বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেন অমানবিক হয়ে উঠছে

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বাংলাদেশে একটা সময় ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত বুক পেতে।

একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন সমাজের চোখে পূজনীয় ব্যক্তি। রাষ্ট্রনায়কেরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপদেষ্টা হিসেবে কাছে পেতে চাইতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বক্তব্য শুনতে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা থেকে কত কিছু শেখা যেত।

আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই স্বর্ণালি সময় অতিবাহিত করেছি। আমাদের আরও দুর্ভাগ্য, আমরা আরও বেশি মানবিক করার আগেই রাষ্ট্রকে দূষণের শিকার করেছি। রাষ্ট্র আজ এতটাই দূষিত যে মানবিকতা শব্দটি আজ বড় বেশি জরাজীর্ণ।

আজ পেটাতে পেটাতে নিজের বন্ধুকে হত্যা করে আমরা কোনো বিকার ছাড়া টিভি দেখতে পারি। পেটাতে পেটাতে আমরা উল্লাস করতে পারি।

আমরা বিশ্বজিৎকে মারতে দেখেছি। আমরা আবরার ফাহাদকেও মারতে দেখলাম। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হওয়া একেকটি সংখ্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের সভ্যতার অধঃপতন।

খুব দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, বিশ্বজিৎ-আবরারকে যারা মারছে, তারা আর কেউ নয়, তারা আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ ভালো ছাত্র। যখন এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এসে আরও মানবিক হওয়ার কথা ছিল, তখন তারা আরও অমানবিক হয়ে উঠছে দিনে দিনে। রাষ্ট্র কি কোনোভাবে এই অধঃপতনের দায়ভার অস্বীকার করতে পারে?

এমন দিন ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হতো এখানে যদি একবার আসতে পারতাম! মানুষের আশা-ভরসার প্রাণকেন্দ্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয় আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কত তফাত। আজ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে চর্টার সেল। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে যতটা সম্ভব আঘাত করা যায় ততটা করে।

শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও একই প্রবণতা দেখেছি। শিক্ষকদের দেখেছি কোনো ছাত্রনেতাকে অমানুষ বানিয়ে আবার নতুন অমানুষ তৈরি করার মিশনে। শিক্ষকদের এদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, আবার ছুড়ে ফেলে দিতে দেখেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ আজ আর মানুষ গড়ার কারিগর নন। তাঁরা দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন বিভাজন প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার। যখন যাঁরা প্রশাসনে থাকেন, তখন তাঁরা হয়ে ওঠেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্রাট। দলীয় রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা প্রশাসন চালান। প্রয়োজনমতো ছাত্রদের ব্যবহার করেন ও ব্যবহৃত হন। সত্য শেখানোর চেয়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করার সবকিছু শেখানোর নাম যেন এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়।

বুয়েট নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল। দেশের সেরা সন্তানেরা বুয়েটে পড়ে। আবরারের হত্যা প্রমাণ করে ভালো ছাত্র আর ভালো মানুষ দুটি ভিন্ন জিনিস। ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ভালো ছাত্র হওয়ার দরকার নেই। এ জন্য দরকার ভালো শিক্ষক। আজ শিক্ষকদের অনেকেই বোধ হয় আর ভালো মানুষ নন। তাঁরা যখন কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ বলার আগে দশবার ভাবেন তাঁদের ওপর মহল অসন্তুষ্ট হবে কি না, তাঁদের পদ-পদবি পেতে সমস্যা হবে কি না, তখন তাঁরা কীভাবে সত্য শিক্ষা দেওয়ার সাহস পাবেন। আজ অনেক শিক্ষকই মানসিকভাবে দুর্বল। তাঁরা আজ দলীয় রাজনীতির কাছে গৃহবন্দী। তাঁদের পক্ষে ভালো মানুষ বানানোর কারিগর হওয়া একেবারেই অসম্ভব।

আমাদের কিছু শিক্ষক যে কতটা নির্লজ্জ হয়েছেন ইদানীং। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করলেন না। বুয়েটের উপাচার্য পদত্যাগ করবেন না বলে দিয়েছেন। আসলে পদত্যাগ করার ব্যাপারটাও তাঁদের নিজেদের হাতে নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত ওপর মহলের সিগন্যাল পাওয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা পদত্যাগও করতে সাহস পান না। এটা হলো পরাধীন মানুষের হীনম্মন্যতা। আমরা শিক্ষকেরা আজ পরাধীন। এমন পরাধীন শিক্ষকদের দিয়ে জাতি কিছু আশা করতে পারে না।

রাজনৈতিক দলের ব্যানারে শিক্ষকরাজনীতি থাকলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও নতজানু হবে। দলীয় ছাত্ররাজনীতি আর দলীয় শিক্ষকরাজনীতি মিলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতির ব্যানারে শিক্ষক সংগঠন পৃথিবীর কোথাও নেই। আমাদের সব সম্ভবের বাংলাদেশে শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে দলের কাজ করতে বেশি সময় পার করেন। অনেক উপাচার্যকে দেখি দলের বিভিন্ন পোস্ট নেন। তাঁরা কখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেন জানি না।

আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি? আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। আমরা ইচ্ছেমতো বিশ্ববিদ্যালয় খুলছি। একটা বিশ্ববিদ্যালয় লালন-পালন করতে কী কী দরকার আমরা জানি না। এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে উন্নত স্কুল বলা যায়। আমরা দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছি, দলীয় উপাচার্য নিয়োগ দিচ্ছি। দলীয় সংগঠন পুষছি। আর তৈরি করছি অমানবিক মানুষ।

বাংলাদেশের আজ যা অবস্থা, তাতে খুব বেশি উচ্চশিক্ষার দরকার নেই। দরকার ভালো মানুষ তৈরি করা।

আমাদের যে শনির দশা লেগেছে, তা থেকে এখনই উত্তরণের রাস্তা বের করতে হবে। আমাদের এখনই শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমাদের এই সত্য মানতে হবে, এই করুণ অবস্থার জন্য এই শিক্ষকরাজনীতি পুরোপুরি দায়ী। আমাদের এখনই ভাবতে হবে। নতুবা আবরার ফাহাদরা মরবে। আমরা কিছুদিন বিলাপ করব। তারপর আবার এই মৃত্যুর মিছিলে নতুন কেউ যোগ হবে। এভাবে চলতে পারে না আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।