রূপান্তর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঠিক এই রকম দুপুরে তার পুরোনো আটপৌরে জীবন ফেরত পেতে ইচ্ছে করে। গরমে কাহিল হয়ে গোসল করে মেঝে পানি দিয়ে মুছে ফ্যান ছেড়ে দিত। অসহ্য গরম আর মেঝের ঠান্ডায় ভাতঘুম। কত দিন ও রকম ঘুম হয় না। ষোলো শ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটবাড়িতে এসির ঠান্ডা বাতাসে বসে এমন চিন্তাও অদ্ভুত লাগে।

অথবা কলেজ শেষে হুট করে শিউলি খালার বাড়িতে হানা। তিনি যেন ঠিক জানতেন, কেউ খেতে আসবে। এই রকম ভঙ্গিতে ভাত বাড়তে বসতেন। বাড়ি বদলের সঙ্গে শিউলি খালা হারিয়ে গেলেন! তার পুরোনো ল্যান্ডলাইন বদলে গেছে। আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি।

পাখির ডাকের আওয়াজে কলবেল বেজে যাচ্ছে দুপুরের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে দিয়ে। অদ্রিতা কপালের টিপ ঠিক করতে করতে তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে।

মনে মনে ভাবে, মানুষ সব সময় দেরি করে আসে। কিন্তু এই অতিথি এলেন আধ ঘণ্টা আগে। দেরি করে এলে আরেকটু মানসিক প্রস্তুতি থাকত। আরেকটু অস্বস্তি কম হতো।

অদ্রিতা তার গলার নেপালি মালাটা অ্যাডজাস্ট করে নিল। হালকা গোলাপি লিপস্টিক ঠোঁটে বুলিয়ে আয়নায় মুখ ভেংচি কাটল। যেন এতেই সব অস্বস্তি চলে যাবে। অবশ্য আজকাল কোনো কিছুতেই খুব অবাক হয় না অদ্রিতা। মা মারা যাওয়ার পর তার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও মরে গেছে।

–––

আবরার ঠিক করেছেন হজ পালন করতে যাবেন। তার আগে জাগতিক সব হিসাব–নিকাশ চুকাতে চান। আবরার গতকাল রাতে একদম ঘুমাতে পারেননি। মাঝরাতে বিচিত্র স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি স্বপ্নে দেখলেন তাকে একটি মেয়ে কানের দুল উপহার দিচ্ছে।

কী ভয়ংকর স্বপ্ন! একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষ কানে কেন ঝুমকা দুল পরতে যাবে? সারারাত এপাশ-ওপাশ করে শেষ রাতে বারান্দায় গিয়ে বসেছেন তিনি। রাতজাগা ক্লান্তি স্পষ্ট তাঁর চোখে। তবু চেষ্টা করছেন হাসিমুখে কথা চালিয়ে যাওয়ার।

সামনের মেয়েটি যদিও শান্তমুখে কথা শুনছে, তবু বোঝা যাচ্ছে তার অস্থিরতা। অস্বস্তি কাটানোর জন্য তিনিও অনেক মজার গল্প বললেন। গল্পের রেলগাড়ি আজকে থামছে না যেন। নিজের ছাত্রজীবনের গল্প কীভাবে যেন গল্পের বইয়ে মোড় নিল।

–––

এই মুহূর্তে প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করছে অদ্রিতা। তার সামনে বসে থাকা মানুষটি অসম্ভব চেষ্টা করছেন তাকে বিস্মিত করার। কোথায় সে বিমুগ্ধ হবে। না ভীষণ মাথা ধরছে তার। পাহাড়সমান বিরক্তি নিয়ে ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। সামনে বসা মানুষটির সঙ্গে তার সবচেয়ে সহজ সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল। শুধু পদবি নয়, পুরো জীবনের অংশ হওয়ার কথা ছিল।

ভাবল একবার হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, এই যে আপনি এত শরৎচন্দ্র নিয়ে গল্প করছেন, সেটা তো শুধু আমার সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ বলে? একসময় আমার যখন খুব প্রয়োজন পড়েছিল আর আমি আপনার বাসার বসার ঘরে আমার সমস্যা বলছিলাম, আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করছিলেন। সবাই বৃদ্ধ বয়সে সব হারিয়ে যখন শাহজাহান হয়, তখন তাদের জাহানারার প্রয়োজন পড়ে। মিনারের গরাদে চোখ রেখে শুধু তাজমহল দেখলে হয় না, তাই না? সে অতি লক্ষ্মী মেয়ে; এ ধরনের কথা শুধু মনে মনেই বলবে আর মুখে হাসি। অবশ্য জাহানারার হাতে পায়রার ডিমের মতো পাথরের আংটি ছিল। আর তার হাতে শুধুই নিউমার্কেটের সামনে থেকে কেনা সস্তা পাথরের আংটি।

আবরার সিলেটের গল্প শুরু করলেন।

: তুমি কি সিলেটে গেছ? তখন আমি এমসি কলেজে পড়তাম। বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে দূরে পড়তে গিয়েছিলাম। আগে তো শুধু আমরা জাফলং যেতাম। এখন তুমি কিন্তু গিয়ে রাতারগুল দেখে আসতে পারো।

অদ্রিতা বলল, হুম।

আবরার তার স্ত্রী জেরিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, তুমি চাইলে আমি পিংক কোরাল রিসোর্টে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওখানকার মালিক আমার বন্ধু মানুষ।

অদ্রিতা বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল, তার প্রয়োজন পড়বে না। আমি নিজেই ঠিক করে নিতে পারব।

স্থপতি হওয়ার সুবাদে পিংক কোরালের প্রতিটা কোণ তার চেনা। আবরার কী জেনে শুনেই তাকে জিজ্ঞেস করল। ভাবছে অদ্রিতা। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল তার নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর প্রশংসায়। হোটেলের একটি অংশে দোতলা পর্যন্ত ছোট ছোট গাছ দিয়ে বানানো জীবন্ত দেয়াল আর কাচের ছাদ। ঝুম বৃষ্টি পড়লে মনে হবে আমাজনের বনে কেউ বসে আছে। এই মুহূর্তে সামনে বসা অতিথির সঙ্গে কথার খেলা খেলতে ভালো লাগছে না।

–––

পাকা পোকার খেলোয়াড়ের মতো মুখ করে আবরারের পাশে বসে আছেন তার স্ত্রী জেরিন। তিনি মন দিয়ে অদ্রিতার ফ্ল্যাটের অন্দরসজ্জা দেখছেন। এক পাশে রাখা বনসাই আর অর্কিড। বাইরের বারান্দায় একটি দোলনা ঝুলছে। বেতের সোফার পাশেই বেশ কিছু বই দেখা যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন দুনিয়ার সব জিনিস দিয়ে স্তূপ বানিয়েছে।

এই যে এখন শাড়ি পরে ঢং দেখানো হচ্ছে, এতেও তার হাসি পাচ্ছে। দুই দিন আগেই ফেসবুকে ছবি দেখেছেন হলুদ রঙের ড্রেসে রং ঢং করা ছবি। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছেন প্রয়োজনমতো ব্যবহার করার জন্য। এইটুকু বললেই হবে মুসলমানের মেয়ের এই পোশাক! ছি।

জেরিনার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আজকে রাতে বেইলি রোডে মেটামরফোসিস নামে কাফকার নাটকের প্রদর্শনী। সব ভাবি আসবেন। কোথায় আমি পারলারে ফেসিয়াল করব তা না আবরার তাকে তার পরিবারের ঝামেলার জন্য এখানে নিয়ে এলেন। ওই সব জায়গায় যেতে ইউনিফর্ম হচ্ছে জামদানি শাড়ি আর বেলি ফুলের মালা। বাবুল ড্রাইভারকে মালা আনতে পাঠাতে হবে। মেটামরফোসিস মানে কী তাকে একেবারেই জিজ্ঞেস করা যাবে না। করলেই বলবেন নকল করে পাস করেছ ডিকশনারি দেখতে পারো না? ওই মুহূর্তে তীব্র অপমান হবে। মেয়েকেও ফোন দিয়েও বলা যাবে না। তার ঔদ্ধত্যও বাবার মতোই।

অল্প বয়সে একবার মেয়েকে বলেছিলেন, দেখ, আমাকে সবার সামনে আম্মু ডাকবে না। আমার এত অল্প বয়স, তোমার বুড়ো বাবার সঙ্গে বিয়ে না হলে এত বড় মেয়ে থাকত না।

মেয়ে উত্তরে কিছু বলেনি। শুধু হেসেছিল। পরে ওর ডায়েরি চুরি করে পড়তে গিয়ে জেরিন দেখলেন মেয়ে ডায়েরিতে তাকে নতুন সম্বোধন করেছে, ‘বুড়ি খুকুমণি’। এক ঝটকায় তিনি জেরিন থেকে জরিনা হয়ে কেঁদেছিলেন।

শুদ্ধ কথা শিখতে অনেক কষ্ট করেছেন সারা জীবন। তার জরিনা নাম বদলে জেরিন রেখেছেন। নাগর নদীর পাড়ের পতিসরের মালাবেণি ঝোলানো জরিনা বানু জেরিনের ছায়ায় কবেই হারিয়ে গেছেন। এখন আয়নাতেও সে ভুলে উঁকি দেয় না জেরিনের চোখে। অবশ্য ভালোই হয়েছে। জেরিনই একজন সরকারি আমলার যোগ্য সঙ্গিনী। সেখানে বোকাসোকা জরির প্রয়োজন নেই। যশোর স্টিচের সঙ্গে মুক্তোর মালা, কাঞ্চিপুরাম সিল্কের সঙ্গে সনাতন সোনার গয়না আর শুদ্ধ বাংলার সঙ্গে দু–একটা ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে ঢং করে কথা বলতে পারবে না জরি। চিকন রুপালি পাড়ের তাঁতের শাড়ি এখন বাসার সহকারী ছাড়া কারও জন্যই কেনেন না জেরিন।

–––

হঠাৎ অদ্রিতা মৃদু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই দেখুন এতক্ষণেও চায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। আপনি চা না কফি খাবেন? চিনি দিতে বলব?

অদ্রিতা ভীষণ উজ্জ্বল চোখে অনেক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন চা খাবার পরেই সব বরফ গলে যাবে।

জেরিন হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, চা–ই চলবে। আমি তো কখনোই চিনি খেতাম না। তোমার মনে আছে ভালোই।

অদ্রিতা হাসতে হাসতে বলল, আইডেন্টিক মেমোরি মোটেও ভালো না জানেন।

এই লোক আসল কথা বলতেই পারছেন না। ভূমিকা করে যাচ্ছেন তখন থেকে। জেরিন বুঝলেন এখন ওনারও একটু নাক গলাতে হবে। জেরিন বাসা থেকে আসার সময় বারবার বলে এনেছেন, তুমি এমন কিছুই বলবে না যাতে ও বিরক্ত হয়। সবই কপালের ফের। না হলে কী আর এখানে বসে দুই দিনের মেয়ের মেজাজ–মর্জি অনুযায়ী কথা বলতে হয়।

জেরিন আস্তে করে বললেন, আমরা চাইছি যেন তুমি তোমার অংশ বুঝে নাও।

অদ্রিতা বেশ আগ্রহ নিয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আবরার চিন্তা করছে এই কথার কী উত্তর হবে। চেকবুক সঙ্গে করে এনেছেন। এই যে এত দিন ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া ছিল। ভাড়ার টাকাও দিয়ে দেবেন।

–––

আসার আগে এ কথা শুনেই জেরিন তেলেবেগুনে জলে উঠেছিলেন। ওকে যে সব দিয়ে দিচ্ছ সেটা যথেষ্ট নয়? তোমার এত দিন খরচ হয়নি? নিজেকে হাজী মুহম্মদ মুহসীন মনে করো?

আবরার শীতল গলায় বলেছিলেন, তুমি সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না। নিজের মেয়ের বয়সী একজনের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে আটকায় না তোমার? তুমি মানুষ হিসেবে একেবারে তৃতীয় শ্রেণির।

উত্তরে জেরিন চাপা গলায় বলেছিলেন, তোমার তো আটকায়নি। আর আমার মতো তৃতীয় শ্রেণির মানুষের সঙ্গেই তোমার মতো দূষিত আবর্জনা মানায়।

–––

অদ্রিতা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ঠিক আছে।

আবরার যেন তৈরিই ছিলেন চেকটা ওর হাতে দিলেন।

অদ্রিতা কৌতুক নিয়ে চেকটা দেখছে। হঠাৎ বলল একটু পরিবর্তন করতে হবে।

জেরিন কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। আবরার তাঁকে হাত দিয়ে ইশারা করে চুপ করলেন। তিনি ঠিক করে এসেছেন অদ্রিতা যা বলবে, তাই করবেন। মনে মনে খুশি হলেন তিনি। এই এক জায়গায় পৃথিবীর সব মানুষের মিল থাকে। আসলেও টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায়। সবারই বিক্রয়মূল্য থাকে। কারওটা খোলা চোখে দেখা যায়। আর কেউ খুব ভালো করে লুকিয়ে রাখে। সামনে বসা মানুষটিকে কিনতে পারলে জিতে যাবেন তিনি আজকে।

অদ্রিতা বলল, শুধু নামটা বদলে দিলেই চলবে। অদ্রিতা হাসানের বদলে ‘আনন্দনিকেতন’। আমি চাচ্ছি কিছু সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিতে।

আবরার হেসে দিলেন এবং বললেন, অবশ্যই।

আবরার আজকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন দরজা দিয়ে। বারো বছর আগে খালি হাতে যাকে ফিরিয়েছিলেন, সে আবরারকে পরিপূর্ণ করে দিল। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে।

অদ্রিতা বারান্দা থেকে ওদের গাড়িটা বের হয়ে যেতে দেখল আর বারান্দা দিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে চেষ্টা করল। অনেক কঠিন কথা শোনানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু দম্ভের কঠিন বর্মের আড়ালে একজন পরাজিত পিতার চোখ একঝলক দেখে নিজেকে পরাস্ত করেছিল।
–––

ফারহানা সিনথিয়া: কানাডার ক্যালগারিপ্রবাসী।