আর বোন ইসলিসের সঙ্গে প্রায় রাগারাগি, ঝগড়াফ্যাসাদ হয়। তবে শয়তানের জাত তো...তাই কেউ কাউকে তোয়াক্কা করে না।

তিবলিস সেদিন দুপুরে আলস্যে ঘুমঘুম চোখে ওই মাঝবয়সী গালা আপেলগাছটির ওপর শুয়ে ছিল। হঠাৎ গাছের নিচে দেখতে পায় আতহার আবাদি আর মারিয়াম হাদ্দাদিকে। খেয়াল করে তাদের চালচলন ও হাবভাব। এই দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক, তা যাচাই করার চেষ্টা করে। বোঝে এরা তো স্বামী স্ত্রী নয়।

তিবলিস বুঝতে পারে সামথিং রং। তক্ষুনি শয়তানদের অতি আধুনিক ইলেকট্রনিক সার্চ ইঞ্জিন ‘চুগল’-এ সার্চ করতে থাকে তিবলিস। প্রথমে আতহার আবাদির জন্মপত্র সার্চ করে। মুহূর্তেই দেখতে পায়, খুব ছোটবেলা থেকেই সে খারাপ প্রকৃতির। সেই ছোট্টবেলায় পড়শি শিশুমেয়েদের ফুসলিয়ে তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা করত সে। আর সুযোগ বুঝে সঙ্গী মেয়েদের চুমু খেত। স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলাত।

তিবলিস পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আরও দেখতে পায়, গ্রেড সিক্স থেকে আতহার আবাদি মেয়ে–আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। তারপর হাইস্কুল ও কলেজে উঠে কত যে অকাম–কুকাম করেছে, তা দেখে তিবলিসের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে।

এরপর মারিয়ামের জিনোম ঘাঁটতে থাকে। দেখে সেখানেও অনেক গোলমাল। স্কুলে ছিল তার বয়ফ্রেন্ড। কলেজে উঠে কয়েকবার বন্ধুর সঙ্গে সি রিসোর্টে রাত কাটায় মা-বাবার অজান্তে। একবার তো এক সপ্তাহের জন্য ভূমধ্যসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসের হোটেলে ভ্যাকেশন কাটিয়েছিল নতুন উড়তি বয়সীর এক বড়লোক ছেলেবন্ধুর সঙ্গে।

বিয়ের আগেও বেশ কয়েকজন পরপুরুষের সঙ্গে মিলন হওয়ার ঘটনা দেখতে পায় তিবলিস। এমনকি বিয়ের পরেও স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে বেশ কয়েকবার পরকীয়ায় পড়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিল বলে সার্চ রেজাল্টের রিপোর্টে তিবলিস দেখতে পায়।

শয়তান তিবলিসের অনেক গোস্‌সা হয় এসব দেখে। রাগে কটমট করে। চোখ বড় বড় গোল্লা বানায়। দাঁত খিঁচিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। ঠিক করে দুজনকেই চরম শায়েস্তা করবে আজ। প্রথমে ধরে আতহার আবাদিকে।

তিবলিস শয়তানের অদম্য শক্তির বলে বাতাসের সঙ্গে মিশে নিশ্বাসের সঙ্গে আতহার আবাদির শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর রক্তনালিতে গিয়ে মেশে। ভালোবাসা উদ্রেক করার হরমোন রক্তের ডোপামিন ও সেরোটোনিন হরমোনগুলো শূন্যের কোটায় নিয়ে আসে। পুরুষত্বের জন্য দায়ী প্রধান স্টেরয়েড হরমোন রক্তের টেস্টোস্টেরন আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে আনে। ফলে, হঠাৎ করে খারাপ বোধ হতে থাকে আতহার আবাদির। পানি পিপাসা লাগে। ভালোবাসা ভালো লাগা ফিলিংসগুলো নিমেষেই কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। মারিয়ামকে দেখে তাঁর আর কোনো আকর্ষণ বোধ হয় না। শরীরের ভেতরে খারাপ বোধ হতে থাকে। অন্তরে জ্বলন শুরু হয়।

এরপর তিবলিস মারিয়াম হাদ্দাদির নাক দিয়ে তার শরীরে ঢুকে হার্টে অবস্থান নেয়। শয়তান তিবলিস ধীরে ধীরে তার রক্তের এস্ট্রজেন লেভেল লো করে দিতে থাকে। ফলে, আকস্মিক পরিশ্রান্ত ও অবসাদগ্রস্ত মনে হতে থাকে মারিয়াম হাদ্দাদির। মনের ভেতর রাগ দানা বাঁধে। হঠাৎ রাগ হতে থাকে আতহার আবাদির ওপর। কিন্তু হঠাৎ কেন তা সে নিজেও বুঝতে পারে না।

তিবলিস শয়তান এরপর তার মস্তিষ্কে ঢোকে। মারিয়াম হাদ্দাদিকে অন্যমনস্ক, হিংস্র ও খুব অস্থির করে তোলে। পরপুরুষের সঙ্গে এই ধরনের ঘুরে বেড়ানো ও মেলামেশার সম্পর্কের বিষয়টা মারিয়াম হাদ্দাদির উপলব্ধি হতে থাকে নিজ থেকে। খারাপ লাগে তখন। কোত্থেকে একরাশ জিঘাংসা তার চোখমুখ ঠিকরে বের হতে থাকে। চোখ দুটি লাল হয়ে ওঠে।

নিমেষেই মারিয়াম রাগে গাছের একটা আপেল ছিঁড়ে সোজা আতহার আবাদির চোখ বরাবর ছুড়ে মারে। চশমার গ্লাস ভেঙে আতহার আবাদির চোখের পাতা কেটে রক্ত ঝরতে শুরু হয়।

আতহার আবাদি প্রথমে ভাবে, খুশিতে মজা করছে বোধ হয়। কিন্তু পরপর আপেল ছুড়ে মারতেই থাকে মারিয়াম।

আতহার জিজ্ঞাসা করে, আরে, হয়েছে কী?...রিল্যাক্স...চিল বেবি...।

সঙ্গে সঙ্গে মারিয়াম তুইতুকারি করে গালাগাল শুরু করে আতহার আবাদিকে। বাজে বাজে কথা বলতে থাকে। বলে, আমারে বেবি বলছিস কেন...গেট লস্ট...। চিৎকার দিয়ে বলে, গো ওয়ে ফ্রম মি...। চিল্লাতে থাকে, ‘খালাস’...‘খালাস’...বলে। মানে মর গিয়ে...দূর হ...এই হারামজাদা...তুই আমারে কই নিয়া আসছস...? এসব। আরও বলে ‘ইয়া ইবন এল শারমৌতা’...সান অব আ বিচ...তুই কে? ‘আইরে ফিক’...তোর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক...? চল আমি এখনই বাড়ি যাইতাম। আমারে আমার পোলার কাছে লইয়া যা।

ওদিকে তিবলিস দুজনের এই আচরণ দেখে খুব মজা পায়। সে মিটিমিটি হাসে।

মারিয়াম হাদ্দাদি এসব বলতে থাকে আর গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুড়ে মারতে থাকে আতহার আবাদির দিকে। আচমকা এ ধরনের আচরণে আতহার আবাদি অবাক ও বিস্মিত হয়ে পড়ে। হতবিহ্বল হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। খুব বিচলিত হয়ে পড়ে সে। হঠাৎ মারিয়ামের এ রকম পাগলামি তাকে ভীত করে তোলে।

ভাবগতি খারাপ দেখে অন্য কিছু না ভেবে তড়িঘড়ি করে সে মারিয়াম হাদ্দাদিকে নিয়ে নিজের হোন্ডা অ্যাকর্ডে গিয়ে বসে। ড্রাইভে গাড়িতে বসে কোনো কথা হয় না দুজনার। চোখাচোখিও হয় না।

আতহার আবাদি সোজা গাড়ি চালিয়ে মারিয়াম হাদ্দাদির অ্যাপার্টমেন্টের নিচে তাঁকে নামিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নেমে গট গট করে মারিয়াম হাদ্দাদি হেঁটে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে ফিরেও তাকায় না।

পরবর্তী সময়ে তাদের দুজনের বহুবার সামনাসামনি দেখা হয়ে চোখাচোখি হলেও কোনো দিনও আর কথা হয়নি।

আপেলবাগানে মারিয়াম হাদ্দাদির সেই আচমকা আচরণে বিপর্যস্ত হওয়ার রহস্য বেচারা আতহার আবাদির কাছে অজানাই রয়ে গেল।

রানা টাইগেরিনা: টরন্টো, কানাডা। ই–মেইল: <[email protected]>