নীরবতাই সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়

আবরার হত্যার প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: জান্নাতুল মাওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত
আবরার হত্যার প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: জান্নাতুল মাওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত

গত বেশ কয়েকটা দিন আমি একই সঙ্গে দুটি জগতে ঘুরপাক খাচ্ছি। প্রতি সকালে সোনা–মিঠে রোদ পিঠে মাখতে মাখতে ক্লাসে যাচ্ছি। সপ্তাহ শেষের উদ্দাম হইচইয়ের পরে নতুন সপ্তাহ শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা। সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লাসে যাচ্ছে। ইউনিয়নে একের পর এক বাস আসছে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর শান্ত দিন।

এদিকে আমার হাতের ছোট্ট মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক খুলেই টুপ করে চলে যাচ্ছি অশান্ত–অস্থির একটা দিনে। যেখানে সবাই কাঁদছে। হাহাকার করছে। ভয়ে মুখ শুকনো করে রেখেছে। নানান রকম নির্যাতনের গল্প পড়ছি। মাথা ফাঁকা হয়ে গেলে আবার মোবাইল অফ করে শান্ত শহর দেখছি। একঝটকায় এতটা দূরত্ব পেরোতে খুব কষ্ট হচ্ছে। হাঁপিয়ে উঠছি।

লরেন্স নামের ছোট্ট এই পাহাড়ি শহর মূলত গড়েই উঠেছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসকে কেন্দ্র করে। গত বছর যখন যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরে পড়তে আসি, আমার মাথায় ছিল অ্যাকটিভিস্টের পোকা। আমি শুধু ভাবছিলাম, কী করে আমার গবেষণা আর অ্যাক্টিভিজম এক সুতোয় গাঁথা যায়।

আমি পড়ছি ধর্ম নিয়ে। ধর্মের নানান বিষয়ে চূড়ান্ত অবজেকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা করাই আমার কাজ। অথচ আমি জানি, এই অসাধারণ আনন্দময় কাজটাই আমার জন্য কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে আমার নিজের দেশে।

হয়তো এই জানা থেকেই গবেষণার পাশাপাশি মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার তাগিদ ভেতরে-ভেতরে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি। সেই অনুভূতি থেকেই গবেষণার পাশাপাশি আমার অ্যাকটিভিস্ট সত্তা আমাকে আন্তধর্মীয় সংলাপ-সম্প্রীতি, বাক্‌স্বাধীনতার জন্য গণসচেতনতা বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে পরিচালিত করে।

আমার এই ধরনের প্রবণতা দেখে একদিন আমার প্রফেসর বললেন, ‘জান্নাতুল, একজন গবেষকের উচিত চূড়ান্তভাবে গবেষণায় মনোনিবেশ করা, নইলে তার মতামত দ্বারা তার গবেষণা প্রভাবিত হতে পারে।’

সেদিন থেকে আমি নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করছি। জনমত তৈরির কাজ আমার নয়। আমি গবেষক। এই ধারণাকে মাথায় গেঁথে নিয়ে নিজের চারপাশে একটা আরামদায়ক দেয়াল তুলছি বসে বসে। যেন কেউ সেই দেয়াল মাড়িয়ে টুক করে আমার চিন্তার চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে আমার দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার বারোটা বাজাতে না পারে। সে জন্যই এই সতর্কতা।

কিন্তু আবার থমকে দাঁড়াতে হলো। অন্তরে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে বসে বসে ভাবছি, কোন জগৎটা ঠিক আমার? যুক্তরাষ্ট্রের এই শান্ত–নিরবচ্ছিন্ন ক্যাম্পাস নাকি আট হাজার মাইল দূরের একটা অশান্ত বিক্ষোভে মেতে ওঠা দেশ?

আমি দুইটা জগতেই একই সঙ্গে আছি।

ইউনিয়নে বসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে আমি পড়ছি, শুনছি, দেখছি, কীভাবে এক মা এক সকালে ছেলেকে নিজের হাতে জামা পরিয়ে ঢাকায় পড়তে পাঠালেন। আর পরদিন সকালের আলো ফোটার আগেই পেলেন ছেলের মৃতদেহ। মা কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘চালের রুটি আর মাংস দিয়েছিলাম সঙ্গে, আমার ছেলে মনে হয় খেতেও পারেনি সেই খাবার। ওরা আমার ছেলেকে খেতেও দেয়নি।’

এক হাতে মুখে খাবার তুলছি আর আরেক হাতে চোখের পানি মুছছি।

আবরার হত্যার প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: জান্নাতুল মাওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত
আবরার হত্যার প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ছবি: জান্নাতুল মাওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত

সেদিন শুকনো মুখে ঢুকলাম একটা মিটিংয়ে। প্রফেসর বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’ আমি বললাম, কিছু না, আমি ভালো আছি। আমার আসলে কী হয়েছে? কিছু হয়নি তো। সেই সময় আমাদের এখানে আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী টাইন আমাকে মেসেজ দিয়ে বলল, ‘আপু, সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছেলেমেয়েরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমরাও কি জানাতে পারি?’

একবার ভাবলাম, কী হবে এসবে? আমাদের একটুখানি প্রতিবাদ আট হাজার মাইল দূরের ওই শহরের মানুষগুলোকে কি শান্তি দিতে পারবে? তারপর মনে হলো, না, অন্তত আমরা আমাদেরই বলব, আমরা শুধু বসে বসে চোখের জল ফেলিনি, আমরা সবাই মিলে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের আপনজনদের নিরাপদে রাখার জন্য আমরাও তাদের পাশেই মুষ্টিবদ্ধ হাতে দাঁড়িয়েছিলাম।

সবাই মিলে একসঙ্গে লাল, নীল কাগজে স্লোগান লিখলাম; ‘আমাদের নীরবতাই পরবর্তী সন্ত্রাসীর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তাই হোক প্রতিবাদ’, ‘যেখানে বাক্‌স্বাধীনতা নেই, সেখানে মুক্তি নেই’, ‘আমরা চাই আমাদের মানুষেরা নিরাপদে থাকুক’।

তারপর ব্যানার হাতে নিয়ে ১৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসের বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়ালাম। আমরা এই শান্ত শহর আর ওই অশান্ত শহরকে এক সুতোয় গাঁথলাম। অ্যাক্টিভিজম আর একাডেমিয়াকে পাশাপাশি হাত ধরিয়ে দাঁড় করালাম।

আমার প্রফেসরের ক্ষেত্রে তাঁর কথাই হয়তো ঠিক। তিনি এমন একটা শিক্ষাঙ্গন পেয়েছেন, এমন একটা দেশে পূর্বসূরিরা তাঁকে দিয়ে গেছেন, যেখানে তিনি মুক্তভাবে কথা বলতে পারবেন, লিখতে পারবেন, গবেষণা করতে পারবেন।

আমার জন্য এটা খুব কঠিন। আমি বা আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানে এখনো লেখালেখির জন্য মানুষকে খুন করে ফেলা হয়। আমাদের পথ খুব কঠিন। শুধু নির্জলা গবেষক হওয়া আমাদের জন্য খুব বড় ধরনের বিলাসিতা।