বউয়ের মন খারাপ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলবেলা অফিস থেকে বাসায় ফিরে বেডরুমে গিয়ে দেখি, বউ চুপচাপ শুয়ে আছে। টিভি বন্ধ। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ, সাধারণত যতক্ষণ সে জেগে থাকে, টিভি চালু থাকে। বুঝলাম হয় মন খারাপ, না হয় শরীর খারাপ। ঠিক করলাম, কথা বলে বা ফান করে তার মন ভালো করার চেষ্টা করব।

কাছে গিয়ে কোমল স্বরে বললাম, জান, শুয়ে আছ কেন?

: কেন আমি কি ঘোড়া যে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব।

: দাঁড়াও ভালো করে দেখে তারপর বলি। ঝটপট উত্তর দেওয়া ঠিক না। ভালো করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললাম, না তোমাকে তো ঠিক ঘোড়ার মতো মনে হচ্ছে না।

: তুমি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছ?

: ফাজলামি কেন করব। তুমিই তো প্রশ্ন করলে তুমি ঘোড়া কি না। আমি ভাবলাম তুমি হয়তো তোমার আইডেনটিটি নিয়ে কনফিউজড। তাই তোমাকে ভালো করে দেখে তোমাকে কনফার্ম করলাম যে তোমাকে ঘোড়ার মতো লাগছে না। তোমার তো আরও খুশি হয়ে আমাকে ধন্যবাদ বলা উচিত। অথচ তুমি রাগ করছ।

: মাই গড, এই ব্যাটা এত কথা বলে কেন?

: শোনো, আল্লাহ মুখ নামক মেশিনটি দিয়েছেন কথা বলার জন্য। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মেশিন সব সময় চালু রাখতে হবে। না হলে মরিচা ধরে যাবে।

: তুমি তোমার মেশিন চালু রাখতে চাও রাখ। আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা আমার বাসায় না। তুমি রাস্তায় যাও। ওখানে গিয়ে পাবলিকের সামনে লেকচার দাও আর চুলকানির মলম বিক্রি কর।

: বুদ্ধিটা অবশ্য খারাপ দাওনি। কিছু বাড়তি পয়সা ইনকাম হবে আর মুখটাও চালু থাকবে। কিন্তু সমস্যা হলো কোন কোম্পানির মলম বিক্রি করব? আমার তো কোনো ধারণা নেই। আচ্ছা, তুমি ব্যবহার করেছ, এমন একটা চুলকানির মলমের নাম বল তো। ওইটা এক কার্টুন কিনে নিয়ে এসে বিক্রি করি।

: বদমাশ ব্যাটা বলে কী! আমারে দেখে কি তোমার মনে হয় আমার ওই ধরনের পচা অসুখ ছিল?

: শোনো, চাপা মারবা না। বাংলাদেশের কোনো মানুষ বলতে পারবে না, জীবনে তার একবারও চুলকানি হয়নি।

: শয়তান ব্যাটা তুই বাইর হ আমার বাসা থেকে।

: জান, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?

: খবরদার জান জান করবা না।

: ঠিক আছে করব না। সোনাপাখি, বলো না তোমার কী হয়েছ?

: তুমি আমাকে সোনাপাখি বলছ কেন?

: আচ্ছা তোমার সমস্যা কী বলবা তো। আমি ভালোবেসে তোমাকে যা–ই বলছি, তুমি রিঅ্যাক্ট করছ। জান বললেও সমস্যা, সোনাপাখি বললেও সমস্যা। তাহলে ভালোবেসে তোমাকে আমি কী বলব, সানি লিওনি?

: মাই গড তোমার চরিত্র তো দেখি ভয়াবহ রকমের খারাপ। হঠাৎ মুখে সানি লিওনির নাম। বদ ব্যাটা, সানি লিওনির জন্য কি মনটা আঁকুপাঁকু করে?

: দেখ, তুমি কিন্তু আমাকে চরিত্রহীন প্রমাণের চেষ্টা করছ। আমার মতো একজন সহজ–সরল মানুষকে এ ধরনের অপবাদ দিয়ো না। খোদা সইবে না। আচ্ছা, তুমিই বলে দাও তোমায় আমি কী বলে ডাকব?

: তুমি আমাকে কোনো কিছু বলেই ডাকবা না।

বউ চিৎকার করে কথাগুলো বলল। আমি এখন শিওর তার আসলেই মন বা শরীর খারাপ। না হলে এভাবে কথা বলার কথা নয়। কারও শরীর খারাপ বলতে কেন জানি আমি জ্বরকেই বুঝি। তাই তার কপালে হাত দিয়ে বললাম, আমার ধারণা তোমার শরীর খারাপ। তোমার কি জ্বর হয়েছে?

: কেন, তুমি কি ডাক্তার? আমাকে ওষুধ দিবা?

: তা না। অসুখের ধরন বুঝতে পারলে তোমার একটু সেবা করতাম এই আর কী।

: খবরদার, ঢং করবা না।

: আমি তো ঢং করছি না। আমি তোমার কুশল জিজ্ঞেস করছি।

: তুমি কুশলও জিজ্ঞেস করবা না।

: তা হলে কী করব?

: তুমি কী করবা তা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?

: জিজ্ঞেস করছি, কারণ, আমি কী করব তুমি যদি সে ব্যাপারে একটু আইডিয়া দিতে তা হলে ভালো হতো। এই একটু পরামর্শ নেওয়া আর কী।

: কেন আমি কি তোমার উপদেষ্টা, যে তোমারে আইডিয়া দেব?

: অবশ্যই তুমিই আমার উপদেষ্টা, তুমিই আমার বুদ্ধিজীবী, তুমিই আমার সব। কবিতার সুরে বললাম।

: খবরদার তোমারে না বলছি, আমার সঙ্গে কবিতার সুরে কথা বলবা না। আর আমার সঙ্গে ফান করবা না।

: আমি তো ফান করছি না। আমি তোমার মন ভালো করবার চেষ্টা করছি।

: আমি কি তোমাকে আমার মন ভালো করার জন্য অনুরোধ করেছি?

: তা করোনি। তবে স্বামী হিসেবে তোমার মন ভালো রাখা তো আমার সৌমিক দায়িত্ব।

: সৌমিক দায়িত্ব মানে?

: সৌমিক দায়িত্ব মানে স্বামীর দায়িত্ব। শোনো চুপচাপ শুয়ে না থেকে উঠে বস। কথা বলো, দেখবে ভালো লাগছে।

: আমাকে কি তুমি একটু একা থাকতে দেবে, প্লিজ। বউ করুণ স্বরে অনুরোধের সুরে বলল।

: একা থাকবা কেন? বিয়ে করেছ কি একা থাকার জন্য?

: এই ব্যাটা তোর সমস্যা কী? সেই তখন থেকে জ্বালাচ্ছিস। বিয়ে করেছি বলে কি একটু একাও থাকতে পারব না? আমার কি কোনো স্বাধীনতা নেই? ব্যাটা স্বৈরশাসক।

চিৎকার করে কথাগুলো বলে শোয়া থেকে উঠে বসল। বুঝলাম, এখন আর এখানে বসে থাকাটা নিরাপদ নয়। তাই চুপচাপ রুম থেকে চলে এলাম। ভেবেছিলাম কথা বলে ফান করে তার মনটা ভালো করব। কিন্তু সে ভাবল, আমি তাকে বিরক্ত করছি।

বেডরুম থেকে বের হয়ে মেয়ের রুমে উঁকি দিলাম। দেখলাম সে ফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত। ভাবলাম, মেয়েটারে একটু জ্বালাই। কারণ, বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকার কোনো মানে হয় না। মেয়ের রুমে ঢুকে সুর করে বললাম, মা, তুমি কী করো?

ফোনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে সে–ও সুর করে উত্তর দিল, বাবা তোমার কী মনে হয়?

মাই গড, এই মেয়ে তো দেখি দিন দিন ফাজিল হয়ে হচ্ছে। আমাকে নকল করে কথা বলছে। আজকালকার বাচ্চাগুলোর যে কী হয়েছে, যতক্ষণ জেগে থাকে ফোন, কম্পিউটার বা আইপ্যাডের দিকে তাকিয়ে থাকে। সারাক্ষণ গেম আর গেম।

একটু খোঁচা মেরে বললাম, আমার তো মনে হচ্ছে তুমি পড়ালেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত।

: বাবা তুমি কিন্তু আস্তে আস্তে খুবই বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছ। তুমি দেখছ আমি গেম খেলছি। অথচ তুমি বলছ আমি পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। তুমি এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলছ কেন?

: এই তুই তো দেখি দিন দিন তোর মায়ের মতো হয়ে যাচ্ছিস।

: বাবা, এটা কী ভালো অর্থে বললে নাকি খারাপ অর্থে?

: অবশ্যই খারাপ অর্থে।

: মা, বাবা তোমাকে খারাপ মহিলা, বদ মহিলা বলে গালি দিচ্ছে।

মেয়ে কথাগুলো চিৎকার করে বলতে লাগল।

: মাই গড, তুই তো দেখি পুরা ঘষেটি বেগম হয়ে গেছিস।

; বাবা ঘষেটি বেগম কী ভালো না খারাপ?

: অবশ্যই খারাপ।

: মা, বাবা তোমাকে ঘষেটি বেগম বলেছে।

আবারও চিৎকার করে বলল। বুঝলাম, এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। এই মেয়ে এখন একটা যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা করছে। তাড়াতাড়ি মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম। বুঝতে পারছি না এখন কী করব। ঠিক করলাম, একটু চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করি। ড্রয়িংরুমে বসে ডেস্কটপ কম্পিউটার চালু করলাম। এরপর কানে হেডফোন দিয়ে ইউটিউবে ক্যাটরিনার চিকনি চামেলি গানটি ছাড়লাম। এরপর গানের তালে তালে মাথা দোলাতে লাগলাম আর শরীর ঝাঁকাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে খেয়াল করলাম বউ ড্রয়িংরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। জানি না সে কখন এ রুমে এসে ঢুকেছে। চোখাচোখি হতেই কাছে এসে টান দিয়ে হেডফোন খুলে ফেলল।

এরপর ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, তোমার সমস্যা কী?

: কোনো সমস্যা নেই, আমি একদম কুল।

: তুমি কুল? তা মৃগীরোগীর মতো তোমার শরীর কাঁপছে কেন?

: কই কাঁপছে? আমি তো গানের তালে তালে শরীর ঝাঁকাইতেছিলাম।

: তা তুমি শরীর ঝাঁকাইতেছিলে কেন?

: আরে এটা তো একধরনের নাচ।

: এটা নাচ? শরীরকে মৃগীরোগীর মতো বাঁকানোকে নাচ বলে? আর তুমি বুইড়া ব্যাটা নাচার কী দরকার। আমি বুঝি না তোমার মনে এত আনন্দ আসে কোথা থেকে? দুনিয়ার কোনো দুঃখ-কষ্ট কি তোমাকে স্পর্শ করে না?

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, এই, এটা তুমি কী দেখছ?

: ক্যাটরিনার চিকনি চামেলি গানটি দেখছি। জানো এখানে ক্যাটরিনাকে যা হট লাগছে না! মনে হচ্ছে একেবারে চিকনি জাওয়ানি।

: মাই গড, বদমাশ ব্যাটা বলে কী! বউয়ের মন খারাপ আর বদমাশ ব্যাটা ব্যস্ত ক্যাটরিনার জাওয়ানি নিয়ে। দাঁড়াও, তোমারে আমি বেগানা মহিলার জাওয়ানি দেখাচ্ছি।

বলেই কম্পিউটারের পাওয়ার প্লাগ খুলে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। বুঝলাম না এই মহিলার সমস্যা কোথায়। মাঝেমধ্যে মনটায় চায়...।

বউ এভাবে কম্পিউটার বন্ধ করে আমার চিত্তবিনোদনে ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে একটু হতাশ হলাম। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বন্ধ কম্পিউটারের সামনেই বসে রইলাম। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই মাথায় একটা পরিকল্পনা এল। কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে বেডরুমে গেলাম। এরপর বেডরুমের ক্লোজেট থেকে একটি শাড়ি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।

শাড়িটা বউয়ের সামনে ধরে শান্ত গলায় বললাম, নাও, তাড়াতাড়ি এই শাড়িটা পরে ড্রয়িংরুমে চলে আসো।

: মানে কী! আমি এখন শাড়ি পরব কেন? ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

: কারণ, তুমি এখন শাড়ি পরে আমার সামনে চিকনি চামেলি গানের তালে তালে ক্যাটরিনার মতো করে নাচবে আর আমি দেখব। আর শোনো, এটা কিন্তু ফান না, আমি সিরিয়াস।

: মাই গড, এ ব্যাটার মাথা তো পুরাই গেছে। একে তো এখন ডাক্তার দেখানো দরকার।

: শোনো, এসব বলে কোনো লাভ হবে না। যেহেতু তুমি চাও না আমি বেগানা নারীর নাচ দেখি। তাই তোমার কথামতো আমি ঠিক করছি এখন থেকে বেগানা নারীর নাচ আর দেখব না, তোমার নাচ দেখব। যখনই আমার নাচ দেখতে মন চাইবে, তখনই তুমি বলা মাত্র আমার সামনে নাচবে। এই মুহূর্তে আমার চিকনি চামেলি গানটি দেখতে খুবই মন চাচ্ছে। তুমি এখন এই গানের তালে আমার সামনে নাচবে আর আমি সোফায় কাত হয়ে বসে তোমার নৃত্য দেখব আর আঙুর খাব।

দেখলাম ভুরু কুঁচকে চোখমুখ সরু করে আমার দিকে কীভাবে জানি তাকিয়ে আছে।

: ভুরু কুঁচকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? শোনো, ক্যাটরিনা কিন্তু এভাবে তাকায় না। ভুরু সোজা কর। আর ক্যাটরিনার মতো চোখে মাদকতা আনো।

খেয়াল করলাম, বউ নিষ্পলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর এদিকে আস্তে আস্তে সামনে রাখা বঁটির দিকে হাত বাড়াচ্ছে। বুঝলাম অবস্থা সুবিধার নয়।

একটা ঢোক গিলে মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, জান, তুমি কি আমাকে এখন বঁটি দিয়ে কোপ দেওয়ার চিন্তা করতেছ?

বউ বঁটিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয়?

: নাচ পারো না বললেই তো হয়। বঁটি নেওয়ার কী দরকার।

দেখলাম, বঁটি হাতে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম আমার নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। দেরি না করে উল্টো ঘুরে বেডরুমের দিকে দৌড় দিলাম। কারণ, এই ডাকাত মহিলার ওপর কোনো বিশ্বাস নেই। যেকোনো সময় কোপ দিয়ে ফেলতে পারে।

বি. দ্রষ্টব্য: স্ত্রীর মন ভালো করার বা ভালো রাখার দায়িত্ব তার স্বামীর। কীভাবে করবেন, সেই পদ্ধতি আপনাকেই বের করতে হবে। কখনো আপনি সফল হবেন, কখনো হবেন না। তবে চেষ্টা করুন সব সময় তাকে হাসিখুশি রাখতে।

বি. দ্রষ্টব্যের বি. দ্রষ্টব্য: মেয়েরা নাকি সেই ছেলেদের পছন্দ করে, যাদের সেন্স অব হিউমার ভালো। সবাই বলে আমার নাকি সেন্স অব হিউমার খুবই ভালো। কিন্তু আমার বউয়ের ধারণা, আমি একজন জোকার শ্রেণির মানুষ। আমার নাকি আসলে সার্কাস দলে অথবা চিড়িয়াখানায় বান্দরের সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। আমি নাকি ভুল করে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে এসেছি। আফসোস, স্ত্রী মানুষ চিনল না।
–––

লেখকের ই–মেইল: <[email protected]>