কল্যাণ হোক হে নারী

প্রার্থনা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
প্রার্থনা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

দেবী বিদায় নেবেন। হাতে নৈবেদ্যর থালা নিয়ে নারীরা দেবী দুর্গার সামনে আসেন। সিঁদুর, ফুল, ফল, মিষ্টি, ধান, দূর্বা সাজানো। ঊর্মি হাওলাদার এগিয়ে যান। যথারীতি এগিয়ে চলেন সীমা সাহা। হাত বুলিয়ে উপচার ঠিক করে নেন উল্কা হালদার। ধীরলয়ে হাঁটেন অন্নপূর্ণা চক্রবর্তী। দীপা চৌধুরী অনুসরণ করেন আগের জনকে।

গাছের পাতারা নুইয়ে পড়ছে। পাখিদের কণ্ঠে কান্নার সুর। নারীরা বিদায়কালে দেবীকে সিঁদুরে রাঙিয়ে দেন।

দুর্গা ও দুর্গাপূজাসংক্রান্ত সর্বাধিক জনপ্রিয় কাহিনি হলো দেবী মাহাত্ম্য। এটা মূলত মার্কণ্ডেয় পুরানের একটি নির্বাচিত অংশ। ৭০০ শ্লোকের এই দেবী মাহাত্ম্যই শ্রীশ্রী চণ্ডীগ্রন্থ। সেই আলোকে সনাতনধর্মীদের কাছে দেবী দুর্গা মঙ্গলময়ী, স্নেহময়ী মা। মায়ের পূজা করলেন আল আইনপ্রবাসী সনাতনীরা।

এ পূজা পরিণত হয়েছে উৎসবে। পূজা সনাতনীদের হলেও এখানে এসেছেন ভিন্নধর্মের বন্ধুরাও। আয়োজনে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। মঞ্চে তাঁরা বলেন প্রাণের কথা।

অতিথিবরণ। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
অতিথিবরণ। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব যোবায়েদ হোসেন। অসীম সন্তোষ তাঁর। মনখোলা আনন্দে বলেন, এটি প্রাণবন্ত একটি অনুষ্ঠান।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের আবুধাবি শাখার সভাপতি ইফতেখার হোসেন। বিস্ময়ের চিহ্ন চোখে-মুখে। বলেন, আজকের বিষয়টি বক্তব্যের নয়, উপলব্ধির। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন আয়োজন দেখে চোখে জল আসে।

একই পরিষদের আল আইন শাখার সহসভাপতি আক্তার হোসেন। তাঁরও প্রশংসা, সৌহার্দ্যপূর্ণ এমন পরিবেশ সত্যিই বিরল।

প্রকৌশলী উত্তম কুমার হাওলাদার পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তিনি সঞ্চালনা করেন পর্বটি।

নৈবেদ্য। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
নৈবেদ্য। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাদল রায়। অতিথিদের সঙ্গে সময় দিলেন। মিষ্টিমুখ করলেন। বন্ধুত্বের আলাপ হয়। উৎসব হয়ে ওঠে সবার।

হিন্দু মহাজোট বৈদেশিক শাখা আরব আমিরাতের সভাপতি প্রকৌশলী তপন সরকার পুরাণের সূত্র তুলে ধরেন। প্রবল পরাক্রমশালী সূর্য ও পবন ছিল রাক্ষসদের পক্ষে। কিংবা মহাদেবের ভক্ত হওয়ার পরও রাবণ সীতা অপহরণের পাপ থেকে মুক্তি পাননি। যুদ্ধে রামের কাছে পরাজয় বরণ করতে হলো। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। দুর্গা নামের মাহাত্ম্য এখানেই।

মিন্টু মল্লিক ও সুজন দত্ত অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধ্যায় শিল্পীরা সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেছেন। দেশ থেকে এসেছেন ‘চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ’-এর জনি বড়ুয়া। গাইলেন। মন ছুঁয়ে গেল। তিশা সেন নাচলেন। জয় করে নিলেন।

বন্ধুবরণ। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
বন্ধুবরণ। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

পুরাকালে অসুরদের অত্যাচারে পৃথিবী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবরা ব্রহ্মাকে মুখপাত্র করে যান শিব ও নারায়ণের কাছে। কী দুর্দশা তখন! জেনি ঘোষ আর ইংকিং রায়। সমবয়সী তাঁরা, গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। আগের দিনও এই দুজন প্রণামি সংগ্রহ করেছেন। ছুটেছেন একজন থেকে আরেকজন। প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলেছেন। দেবতারাও বুঝি এভাবে সবার শুভেচ্ছা কামনা করেছেন।

মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনি শুনে দুই দেবতাই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। সেই ক্রোধের সঙ্গে একাকার হয় দেবতাদের দেহনিঃসৃত সুবিপুল তেজ। সৃষ্টি হয় মহাতেজের। সুউচ্চ হিমালয়ে সেই তেজপুঞ্জ একত্র হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করে। ইনিই দুর্গা। দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে দেবতাদের দুর্গতি নাশ করেন। পৃথিবীতেও একই ভূমিকা তাঁর।

দেবী কৈলাস থেকে পরিবারসহ বাপের বাড়িতে এসেছিলেন। মহাদশমী। বিজয়া। আজই ফিরবেন শ্বশুরবাড়ি। সেই সুর আজ চতুর্দিকে। বিদায়ী বাদ্য বাজছে। ঢ্যাড্যা নাকর নাকর ঢ্যাং...। সেই সঙ্গে ছোটন চক্রবর্তীর মন্ত্রধ্বনি। ধূপের গন্ধময় পরিবেশ। ঘণ্টা আর কাঁসরের শব্দ।

মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

পূজায় অবারিত প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে। সৎ সংঘ, মরুতীর্থ গীতা সংঘ, লোকনাথ সেবাশ্রম এই দায়িত্ব নিয়েছিল। মারখানিয়া গীতা সংঘও রেখেছে ব্যাপক অবদান। এ নিয়ে অলক কর্মকার ও চন্দন দাস ছিলেন সার্বক্ষণিক। শুধু প্রসাদ নয়, সব বিবেচনায় উদ্‌যাপন পরিষদের আপ্যায়ন দর্শনার্থীদের মন কেড়েছে।

প্রকৌশলী বিকো রায়। দেখামাত্র ছুটে এলেন। নিয়ে গেলেন একটি ব্যানারের কাছে। সস্ত্রীক দাঁড়ালাম। সেখানে ছিলেন ‘চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ’-এর জনি বড়ুয়া। পরিচয় হলো। তাঁদের বন্ধুর সম্পর্ক। শুভেচ্ছা বিনিময় করি। অতঃপর সবাই মিলে বন্দী হই ছবির কবির কাছে।

যেখানে চোখ যায়, সৌন্দর্যের তরঙ্গ। শুভদ্রা শীল। দারুণ মেধাবী। নিজস্বীতে বেঁধে ফেলেন সময়কে। আরেকজন সোনিয়া চৌধুরী। দুবাই থেকে এসেছেন। তাঁরও সমান হাত। হাসিতে ভরপুর প্রিয়াঙ্কার মুখ। বাধাহীন তাঁর চলা। ঢাক বাজাতে গিয়েছি আমি। ওমা, তরুণী দেখছি ওস্তাদ, আমাকে শেখালেন। এক দুই তিন...এক হাতে। তারপর দ্রুতই অন্য হাতে...চার। এইভাবে এক দুই তিন চার...। শিল্পী চৌধুরী বাজিয়েছেন কাল। তখন কাঁসর ছিল নীপা পালের হাতে। তাল, লয়, ছন্দের সে যে অপূর্ব মিলন!

মায়ের বিদায়লগ্নে এবারও কিশোর চক্রবর্তী স্মরণ করিয়ে দিলেন ভক্তদের শেষ চাওয়ার কথা। দেবী দুর্গা বিদায় নিচ্ছেন। সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। কাজেই সেখানে নিজের বা অন্যের কল্যাণে ভক্তরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষার কথা বলতেই পারেন। তাঁরা প্রাণের উচ্চারণ করলেন। রূপং দেহি, যশং দেহি, ধনং দেহি, জ্ঞানং দেহি। কাঁদলেন, জানালেন হৃদয়ের আকুলতা।

শেষ দিন বিজয়মঞ্চে এলেন তাঁরা। উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রমল কিশোর নাথ। তাঁকে নিয়ে এক সারিতে দাঁড়ালেন। হল পাচ্ছিলেন না একসময়। বলাবলি হলো, নানা কৌশলে তাঁরা সে বাধা অতিক্রম করে এসেছেন। একদল তরুণ সার্বক্ষণিক ছিলেন এই আয়োজনে।

উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত
উদ্‌যাপন পরিষদের সদস্যরা। ছবি: নিমাই সরকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত

পঙ্কজ ঘোষ ও শংকর নাথ ছুটেছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। অর্থ সংগ্রহের মতো কঠিন কাজটি করেছেন। সুজন শর্মা র‍্যাফেল ড্র নিয়ে নেমে গেছেন বন্ধুদের মধ্যে। মিহির শর্মা, বিকাশ বড়ুয়া, বিপ্লব ভৌমিক, সঞ্জয় পাল ছিলেন নিবেদিত। উপদেষ্টা মিঠু দে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন।

নারীরা সিঁদুরে রাঙিয়েছেন দেবীকে। আবার নিজেদের মধ্যে একজন রাঙালেন অন্যজনকে। সিঁদুর যে কল্যাণের প্রতীক। সিঁদুর রাঙানোর শুরু সীমা সাহা বা ঊর্মি হাওলাদারের হাতে। তবে এই আনন্দের সঙ্গে অন্যরা এককাট্টা। শর্মী নাগ ও মুন্নী কর্মকার এগিয়ে এলেন। দুবাইয়ের মুক্তি সাহা, মৌসুমি ভট্টাচার্য ও শীলা দাস শামিল হলেন এখানে। তাঁরা একজন আরেকজনকে রাঙিয়ে দিচ্ছেন।

এক নারী কল্যাণ কামনা করছেন আরেক নারীর। একজন আরেকজনকে ধরে ছবি তুলছেন। নিজস্বীতে বন্দী হচ্ছেন। আমরাও শুভেচ্ছা পড়ছি মনে মনে। কল্যাণ হোক তোমার, হে নারী।