পাপীর হাসি

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ পড়েছিলাম অনেক ছোটবেলায়। খুব সাধ জাগত কেমন সেই হাসি, একবার দুই চোখ ভরে দেখব।

আমি ক্রীতদাসের সেই হাসি দেখিনি। কিন্তু আমি দেখেছি পাপীর হাসি। একজন খুনির হাসি। সে হাসি কী যে ভয়ংকর। এই সমাজের বিচারব্যবস্থার প্রতি তীব্র তাচ্ছিল্য লুকিয়ে ছিল সেই হাসিতে, আমি ভুলতে পারি না।

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক ওই পাপীর হাসি দেখার পর থেকে কেন যেন হাসতে পারছি না আর। খুব হাস্যকর কোনো ঘটনাতেও এখন আমার হৃদয় হাসছে না। আমার চোখ থেকে ওই পাপীর হাসি দূর হচ্ছে না।

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়, মানুষ, তুমি এত অমানুষ কেন? মানুষ, তোমার হৃদয় কোথায়? কিন্তু আমার গলা আটকে যায়। অদৃশ্য কোনো শক্তি আমার গলা চেপে ধরে যেন। চোখে ওই পাপীর হাসি লেগে থাকে। আমি মানুষের বর্বরতাগুলো চুপ করে হজম করতে থাকি।

তারপর আমি অপেক্ষা করতে থাকি সেদিনের, যেদিন ওই পাপী হাসতে হাসতে আমার দরজায় কড়া নাড়বে। হয়তো ভদ্রতার খাতিরে দরজা খুলে আমি তাকে বসতেও বলব। হয়তো আমারই রান্নাঘরে ব্যবহৃত ছুরি দিয়ে ওই পাপী কিংবা অন্য শত শত পাপী আমাকে আঘাত করবে, ক্ষতবিক্ষত করবে, আমি লুটিয়ে পড়ব মাটিতে!

অনেক বছর আগে এ রকম পরিস্থিতিতে পাপীরা ভয় পেত। বাংলা সিনেমায় যেমনটি দেখায়। ভিকটিম লুটিয়ে পড়লে কিংবা অজ্ঞান হয়ে গেলে পাপীরা পালিয়ে যায়। কেউ মৃত্যুর দায় নিতে চায় না। তাদের মনে পড়ে, দেশে আইন আছে। হৃদয়ে কোনো পাপবোধ কাজ না করলেও তারা আইনকে ভয় পেয়ে পালায়।

কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন অপরাধীদের দিন। তারা এখন দিনদুপুরে বিনা কারণে খুন করে ঘুরে বেড়ায় একদম চোখের সামনে। তাই হয়তো আমার সেই লুটিয়ে পড়া পরিস্থিতিতেও পাপীরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে।

আমি জানি না, আঘাত পেতে পেতে তখন আর আমার শ্রবণশক্তি থাকবে কি না। আমি জানি না, তাদের সেই অট্টহাসি আমার কানে পৌঁছাবে কি না। যদি না পৌঁছায়, তবে তা-ই ভালো। তাদের মধ্যে ভদ্র চেহারার হিংস্র একজন হয়তো বলে বসবে, আমার লুটিয়ে পড়াটা অভিনয়। তারপর হয়তো তারা আবারও আঘাত করবে আমায়। এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আমার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, বাক্‌শক্তি সব চলে যাক।

হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার এইটুকুই চাওয়া। আমার মাতৃভূমিতে যদি আমার বাক্‌স্বাধীনতা না থাকে, তবে যেন আমি মূক-বধির হয়েই জন্ম নিই! আমার দেশের মাটি যদি আমায় নিরাপত্তা দিতে না পারে, তবে আমার জন্মটাই যে আজন্ম এক পাপ! এই পাপের লজ্জা বয়ে বেড়াচ্ছি মৃত্যু পর্যন্ত, কাকে বোঝাব?

আচ্ছা, খুন করে তারা হাসে কীভাবে? হাতকড়া পরে, পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনে কীভাবে হাসি পায় ওদের? ওদের কি মনে পড়ে না, ওদেরও একটা পরিবার আছে, সমাজ আছে, ওদের পরিবারের মানুষের একটা জীবন আছে?

ওদের কি মনে পড়ে না ওই পাপমিশ্রিত হাসি দেখে ওদের পরিবারের অনুভূতি কী রকম হবে? ওরা আরেকজনের সন্তানের গায়ে কীভাবে হাত তুলল? হাত কাঁপেনি ওদের? ওরা কি জানে, এই দেশের আর কোনো বাবা-মা সন্তান জন্ম দিয়ে বলতে পারবে না, ‘হে খোদা, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ প্রত্যেক মা-বাবার আকুতি এখন একটাই, তাঁদের সন্তান যেন কারও সন্দেহের বলি না হয়। এই আকুতি কি কারও কানে পোঁছায়?

অন্য একজনের সন্তানকে খুন করে ওরা যখন হাসতে পারে, ওই পাপীর হাসিতে তখন আমার ঘেন্না ধরে যায়। জঘন্য সেই হাসি আমাকে ঘুমাতে দেয় না। দুঃস্বপ্নে জেগে উঠি আমি। নিজেকে চিমটি কেটে পরখ করি, কোথায় আছি, ঠিক আছি কী। পরক্ষণেই মনে হয় আমি না হয় ঠিক আছি, আমার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়, অনাত্মীয়, প্রতিবেশী, গলির মোড়ের ওই ফুচকা মামা, সবাই ভালো আছে তো?

ভয়ে দুই চোখের পাতা এক হয় না আমার; কাল ঘুম থেকে উঠে কি শুনতে হবে আরেকটা নির্মম অপরাধের খবর। কাল ভোরে নতুন কোনো অপরাধীকে পুলিশ হাতকড়া পরালে তার চোখে কি একটু অপরাধবোধ থাকবে? সেই পাপীর কি তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জা থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ওই পাপীর হাসিটাই হয়তো আমার মৃত্যুর কারণ হবে।