ব্রেক্সিটের বিদায়ে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ব্রিটেনে এখন গরমের শেষ। গরমের শেষ দিনগুলো সান ফ্লাওয়ার বাগানে দেখছি। কদিন পর রাতের কুয়াশায় তা নষ্ট হয়ে যাবে। সান ফ্লাওয়ার ফুল দেখলেই ভ্যান গঘের কথা মনে হয়। অথচ এই ফুলের ছবি অনেক শিল্পীই এঁকেছেন। বিশেষ করে গুস্তাভ, মার্টিন, আন্নাবেলে প্রমুখ।

আমাকে এই ফুলের বীজ দিয়েছিল প্রতিবেশী পোলিশ মেয়ে আন্দ্রিয়া। তার সঙ্গে ব্রেক্সিট নিয়ে আলাপ হলো। অনেক ব্যাপারেই ঝাপসা ধারণা তার। সান ফ্লাওয়ারের ছবি তুলে ব্রেক্সিট নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়া বা এক্সিটকে ব্রেক্সিট বলে।

ব্রেক্সিট নিয়ে বিভিন্ন আশঙ্কা বাজারে চালু। ২০১৬ সালের গণভোটের ভিত্তিতে এই ব্রেক্সিট। ৩১ অক্টোবর ব্রিটেন বেরিয়ে আসবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বলয় থেকে।

বরিস জনসন ইইউ থেকে বের হওয়ার আগে কোনো ডিল করতে পারেননি। থেরেসা মে ও তাঁর সব ডিল পার্লামেন্টের ভোটে নাকচ হয়ে যায়। জনসন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বাতিল করতে চাইলেন রানির অনুমতি নিয়ে। কোনো লাভ হয়নি।

নো ডিল নিয়ে কনফিউজড ব্রিটেনের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতারা। তাঁরা বলছেন, এটা ডেসটিনি, নাকি ডিজাস্টারস, বুঝে উঠতে পারছেন না।

ইইউ থেকে বের হলে ব্রিটেনকে কয়েক বছর স্ট্রাগল করতে হবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। প্রোপার্টি মার্কেট ক্র্যাশ করবে। ফাইন্যান্সিয়াল ফিল্ড, এনএইচএস মানে হেলথ সেক্টরে ধস সামাল দিতে সরকার কি প্রস্তুত? প্রচুর ফান্ড রেইজ করা হয়েছে তা সামাল দেওয়ার জন্য।

ব্রেক্সিট সম্পর্কে প্রতিদিন সংবাদ বের হচ্ছে। পাঠকেরা সংবাদপত্রে চোখ রাখতে পারেন। আমার আগ্রহ মানবিক সম্পর্কে এই ব্রেক্সিটের প্রভাব কী? কারণ, এ দেশে ইমিগ্রেশন ল একটা বড় ফ্যাক্টর। এক পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে রাখার একই দেশে।

সেদিন আলাপ হলো মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী এস্ট্রার সঙ্গে। সে একটি স্কুলে পড়ায়। ৯ বছর ধরে ব্রিটেনে। হাঙ্গেরিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সেটেলমেন্ট স্ট্যাটাস দরকার। সেটার জন্য কিছুদিন আগে আবেদন করেছে। ইমিগ্রেশন বিভাগে তার কেস বিচারাধীন আছে। তার ব্যাকগ্রাউন্ড তদন্ত চলছে।

এস্ট্রার দুশ্চিন্তার কারণ আরেকটি। বছরখানেক আগে এক ভারতীয় ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তারা একসঙ্গে থাকার পরিকল্পনা করে। ব্রেক্সিট তাদের সুখের জীবনে ভিলেন। যে কিনা সিনেমার অমরেশ পুরির মতো প্রেমিক-প্রেমিকাকে আলাদা করে দেবে।

ছেলেটির স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তাকে নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। কাজের জায়গা থেকেও তার ওয়ার্ক পারমিট মিলবে না। তখন এস্ট্রাকে বিয়ে করে দুজন সহজে ব্রিটেনে থেকে যেতে পারত। সেটি এখন সেভেন সামিট জয় করার মতো কষ্টকর হবে।

এস্টার সেটেলমেন্ট ভিসা মঞ্জুর হলে সে তার ফিয়াঁসে মানে প্রেমিকের জন্য আবেদন করতে পারবে। তার আগে কিছু ক্রাইটেরিয়া মানতে হবে। প্রথমত, ছেলেটির স্টুডেন্ট ভিসা শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে তাকে নিজ দেশ অর্থাৎ ভারতে ফিরে যেতে হবে। এস্ট্রা ব্রিটেন থেকে তার জন্য স্পাউস বা ফিয়াঁসে ভিসার জন্য আবেদন করবে। এ জন্য এস্ট্রাকে বছরে আনুমানিক ১৯ হাজার পাউন্ড রোজগার দেখাতে হবে। নয়তো মিনিমাম ৬২ হাজার পাউন্ড রাখতে হবে ব্যাংকে।

সাধারণত ছয় মাস বা তার একটু বেশি সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্ট চায় ইমিগ্রেশন বিভাগ। এর মধ্যে কোনো পাবলিক ফান্ড নেওয়া যাবে না। হাউজিং বেনিফিট, ইনকাম সাপোর্ট বেনিফিট, কিছুই এস্ট্রা নিতে পারবে না। শুধু চাকরি করা নয়। তার এই পরিমাণ রোজগার না থাকলে সে তার পার্টনারের জন্য আবেদন করতে পারবে না। পার্টনার ব্রিটেনে তার সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ পাবে না।

এস্ট্রা আয় করে বছরে ১৫ হাজার পাউন্ড। তাকে আরেকটি কাজ খুঁজতে হবে। সেটা সহজ নয়।

এস্ট্রার টেনশন আমাকেও সংক্রমিত করল। তার সেভিংসও নেই। প্রেমের পরাজয় ইমিগ্রেশন আইনে। ব্রেক্সিটের কাছে। মেনে নেওয়া যায় না। তবু মেনে নিতে হয়।

প্রেমিক ছেলে সুখবিন্দর খুব সিরিয়াস দুজনের সম্পর্ক নিয়ে। সে বলে, কোনো ব্যাপার না। এস্ট্রা তুমি ভারতে চলে আসো। আমরা সেখানে থাকব। এস্ট্রাও সেকেন্ড অপশন খোলা রাখল। কিন্তু লন্ডনের সিটি গার্ল পুরোনো দিল্লির গলিতে নিজেকে খাপ খাওয়াবে কীভাবে? সেটা আরেক বিষয়।

আরেকজন ইতালিয়ান নারী। যিনি ৬০ বছর ধরে আছেন ব্রিটেনে। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতিন আছে তাঁর। তিনি সেটেলমেন্ট ভিসা করেননি। প্রথমে বরিস জনসন বলেছিলেন, ব্রিটেনে বসবাসরত তিন মিলিয়ন ইইউ সিটিজেনকে ইনডেফিনিট পিরিয়ড বা স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করবেন। পরে তিনি তাঁর মত পাল্টান ও সেটেলমেন্ট স্ট্যাটাসের পরিচয় ঘটান।

লেখিকা
লেখিকা

সেই ইতালিয়ান নারী অ্যাপ্লাই করেছিলেন। তাঁকে রিজেক্ট করা হয়েছে। তিনি এখন কী করবেন? পরিবারের সবাইকে রেখে ইতালিতে যাবেন? অবশ্য তিনি আপিল করেছেন। দেখা যাক, কী হয়?

২০২০ সালের মধ্যে ব্রিটেনে থাকতে চাওয়া ইইউ সিটিজেনদের সেটেলমেন্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে। তাদের রাখা না-রাখা এখন হোম অফিসের ইচ্ছা।

রিসার্চ করা তথ্য ও উপাত্ত থেকে রিয়েল হিউম্যানের রিয়েল গল্প বেশি টানে আমাকে। আমি একজন স্টোরি টেলার। গল্প বলতে চাই লেখা দিয়ে। এখন রিয়েল জনগণ ব্রেক্সিটের কারণে ভুগবে বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে ব্রিটেন স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে ক্রাউন পরে থাকবে।

ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গণভোটের (রেফারেনডাম) ভোটের প্রচারণা আসলে অনেক মিসলিড বা মিথ্যাচার দিয়ে শুরু। অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের কথা বলে জনগণকে টোপ দেওয়া হয়েছে। এখানকার হাসপাতাল ও স্কুলে পূর্ব ইউরোপিয়ানদের ভিড় সামলাতে জনগণ ব্রেক্সিট চেয়েছিল। এখন মানবীয় সম্পর্কগুলো অভিবাসীদের ভিড় সামলাতে গিয়ে আলাদা করা হবে। মানসিক যাতনা দেওয়া হবে।

সীমানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মহাকাশ নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামসের কথা মনে করছি। তিনি বলেছেন, মহাকাশ থেকে বিশ্বের সীমানা দেখা যায় না। নিচে নামলে মানুষের তৈরি সীমানা দেখা যায়। আসলেই মানুষের তৈরি সবকিছু জীবনকে কমফোর্টের পাশাপাশি জটিল করে তোলে। ব্রেক্সিট তেমনি এক জটিল প্রক্রিয়া। কুয়াশায় এই জাহাজ নষ্ট নেভিগেশন নিয়ে চলছে। গন্তব্য নিয়ে ভয়ে আছি। আশায় আশায় চেয়ে পথ।