প্রার্থনা আর মঙ্গল সংগীতের শারদীয় আয়োজন

দেবী দুর্গা। ছবি: নিমাই সরকার
দেবী দুর্গা। ছবি: নিমাই সরকার

মানুষ হাঁটছে। গতি তার সামনে। আমরাও চলছি। সবার গন্তব্য ইন্ডিয়া সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। বাঁয়ে প্রধান দরজা দিয়ে প্রবেশ। তারপর ডানে শেষের দিকে যাই মণ্ডপ চত্বরে।

চকচক করছে দেবী দুর্গার প্রতিমা। ভক্তরা আসছেন। মাথা নোয়াচ্ছেন দেবীর উদ্দেশে। কাঁসর, ঘণ্টা, শঙ্খ বাজছে। তমাল চট্টোপাধ্যায় মন্ত্র পড়ছেন। ধূপ দীপে প্রকৃতি পূজাময় হয়ে উঠছে।

প্রার্থনা। ছবি: নিমাই সরকার
প্রার্থনা। ছবি: নিমাই সরকার

নর–নারীরা হাতে ফুল বিল্বপত্র নিচ্ছেন। উচ্চারণ করছেন প্রাণের মন্ত্র। দুর্গা মায়ের কাছে প্রকাশ করছেন নিজের চাওয়া। মঙ্গল কামনা করছেন তাবৎ মানুষের জন্য। ফুল–পত্র এগিয়ে দিচ্ছেন দেবীর পাদপদ্মে। আশীর্বাদে সিক্ত হচ্ছেন তাঁরা।

দুর্গাপূজার এ উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে আবুধাবির ভারতীয় বাঙালি সমাজ। আমরা সেখানকার অতিথি। নাট্যজন জয়দীপ চক্রবর্তী। হলে ঢুকতেই দেখা হলো। কয়েক দিন আগে তাঁর একটি ফোন। এবার বাংলাদেশ স্কুলের অডিটরিয়ামে তাঁর পরিচালনায় দুটো নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। ওই দিন নাটক ও শারদীয় পূজা, দুই আয়োজনেই আমন্ত্রণ জানালেন। আজ কুশল বিনিময় হলো।

শারদীয় আয়োজনে মঙ্গল কামনা। ছবি: নিমাই সরকার
শারদীয় আয়োজনে মঙ্গল কামনা। ছবি: নিমাই সরকার

মহাষষ্ঠীতে এসেছি। সেদিনের দর্শন, কর্মীর হাত। দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে কলাকর্ম। মৌসুমি মুখার্জি ওপরে দাঁড়ানো। তাঁর হাতে কাটা কাগজ তুলে দিচ্ছেন নীতা ঘোষ। সুমিতা দত্ত, সোনালি হালদার, পল্লবী সেন শর্মা নিচে। তাঁরা সে সবে আঠা লাগিয়ে আগেই ধরিয়ে দিচ্ছেন টেবিল থেকে। প্রতিমা নির্মাণেও তাঁদের আছে অনেক অবদান।

দেবাশীষ মান্না। স্থাপত্যবিদ্যায় লেখাপড়া। তিনি এবারের দুর্গামূর্তি নির্মাণের পেছনের গল্প বললেন। জানালেন, পূজার প্রতিপাদ্য, আমি বাংলায় গান গাই।

দেয়ালজুড়ে যামিনী রায় ও নন্দলাল বসুর শিল্পকর্ম। শিল্পীর সৃষ্টি দিয়ে ঢেকেছেন হলের তিন পাশ। টাকার জলছাপের মতো উপস্থাপনা। ওপরে জনপ্রিয় গানের অংশবিশেষ। সম্পর্কযুক্ত লেখক বা শিল্পীর ছবি কেটে কেটে বসানো সেখানে। দেয়াল পড়ি। নজরুলের চিরচেনা ঝাঁকড়া চুল। ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’। রজনীকান্তের মুখ। পাশে ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। দ্বিজেন্দ্র লাল রায়, সেখানে আছে, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’।

শারদীয় আয়োজনে বন্ধুরা একসঙ্গে। ছবি: নিমাই সরকার
শারদীয় আয়োজনে বন্ধুরা একসঙ্গে। ছবি: নিমাই সরকার

পড়ি কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। দেখেছ কী তারে ওই নীল নদীর ধারে বৃষ্টি পায়ে-পায়ে। কিংবা শ্রেয়া ঘোষাল। দেখে নিই। বাংলাই আমার জীবনানন্দ বাংলা প্রাণের সুখ। আমি একবার দেখি বারবার দেখি বাংলার মুখ। ১৬টি বোর্ড ৩৫টি একক মুখ। আরও আছে যৌথ অবয়ব।

রামায়ণের কথা বলছি। রাক্ষস রাজা রাবণ নিধনে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন শ্রীরাম। তখন ছিল শরৎকাল। পুরাণে আছে, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জানালেন, দুর্গাপূজা ছাড়া উপায় নেই। ব্রহ্মা স্বয়ং যজমানি করলেন রামের পক্ষে। তখন দেবতাদের নিদ্রার সময়।

ব্রহ্মার স্তবস্তুতিতে জাগ্রত হলেন দেবী মহামায়া। ব্রহ্মা বললেন, রাবণ বধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগিয়েছি। যত দিন না রাবণ বধ হয়, তত দিন তোমার পূজা করব। আজ আমরা তোমাকে জাগ্রত করে পূজা করলাম। এমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে।

একটি দৃশ্য। পূজা করছেন পুরোহিত। ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। পারমিতা উইশ উইং শরীর মনের সবটুকু জোর দিয়ে শঙ্খ বাজাচ্ছেন। অন্যদিকে ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হচ্ছে পরিবেশ। বাজাচ্ছেন প্রহ্লাদ রায় ও সোনা ব্যানার্জি। ধূপের গন্ধে ম–ম। মনে হয়, দারুণ কোরাসে ফেটে পড়ে ভক্তের প্রার্থনা। কলুষতা মুক্ত করো। মাতৃরূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে আশীর্বাদ করো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে। বিনাশ করো আমাদের পশুর প্রবৃত্তিকে।

শারদীয় আয়োজনে মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকার
শারদীয় আয়োজনে মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকার

এদিকে ভোগের প্রসাদ নিয়ে ছোটেন কৌশিক সেন। কথা হয় প্রদীপ সেন শর্মার সঙ্গে। তিনি পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে ভক্তদের সামনে এলেন। এর উত্তাপ নিলেন। শান্তির পরশ মাখলেন দেহমনে। এরই মধ্যে মৌলিমা রায় এলেন। সঙ্গে তাঁর নাচের কন্যা। দৌড়ে এল আমার দিকে। আমি তার নৃত্য নয় শুধু, জীবনের উন্নতি কামনা করি।

মহাঅষ্টমীতে দেখা হলো ড. স্বদেশ সাহার সঙ্গে। পুষ্পাঞ্জলির পর কথা হলো। দেখি, একদল সহকর্মীসহ পার্থ কুণ্ডু, সুজন পালন। তাঁরা ছবি তুললেন। অবন্তি সেনগুপ্ত পূজার আয়োজনে যুক্ত। মাইক্রোফোনে অঞ্জলি দেওয়ার আহ্বান আসছে। দলে দলে অংশ নিচ্ছেন ভক্তরা এ পর্বে।

মহানবমীর দিন। লাকি হালদার উল্কা নৈবেদ্যর থালা রাখলেন দেবীর পাদপদ্মে। পূজামণ্ডপে সোম দত্ত বাগ ব্যস্ত ছিলেন পূজার উপচার গোছানোর কাজে। । দেখা মাত্র ছুটে এলেন। উল্কার হাতে তুলে দিলেন সিঁদুরের কৌটা। এ এক ভালোবাসা। এ যে কল্যাণ কামনা।

চৈতালী চক্রবর্তী টেবিলে বসা। কথা বলছেন গৌর ব্যানার্জি। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বললেন, চেনেন এই নারীকে। চিনি তবে কীভাবে উত্তরটি দেওয়া যায়। তিনি মূল মূল কাজে আছেন। হ্যাঁ, সব্যসাচী নামটা জুতসই। ঠাস করে বলে দিলাম। হাসলেন সবাই। শর্মিষ্ঠা পাঞ্জাবি ছিলেন সেখানে।

শারদীয় আয়োজনে মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকার
শারদীয় আয়োজনে মিলনমেলা। ছবি: নিমাই সরকার

দিব্যেন্দু দত্ত চৌধুরী দাঁড়িয়ে। তাদের আদি বাড়ি চাঁদপুরের তুলাতুলি গ্রামে। বললেন, ইচ্ছে হয় একটু দেখে আসি। সোনা ব্যানার্জির মিষ্টিমুখ। জানালেন, বিক্রমপুরের আউলিয়া গ্রাম তাঁর পূর্বপুরুষের। সুদীপ্তা কুণ্ডুরও মূল ঠিকানা শরীয়তপুরের পল্লি। বলি, আসুন, ঘুরে যান।

ব্রহ্মাকে রাবণ বধে চণ্ডিকা দেবী একটি কর্মসূচি দিয়েছিলেন। সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণ মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী–নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশ মুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশ মুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।

পৃথ্বীনাথ মুখার্জি বড় নান্দনিক। সঙ্গে একদল বন্ধু। ক্লিক ক্লিক! ক্যামেরা জ্বলে উঠল। একরাশ ভালোবাসা জানালেন। সঙ্গে সতর্ক বার্তা। এ ছবি প্রথম আলোতে চাই। নইলে খবর আছে! টুটুন নন্দী, পিয়ালী রায় মুখ টিপে হাসেন। আমি ভাবি, খবরের দায়িত্ব এমন যোগ্যদের হাতে গেলে খারাপ কী!

দুবাই থেকে এসেছেন সুব্রত মজুমদার ও চন্দনা মজুমদার। সঙ্গে এক বহর। পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিষ্টি হাসির রাখি রায়, প্রজ্ঞা পারমিতা, সংঘ মিত্রা দত্তের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়েছে। ঝুমা বিশ্বাস, ছন্দা ভাদুড়ী সাংহাই ছিলেন নাচ–গানের সঙ্গে। কিন্তু তাই বলে কি ছবি তোলা বাদ যাবে! দৌড়ে এসে জায়গা করে নিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। বশিষ্ঠ নন্দী, বুদ্ধিশ্বর রায় তাঁদেরও ব্যস্ততা কাজ নিয়ে। অদিতি হাজরা পূজা উপভোগ করেন। আনন্দ আনন্দ অনুভূতি সবার মনে।

দুর্গতি নাশিনী দুর্গা মহিষাসুরকে বিনাশ করলেন। শ্রীরাম চন্দ্রের বিজয় আজও বাংলার মানুষ পালন করে। আবুধাবি বিজয়কে বিজয় উৎসবে পরিণত করল। তারপর দেবীর বিদায়। বাঙালি হিন্দুরা দুর্গা দেবীকে বিদায় দিলেন। নারীরা সিঁদুর রাঙালেন একজন আরেকজনকে। তাঁরা মঙ্গল সংগীত করলেন।