নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সমসাময়িক বাস্তবতা

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

মূল্যবোধ হলো রীতিনীতি ও আদর্শের মাপকাঠি; যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। নীতি ভালো-মন্দের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দেয়। সুতরাং ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে সে সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেক কিছুতেই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও দেখা যেত কেউ একজন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে তাঁকে অনেকেই এড়িয়ে চলছেন। এমনকি যিনি অন্যায় বা অপরাধ করতেন, তিনি নিজেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যদের এড়িয়ে চলতেন। অন্যদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতেন। বয়স্ক ব্যক্তি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, আইন কর্মকর্তাদের সবাই সম্মান করতেন।

কিন্তু ২০১৯ সালে এসে আমাদের খুঁজতে হয় সম্মান ও নীতির ব্যাপারটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না। অথবা এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহারের ক্ষেত্র কোনটি।

অধিকাংশ সচেতন নাগরিক মহল এ অবস্থাকে নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অবক্ষয় ব্যাপারটা ক্যানসারের মতো। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে পুরো সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যা আমরা এখন প্রতিনিয়ত দেখছি। সম্মানের সঙ্গে নীতির এবং নীতির সঙ্গে সামাজিক পরিস্থিতির একটা শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটি যত দুর্বল হয়, নৈতিক অবক্ষয় তত মজবুত হয়।

নৈতিকতার বিচ্যুতি বর্তমানে আমাদের সমাজের সবক্ষেত্রেই দেখা যায়। বিচ্যুতি নেই এমন স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষকতা, ছাত্র ও অভিভাবক দিয়েই শুরু করা যাক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার প্রথম ধাপ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেখানে প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে।

একসময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হতো। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির ঘটনা। শিক্ষক যখন এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার কোনো সুযোগ নেই।

অভিভাবক যখন তাঁদের ছেলেমেয়েকে অনৈতিক পন্থায় পরীক্ষায় পাস বা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য সমর্থন করেন, তখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিকতার কোনো বিকাশ হবে না, এটাই স্বাভাবিক।

যখন এ রকম পরিস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে, শিক্ষাঙ্গনে একটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরীক্ষায় ফেল করলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি করা, শ্রেণিকক্ষে তালা দেওয়া, ব্যবহারিক পরীক্ষা/থিসিস নম্বরের সুযোগ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, প্রাইভেট টিউশন নিতে বাধ্য করা, কী নেই।

এভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দুমড়েমুচড়ে ফেলা হচ্ছে নৈতিকতাকে আর কলুষিত করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

শিক্ষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রেও এ রকম অবনতি স্পষ্টত লক্ষ করা যায়।

নৈতিকতার চরম ব্যত্যয় দেখা যায় খাবারে ভেজাল ও কেমিক্যাল ব্যবহারে। গুঁড়া মসলায় মেশানো হয় অস্বাস্থ্যকর ইটের গুঁড়াসহ নানা রঙের কেমিক্যাল। এত গেল রান্না করার উপকরণের গল্প। রান্না করা খাবার খাবেন, সেখানেও বিপত্তি। পচা-বাসি খাবার মিশিয়ে দেওয়া, পোড়া তেলের ব্যবহার, নোংরা পরিবেশে রান্না ও সংরক্ষণ করা—সবকিছুতেই নীতিবর্জিত কাজ খুঁজে পাবেন। যাঁরা এই অপকর্ম করছেন, একবার ভাবুন, আপনিও তো এই কেমিক্যালযুক্ত খাবার খাচ্ছেন, ক্ষতি তো আপনারও হচ্ছে। অবশ্য সে রকম ভাবতে পারলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না।

নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অদক্ষ লোকবল নিয়োগ, পদোন্নতি, পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেমে নেই। পুরোদমে চলে সরকারের ও অন্যের অর্থ কীভাবে লোপাট করে নিজের করা যায় সেই ধান্দা। মানুষ এতটাই দিশেহারা হয়ে গেছে যে ঠিক-বেঠিকের মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পায় না।

কিছুদিন আগে নাসার এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলের কেউ যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের ১৫-১৬ সদস্যের দল ঠিকই গিয়েছিল। প্রশ্ন থেকেই যায়, তাঁরা কাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য গিয়েছেন। যেমন নেই অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে কাজের সামঞ্জস্য, নেই কাজের গুণগত মান পর্যালোচনা করার মতো কেউ। যে যেভাবে পারছেন, নিজের মতো করে লুটপাট করছেন।

আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া লেগেছে। অন্যের সফলতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই তো সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কারও বিপদে সাহায্য করি না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি। সেলফি নিই, ভিডিও করি। যাঁরা সাহায্য করতে আসেন, তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আবার এটাকে ব্যবসা হিসেবে দেখেন। ফেসবুক/ইউটিউবে লাইভ করেন, অনুসারী বাড়ানোর জন্য।

অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অপদস্থ করা, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে নারীদের কটূক্তি করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মারামারি, খুন—কোনোটিই বাদ পড়ছে না। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে আমিই ভালো, আমিই সফল হব, সবকিছু আমারই হতে হবে, আমার থেকে অন্য কেউ ভালো থাকতে পারবে না, সেটা যেভাবেই হোক।

রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা—এমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতা চরমভাবে বিপর্যস্ত নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা কেউ বাদ নেই। পুরো সিস্টেম একটা সিন্ডিকেটে হয়ে গেছে। অনেকেই হয়তো চাইলেও এই সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছেন না। আবার অনেকে ইচ্ছা করেই বের হতে চাইছেন না। এত সহজে অনেক টাকা উপার্জনের সুযোগ সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

এসব দুর্নীতি ও অপকর্ম রোধ করা যাঁদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই কতটা নৈতিক অবস্থানে আছে, বর্তমানে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নীতিহীন এই কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই বলে সমাজে কি ভালো মানুষ নেই? আছে, তবে দিন শেষে ভালো মানুষগুলোও এ ধরনের দুর্নীতির শিকার।

এর থেকে উত্তরণের কোনো উপায় কি নেই? প্রবাদে আছে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা’; আমাদের অবস্থা এখন সে রকম হয়ে গেছে। ভালো কাজ হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে দুর্নীতির যে অবাধ বিচরণ ও অস্থিরতা, মনুষ্যত্বের বিপর্যয়ের যে উচ্চমাত্রা, তা এই অল্পসংখ্যক ভালো কাজ দিয়ে পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। শক্ত আইন প্রণয়ন ও কোনো রকম পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নই পারবে উত্তরণের পথ দেখতে।

এ তো গেল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান। ব্যক্তিজীবনেও আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। আইন করেই সবকিছু বন্ধ করা যাবে না। আমাকে, আপনাকে সচেতন হতে হবে, নীতিবিরুদ্ধ কাজ করা থেকে নিজেকে সংবরণ করতে হবে। নিজের পরিবারের আয়-উপার্জন সঠিক পথে কি না, দুর্নীতি হয়েছে কি না, খেয়াল রাখুন। আপনার স্বামী/স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক যেমন মেনে নিতে পারেন না, অবৈধ আয়-উপার্জন/অনৈতিক কাজকেও ঠিক সেভাবে ঘৃণা করুন ও সমর্থন করা বন্ধ করুন। নিজেকে সংশোধন করুন, নিজের পরিবারকে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে দূরে রাখুন, তাহলেই সম্ভব।

আপনি নিজের যে কাজের জন্য মাসিক বেতন নেন, সেই কাজটি ঠিকমতো করুন। অন্যকে বিপদে ফেলার মতো, দুর্নাম করার মতো ঘৃণ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। ভালোকে ভালো বলতে শিখুন, খারাপকে খারাপ বলার মতো সৎসাহস রাখুন। নিজের অবস্থান থেকে নৈতিকতাকে আগলে রাখুন।

সবাই যদি নিজের কাজটি সঠিকভাবে করি, তাহলেই নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। সমাজের অন্যায়-দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। নিজে না করে অন্যকে সকাল-বিকেল দোষারোপ করে কোনো সমাধান হবে না। শিক্ষাক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা, আইনকে নিয়মানুযায়ী প্রয়োগ করা, অর্থাৎ কোনো প্রকার দুর্নীতির আশ্রয় না নিলেই কেবল এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। এমন নয় যে আমরা বিবেকহীন, নীতিহীন, আদর্শবিহীন এক লোভী মানুষে পরিণত হয়েছি; যা থেকে আমরা নিজেরাই সরে আসতে চাই না?