বাংলাদেশে গবেষণার অন্তরায় ও উত্তরণ

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছরের বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের দেশের সামগ্রিক গবেষণার সূচক বা চাকা যাই বলি না কেন, তার গতি কিংবা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার হার কিন্তু বেশ হতাশাজনক।

কোনো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে নিজস্ব উদ্ভাবন বা গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, তাদের যেমন গবেষণা খাতে স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তেমনি গবেষণা করার জন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতেও তারা মনোযোগী হয়েছে।

জাপান, কোরিয়া, চীন কিংবা পাশের দেশ ভারতের দিকে যদি আমরা চোখ ফেরাই, দেখতে পাই তাদের গবেষণা কার্যক্রম একটা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেটাকে ক্রমাগত পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে।

সাধারণত একটা দেশের গবেষণার সূতিকাগার হিসেবে ধরা হয় সেই দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। মূলত সেখানে কর্মরত মেধাবী শিক্ষক ও গবেষকেরা এই গবেষণাপ্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া সব দেশেই বিশেষায়িত গবেষণার জন্য আছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে আরও নিবিড়ভাবে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা পরিচালিত হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে গবেষণা এগোচ্ছে না কেন? বলা যায়, দেশের একমাত্র কৃষিভিত্তিক কিছু গবেষণা (তাও বিভিন্ন ফসলের জাত ক্রস ব্রিডিং ও অবমুক্তকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ) ছাড়া তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক গবেষণা হচ্ছে না বললেই চলে। সুদীর্ঘকাল আগে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো ছাড়া তেমন কোনো গবেষণা এ দেশের মানুষের কাছে সরাসরি বিপুল পরিমাণ সাফল্য এনে দিতে পারেনি।

এ দেশের গবেষণার সংকটের পেছনে মূল কারণ হিসেবে বলা হয়, গবেষণা যাঁরা চালাবেন, সে রকম মেধাবী লোকজনের নিয়োগে নানা রকম বাধা কিংবা সংকট। আমাদের দেশের সরকারি পর্যায়ে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সরকারি গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুটা হলেও গবেষণা হয়। এ কারণে যাঁরা সত্যিকারের অর্থে গবেষণা করতে চান, তাঁদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এসব গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রক্রিয়া নানাবিধ কারণে যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতি, রাজনীতি, নিয়োগ–বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি কী নেই এখানে? তারপরও স্বল্পসংখ্যক হলেও বেশ কিছু মেধাবী লোকজন এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছেন এবং অনেক সময় কিছু নিয়োগও পান।

এই স্বল্পসংখ্যক মেধাবী লোকজন যখন দেখেন তাঁদের গবেষণার জন্য স্বীয় প্রতিষ্ঠানে কোনো বরাদ্দ থাকে না বা থাকলেও সেটা বেশ অপ্রতুল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণা অনুদানের পরিমাণ যেটা সরকার বিভিন্ন সময়ে আবেদনের মাধ্যমে দিয়ে থাকে, সেটার আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে।

এটা একটা দেশের জন্য বেশ হতাশাজনক, যখন দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের বিভিন্ন কাজের জন্য গবেষণা কিংবা উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ রাখে না। স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বেশ কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো কিছুটা অর্থ বিভিন্ন রকম গবেষণা জরিপের কাজে ব্যবহার করে। তেমনি কৃষি ফসল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো সে রকম কিছু গবেষণা বরাদ্দ রাখে।

তবে দেশের সীমিত গবেষণার অনুদান থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে দেশের বাইরের বিভিন্ন সংস্থার কাছে গবেষণা বরাদ্দের জন্য আবেদন করা। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখনো বাংলাদেশ গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দকারী বিভিন্ন সংস্থার কাছে সম্ভাব্য দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকে। কাজেই সেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা যায়।

লেখক
লেখক

কিন্তু দেখা যায়, বাংলাদেশের গবেষকদের মধ্যে এই রকম আবেদন করে গবেষণা তহবিল সংগ্রহের ব্যাপারে নিতান্তই অনীহা কাজ করে। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, যে এই কারণের জন্য তারা এই ধরনের আবেদন করতে চান না। ধারণা করা যায়, মূলত গবেষণা মূল্যায়নের অভাব ও গবেষণাসংস্কৃতি না গড়ে ওঠার কারণে এই ধরনের বিদেশি যৌথ গবেষণা সে রকমভাবে গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশে গবেষণা না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি কাজ করে সেটি হলো, গবেষণাসাফল্যকে কোনো রকম সমীক্ষা বা মান যাচাই কিংবা মূল্যায়ন বিশেষত পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেকটা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এটা খুব দুঃখজনক, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত একজন গবেষকের স্কোপাস অন্তর্ভুক্ত (ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর) সংবলিত জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের জন্য কোনো বাড়তি পয়েন্ট কিংবা ক্রেডিট হিসেবে দেখা হয় না।

আবার অনেক সময় দেখা যায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে একজন গবেষক বা শিক্ষকের স্কোপাস অধিভুক্ত আর্টিকেলের চেয়ে তথাকথিত প্রিডেটরি জার্নাল বা কোনো অখ্যাত অনলাইন জার্নালে টাকার বিনিময়ে প্রকাশ করা প্রবন্ধের সংখ্যাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এটা অনেকটা হাস্যকর যে বাংলাদেশে জার্নালের মানের চেয়ে আর্টিকেলে সংখ্যাকে অনেকে জাহির করতে পছন্দ করেন এবং সমাজে তারা নিজেদের কাজের মান সম্পর্কে একটা বায়বীয় ধারণা দিতে সক্ষম হন। তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন মানসম্পন্ন গবেষক তাঁর গবেষণার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। যখন দেখবেন তারই সহকর্মী একাধিক প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ দিয়ে তার থেকে আগেই পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন। মূলত এই ধরনের গবেষণা বৈরী পরিবেশই বা সংস্কৃতি এ দেশে নতুন গবেষক সৃষ্টি করতে বাধা হিসেবে কাজ করে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ কোথায়? সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অভিন্ন নীতিমালা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এই নীতিমালায় অনেকগুলো সমস্যা আছে। যেমন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যেমন সমান না, তেমনি সব বিষয়ের জন্য একই ধরনের নীতিমালা হওয়াটা কিছুটা অসুবিধার উদ্রেক করবে।

তবে শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্কোপাস অধিভুক্ত ও ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর–সংবলিত জার্নালের প্রকাশনা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষত সহকারী অধ্যাপক থেকে পরবর্তী ধাপগুলোর ক্ষেত্রে। যা কিছুটা হলেও দেশের গবেষণা পরিবেশকে উন্নততর করবে। এর ফলে কিছুটা হলেও (পদোন্নতির জন্য হলেও) সবার মধ্যে মানসম্পন্ন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে চাপ ও আগ্রহ দুটোই বাড়বে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক উপকৃত হবে, কারণ তাঁরা শিক্ষাজীবনে কিছুটা হলেও মানসম্মত গবেষণাকে চাক্ষুষ দেখতে পারবেন ও গবেষণার মৌলিক ধাপগুলো সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হবেন।

অবশ্য, এই একটি পদক্ষেপ নিয়ে দেশের গবেষণার মানকে রাতারাতি আমূল পরিবর্তন করা যাবে না। এর সঙ্গে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মানসম্মত গবেষণা প্রবন্ধের মূল্যায়ন, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের আরও যৌথ গবেষণার অংশীদারির ভিত্তিতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক দায়বদ্ধতার মতো তাদের আয়ের একটি অংশ যেন গবেষণা অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, সে বিষয়ে একটি নতুন নীতিমালা চালু করা সত্বর প্রয়োজন।
–––

ড. আরিফিন সন্ধি: পানিসম্পদ প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ও ভারী মৌলদূষণ গবেষক। ই–মেইল: <[email protected]>