রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক

সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

‘পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে
এসেছে দারুণ মাস...।’

যে ফুল দেখলে নিজের অজান্তেই এসব গান মনে পড়ে। যে ফুল নিয়ে অনেক অনেক গান, কবিতা রচিত হয়ে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতাঙ্গনকে করছে সমৃদ্ধিশালী। যে ফুল সবুজ ঘাসের ওপর রাখলে বাংলাদেশের পতাকার মতো মনে হয়। শীতের পরেই বসন্তের আগমন বার্তা বয়ে আনে যে ফুল। গাঢ় লাল রঙের পাপড়ি আর সবুজ রঙের বোঁটায় শোভিত এক অপরূপ ফুল। নাম তার শিমুল।

সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

বাংলার অনেক মানুষ বর্তমানে বাংলা কোন মাস চলছে, তা বলতে না পারলেও শিমুলগাছে ফুল এলেই বলে দিতে পারে, এখন ফাল্গুন মাস চলে এসেছে।

শিমুল ফুল দেখলে মনে পড়ে শীতের সকালে মাটির চুলার পাশে বসে গরম গরম নানা রকম মজাদার পিঠা খাওয়ার মধুর স্মৃতি। কানে বেজে ওঠে লাল আগুনঝরা শিমুলগাছে বসে কোকিলের কুহু কুহু ডাক।

শীতের সকালে সবুজ ঘাসের ওপর ঝরে পড়া শিশিরভেজা এই ফুল দেখার অনুভূতি সত্যিই অন্য রকম। যারা দেখেনি শীতের কুয়াশাঘেরা বড় বড় গাছে লাল টকটকে শিমুল ফুল ও নানা রকম পাখির কলকাকলি, তাদের সেই মনোরম নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার অনুভূতি বর্ণনায় বোঝানো যাবে না।

সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

শিমুলের (Silk cotton tree) বৈজ্ঞানিক নাম Bombax ceiba পরিবার Bombaceae. বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জন্মে থাকে। শিমুলগাছ লম্বায় ২০-২৫ মিটার হয়। এই ফুল পাঁচটি প্রজাতিতে দেখা যায়। তার মধ্যে রেশমি শিমুল, লাল শিমুল, কাপোক শিমুল, পাহাড়ি শিমুল ও মোজাম্বিক শিমুল। এর মোচাকৃতি ফল হয়। চৈত্র–বৈশাখ মাসে ফল পাকে এবং ফল পেকে বীজ ও শিমুল তুলা বের হয়ে আসে। যা লেপ–তোশক, বালিশ ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

টকটকে লাল ফুল গন্ধবিহীন। এই ফুল প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে তার নিজস্ব আগুনঝরা রং দিয়ে। পথচারীদের আকৃষ্ট করে নিজস্ব লাল ফুলে ও গাছে বসে থাকা কোকিল বা অন্য পাখির কলকাকলিতে। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে দেখা যায়। বাংলার মাঠেঘাটে রাস্তার পাশে কোনো রকম যত্ন বা পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা অবহেলায় বেড়ে ওঠে শিমুলগাছ।

সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

তাই হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও মন খুঁজে বেড়ায় বাংলাদেশি ফুল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে গত সাত বছরে আমি শুধু এক জায়গাতেই এই ফুল দেখেছি।

তিন বছর আগে সিডনিতে গাড়িতে করে কর্মক্ষেত্রে আসা–যাওয়ার সময় দূর থেকে প্রথম চোখে পড়ে বড় গাছে কমলা লাল রঙের ফুল। পরে ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামলে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, এ তো আমাদের দেশের শিমুল ফুল। যদিও রংটা একটু কমলা বা লাল কমলা রঙের। যা সিডনি সিটিতে ডার্লিং হারবার এলাকায় চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে অবস্থিত।

সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
সিডনির ডার্লিং হারবার এলাকার চায়নিজ ফ্রেন্ডশিপ গার্ডেনে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

আমি একে তো প্রকৃতিপ্রেমী ফটোগ্রাফার, তার ওপর অনেক দিন পর পাওয়া দেশি ফুল। ছবি তোলার লোভ আর সামলাতে পারিনি। ব্যস্ত শহরের ওখানে আবার গাড়ি পার্কিং করা অনেক বড় সমস্যা। একে একে তিন দিনের প্রচেষ্টায় কিছু ছবি তুলতে পেরেছি। প্রথমবার গিয়ে দেখি ফুল তখনো ভালো করে ফোটেনি। দ্বিতীয়বার ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে গোসল হয়ে যায় ক্যামেরা ও আমার। তৃতীয় চেষ্টায় সফল হই এবং ফুল, পাখিসহ কিছু ভালো ছবি তুলতে পারি। এ বছর দুবার গিয়ে আরও কিছু ছবি তুলেছি। বাংলাদেশি ফুল বলে কথা।

অস্ট্রেলিয়া গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত—এই তিন ঋতুর দেশ। এখানেও শীতের শেষে এই গাছের পাতা ঝরে পড়তে শুরু করে। আগস্ট মাসে ফুলের কুঁড়ি আসে এবং সেপ্টেম্বরে লাল কমলা রঙের ফুল ফোটে। পুরো পাতাবিহীন গাছে লাল ফুলে নানা রকম পাখি বসতে শুরু করে। ফুল শেষ হওয়ার পর সবুজ পাতা গজানো শুরু হয়।