আর কত রক্তে ভেজা লাশের মিছিল

আবরার হত্যার প্রতিবাদে বুয়েটে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ঢাকা, ১২ অক্টোবর। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
আবরার হত্যার প্রতিবাদে বুয়েটে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ঢাকা, ১২ অক্টোবর। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

কয়েক দিন ধরে ভূপেন হাজারিকার রচিত গানের দুটি লাইন কানের পিছু নিয়েছে। বারবার কোথা থেকে যেন বেজে উঠছে, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ সত্যিই কি মানুষ মানুষের জন্য? মানুষ কি মানুষের কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেতে পারে না? এ প্রশ্নে নিজেই নিজের কাছে আজ জর্জরিত।

দেশের বাইরে আছি দুই বছর ধরে। ফলে দেশের প্রতি একটা অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে সব সময়। মাঝেমধ্যে মনে হয় যেন যুগ যুগ ধরে দেশের মাটি, দেশের মানুষকে দেখি না। সেই আকুতি থেকে হয়তো বারবার ফেসবুকে উঁকি দেওয়া খানিকটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে আজকাল।

প্রতিদিনের মতো করে সেদিনেও ঘুম থেকে উঠে মোবাইল ফোনটা হাতে নিই। নিজের অজান্তেই ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকি। হঠাৎ করেই চোখজোড়া আটকে গেল একটা নিউজ ফিডে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

তারপর সারাটা দিন ক্লাস ও ল্যাব করেছি। কিন্তু বারবার নিউজ ফিডে ঢুকেছি একটা আশা নিয়ে। বারবার মনে হয়েছে কেউ হয়তো লিখবেন, আবরার হত্যাকাণ্ডের সংবাদটা একটা ভুয়া সংবাদ। কিন্তু না, কেউ সেটা লেখেননি। বরং ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে আবরারের নিথর মৃতদেহ।

দুই.

আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশ এখনো উত্তাল। আরও কিছুদিন এমন হয়তো থাকবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একসময় কমে আসবে। অন্য আরেকটি ঘটনা ঘটবে আরও বেশি জঘন্যভাবে। মানুষ ব্যস্ত হবেন নতুন ঘটনা নিয়ে। কেউ লিখবেন, কেউ বর্ণনা দেবেন, কেউবা করবেন প্রতিবেদন।

সরকার এগিয়ে আসবে। ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেবে। বিচার হবে। রায়ও হবে। একটা সময় সেই রায়কে পাশ কাটিয়ে আসামিরা বের হয়ে আসবে। এমনটি চলে আসছে বহুদিন ধরে। এই দানবেরাই বড় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল বিশ্বজিৎকে। আজ যখন শুনি বিশ্বজিৎ হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন বুকটা ভেঙে আসে। বিচারহীনতার এমন বেসাতি দেখলে বুকের ভেতর নিরাশার বাসা না বেঁধে কী উপায়?

তিন.

প্রশ্ন জাগে মনে, কেন আবরারকে বড় অসময়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে? অনেকে অনেক কারণের কথা বললেও মূল কারণ কিন্তু একটাই। সেটা ভিন্ন মতবাদ। দানবেরা কেন এই ভিন্নমত দমনের দায়িত্ব নিল? সেটা বোঝার জন্য কি মস্ত বড় সমাজবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন আছে?

দানবদের কেউ কি বিদ্রোহী কবির কথা একটু মনে রেখেছে, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া, ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়কো মোয়া।’

দানবেরা কেমন করে যেন বিশ্বাস করত এমন ভিন্নমত দমন করতে পারলে কেউ হয়তো তাদের পুরস্কৃত করবে। তারা আরও বড় নেতার বনে যাবে। হবে কোটিপতি। হয়তো তা-ই হবে। জেল খেটে একদিন বিশ্বস্ত নেতা হয়ে বের হবে। তারপর বড় আসনটি ঠিকই একদিন দখল করে নেবে। তা না হলে ঘাতকেরা কেমন করে এমন হাসিমুখে বিচারালয়ে যেতে পারে?

আবরার চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে কিছু প্রশ্ন। কিছু ভাবনা। কয়েক দিন ধরে যেন সেই বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো চেপে ধরে আছে পুরো মনোজগৎকে। ভাবছি, কেন একদল ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না? আর কেনই-বা এসব ভিন্নমতের সৃষ্টি হচ্ছে জনমনে? কেন অসংখ্য আবরারকে লিখতে হয়? শেষে হতে হয় বলি।

দুই বছর ধরে পরাশক্তির দেশ আমেরিকায় এসেছি পিএইচডি করতে। এখানে এসে যে ছোট্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে হলফ করে বলতে পারি, আমরা আসলে ধনে, জনে কিংবা মেধায় মোটেও দুর্বল নই। আমরা দুর্বল হচ্ছি প্রযুক্তি, গবেষণা এবং গবেষণার যথাযথ প্রয়োগে। আমরা দুর্বল হচ্ছি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণে।

চার.

আজকের যুগ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক যুগ। এ যুগে যার যত বুদ্ধির চর্চা থাকবে, সে তত সমৃদ্ধ হবে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, এটা খনির যুগ নয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে কি সৌদি আরব বিশ্বে এক নম্বর দেশ হতো না? যদি খনির যুগই হতো, তাহলে কেমন করে সিঙ্গাপুর এতটা উন্নত দেশ হতে পারে? সৌদি আরবে যে পরিমাণ খনিজ সম্পদ রয়েছে, আমেরিকায় তার দশ ভাগের এক ভাগও নেই। তাহলে কেমন করে আমেরিকা এত উন্নত, এতখানি শক্তিশালী? কারণ একটাই, তাদের আছে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। তাদের আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আছে গবেষণা।

ছোট একটা ঘটনা বলি। ২০০৬ সালের কথা। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হচ্ছিল শাবিপ্রবিতে। দীর্ঘ ছয় মাস আন্দোলনের পর একজন নতুন উপাচার্য এলেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর প্রথম শুক্রবারের জুমা মসজিদে পড়তে গিয়েছিলেন। উপাচার্য মসজিদে তাঁর বক্তব্যে একটি কথা বলেছিলেন। প্রথমে তিনি ইমাম সাহেবকে বলেন, কিছু মনে করবেন না, আমি একটি সত্য কথা বলতে চাই। তিনি বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গোড়াতে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা আমরা কে না জানি? কিন্তু সেই গবেষণা থেকে মুসলমানরা কেমন করে ধীরে ধীরে দূরে চলে এলেন? কারণ বলতে গিয়ে উপাচার্য বললেন, আমাদের মাওলানা সাহেবরা ফতোয়া দিয়ে দিয়ে মুসলমানদের বিজ্ঞান গবেষণা থেকে দূরে নিয়ে এসেছেন। যাঁরা ইসলাম ধর্মের প্রচার করেন, তাঁরা বিজ্ঞানচর্চাকে নিরুৎসাহিত করে আসছেন গোড়া থেকে। যার পরিণতি বিশ্বের দিকে তাকালে কে না বুঝতে পারে?

স্যারের সে কথাটা আজও দিব্যি মনে পড়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আজও দেশের একটা বড় অংশ খুব গোঁড়া ও অন্ধ ধর্মান্ধে মগ্ন। ফলে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মান্ধতা আজও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ নির্মাণের একটা বড় অন্তরায়।

পাঁচ.

আমাদের সামনে একটা ভিশন রয়েছে। উন্নত দেশের ভিশন। সে ভিশন দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা কেমন করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাব? কোন সিঁড়ি দিয়ে? আমরা কি কোনো সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি? বিশ্বে আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে। প্রতিবেশী দেশ মহাকাশে নভোযান পাঠাচ্ছে। আর আমরা কি করছি? আজ অবধি কেন আমাদের ছোট একটা তিন চাকার মোটরযানও আমদানি করতে হয়? ছোট্ট করে একটা মোটরযানের কারখানা গড়ার সক্ষমতাও কি আমাদের নেই? কেন আজও আমাদের একটা দশ টাকা দামের বলপেনও ভারত থেকে কিনতে হয়? তাহলে কেমন করে আমরা স্বপ্ন দেখি উন্নত দেশের? আর কত দিন আমাদের করতে হবে পশ্চিমাদের দরজিগিরি? আমরা আর কত দিন আকাশে শুধু ঘুড়িই ওড়াব? কবে স্বপ্ন দেখব নভোযানের? তাই খুব জানতে ইচ্ছা করে—পাঞ্জেরি, রাত পোহাতে আর কত দেরি?

ছয়.

২০১১ সালে জাপানের সুনামির কথা কার না মনে আছে? আমরা দেখেছি কেমন করে কী ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে জাপানের বুকে। সে সময় তাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ভেঙে পড়ে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে জীবননাশকারী ভয়ানক তেজস্ক্রিয় রশ্মি। যেসব বিজ্ঞানী অবসরে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে এলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা দায়িত্ব নিলেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজ করার। তরুণদের বললেন, আমাদের বয়স হয়েছে, তোমরা অনেক দিন বেঁচে থাকবে, দেশকে দেওয়ার অনেক সুযোগ পাবে, কিন্তু আমরা আর পাব না। এই হচ্ছে জাপানিদের দেশপ্রেম।

আমরা যদি আমাদের দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবী, আমলা কিংবা উপাচার্যদের দিকে তাকাই, তাহলে কী দেখি? দেখি যাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয় তিনি সেটার আগাগোড়া খেয়ে শেষে চামড়া দিয়ে ডুগডুগি পর্যন্ত বাজান। শিক্ষকতার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শাবিপ্রবির একজন সাবেক উপাচার্য কেমন করে ছাত্রলীগের চরিত্র নষ্ট করেছেন, কেমন করে অযোগ্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। দেখেছি ন্যায্য কথা বলার কারণে কেমন করে ছাত্রলীগকে শিক্ষকদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে দেখলাম, সেই উপাচার্যকে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তখন বড় জানতে ইচ্ছা করে, হে নীতির বাণী তুমি কি আজও ধুলোয় লুটোপুটি খেয়ে বেড়াও?

সাত.

কে জানে দিনকে দিন কত বাংলামায়ের বদন হচ্ছে মলিন। কত পুত্রের লাশের ভারে ভারী হচ্ছে কত বাবার কাঁধ। কে জানে কত দুঃখের দহনে, করুণ রোদনে কত জীবনের ক্ষয় হচ্ছে তিলে তিলে। কত স্বপ্ন ঝরে যায় মুকুলে, কত সুর বেদনা বাজে শুকনো পাতার মর্মরে, কত আশা হাহাকার হয়ে যায় আকাশে-বাতাসে। মনিরুজ্জামানের সুরে আজও বলতে হয়, প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবনপাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।

মো. মনির হোসেন: ডক্টরাল ফেলো, অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা ও সহকারী অধ্যাপক শাবিপ্রবি, বাংলাদেশ।