মায়ের কান্না

বুয়েটের শিক্ষার্থী নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুনের কান্না থামছেই না। রায়ডাঙ্গা গ্রাম, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১০ অক্টোবর। ছবি: তৌহিদী হাসান
বুয়েটের শিক্ষার্থী নিহত আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুনের কান্না থামছেই না। রায়ডাঙ্গা গ্রাম, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১০ অক্টোবর। ছবি: তৌহিদী হাসান

মায়ের ঘুম আসে না। নিস্তব্ধ কালো রাত। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মাঝেমধ্যে তন্দ্রা এসে চোখ দুটিকে জড়ো করে ফেললে হকচকিয়ে ওঠেন। চোখ মেলে আবরার আবরার বলে ভাঙা গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠেন।

কেউ নেই পাশে। কিছুই নেই পাশে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তো আবরার ছিল এখানে। মায়ের পাশে বসে গল্প করছিল। চোখ জড়ো হয়ে এলে শুধুই ছোট্ট ছেলে আবরারের চিল্লাচিল্লি শুনতে পান তিনি। আবারও চোখ মেলে অন্ধকারে চারদিকে ছেলের খোঁজে তাঁর নির্বোধ চোখ দুটি সাঁতরাতে থাকে।

চোখে এখন আর পানি নেই। একটানা কয়েক ঘণ্টা ঝড়ের পর যেমন পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে আসে। ঝড়ের পর যেমন উঠানে উঠানে ঝরা পাতা, এখানে-ওখানে কালবৈশাখীর চিহ্ন। তেমনি আবরারের মায়ের শরীর নিথর হয়ে আসছে।

কান্নার শক্তি নেই। চোখে আর পানি নেই। উদাস মন। কী যেন শূন্য শূন্য লাগছে। কী যেন হারিয়ে গেছে। মা, মা ডেকে ক্ষণে ক্ষণেই আবরার আসছে বাড়িতে। জেগেই আবার সেই ঝিঁঝি পোকার ডাক। কিন্তু আবরারকে দেখা যায় না।

আবরার পাশে নেই। কোথাও নেই। অবুঝ মন খুঁজে ফেরে সারা ঘরে। এদিকে-ওদিকে, রান্নাঘরে, বারান্দায় আবরারের পায়ের শব্দ শোনা যায়। তারপর আবার তন্দ্রা।

আবারও চোখ জড়ো হয়ে আসে। আবরার যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, সে ক্লাসে প্রথম হয়। মাকে ডেকে ডেকে চিৎকারে চিৎকারে দুনিয়া মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছিল।

কিরে, কী হয়েছে? মা প্রশ্ন করেন।

মা, আমি প্রথম হয়েছি।

ছেলে আমার একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। মা ছেলেকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেন।

আবারও ঘুম ভেঙে যায়। আবারও তন্দ্রায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। মা হেসে ওঠেন। আবারও স্বপ্নের মতো দেখেন। উফ, পেটে ব্যথা করে। আবরার পেটে থাকতে কী করত মা কল্পনায় নিয়ে আসেন। এই ছেলে কত লাথি মেরেছে। মিষ্টি ব্যথা।

তারপর...জন্মের পর একঝলক চিৎকার করে কাঁদল। মায়ের মুখের দিকে কী রকম যেন তাকাল। তাকিয়ে থাকল অপলক। পলক ফেরাচ্ছিল না। কতক্ষণ তাকিয়েছিল, মা মনে করতে পারছিলেন না।

আবারও তন্দ্রা ভেঙে যায়। আবারও চোখ জড়ো হয়ে আসে। চোখে আবরার চলে আসে। স্কুলপড়ুয়া আবরার। আবরার কেন বাড়ি ফিরছে না। আজ এত রাতেও কেন বাড়ি ফিরছে না। চিৎকার দিয়ে মা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তারপর আর ঘুম আসে না। আবারও আহাজারি। আমার ছেলে কি আবার আসবে। এই দেখো দেখো, এই আবরার ফিরে আসছে।

মায়ের কান্না চারদিকে। মায়ের কান্না বাতাসে বাতাসে। সারা বাড়িতে। সবাই জড়ো হয়। সান্ত্বনা দেয়। মা নির্বাক চাহনিতে দেখেন সবাইকে। এই তো সবাই আছে শুধু আবরার নেই। আমার ছেলেকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে গো!

মৃত্যুর সময় আমার ছেলে কী বলেছিল? মা সবাইকে প্রশ্ন করেন। আমার ছেলে কি আমাকে ডেকেছিল? ওদের কি বলেছিল আমাকে আর মেরো না? বলেছিল কি, উফ্‌ ব্যথা পাচ্ছি, আর পারি না গো। ওর মৃত্যুর আগে আমার মৃত্যু হলো না কেন গো?

মায়ের কত প্রশ্ন। কে দেবে এসবের উত্তর!