বুয়েট আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

কথায় আছে, কাপুরুষ মরে বারবার, কিন্তু বীরপুরুষ মরে একবারই। আমি বীরপুরুষ কোনোকালেই ছিলাম না। তবে না মরে জন্মেছি দুবার।

কবি বলেছেন, মানুষ নাকি দ্বিজ। মানে দুবার জন্ম নেয়। যেহেতু আমি মানুষের আদলে তৈরি, সেহেতু কবির কথার অমর্যাদা আমি করি কী করে? তাই আমিও দ্বিজ।

আমার প্রথম জন্মস্থান হলো চুয়াডাঙ্গা। বহুদিন সেখানে কৃষ্ণ সেজে রাধাদের সামনে নর্তন–কুর্দন করে যখন প্রকৃতি দেখল প্রকৃতই আমার দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তখন আমাকে কাঠঠোকরা বানিয়ে কাঠখোট্টা মার্কা জঙ্গলে পাঠিয়ে দিলেন। সেই জায়গার নাম বুয়েট।

এখানে আমার প্রেমিক মন আর কবিসত্তা প্রায় একপ্রকার মাঠে মারা যেতে লাগল ইট–কাঠ–রড–বালি–সিমেন্টের খাঁচায় বন্দী হয়ে। যদিও এখানে আসার আগে অবধি আমার কোনো কবিতা কোথাও ছাপা হয়নি। সেটা অবশ্য আমার কবিতার গুণে নয়, বরং আমার প্রতিভাকে ঠিকমতো বিচার করতে না পারার জন্য।

সে যা হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। কাঠখোট্টার জঙ্গলে আমি কিছু ভালো বন্ধু, সিনিয়র ভাই ও শিক্ষক পেয়েছিলাম। সবার নাম লেখা হয়তো সম্ভব নয়। তবে কয়েকজনের নাম না লিখলে আমাকে আবার প্রকৃতি অন্য কোনো জঙ্গলে পাঠিয়ে দেবেন কাঠঠোকরার মতো।

আজ থেকে বিশ বছর আগে আমার থাকার জায়গা হলো বুয়েটের রাজধানী হিসেবে খ্যাত তিতুমীর হলে। যদিও আমি হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সিট পাইনি প্রথমাবস্থায়। সুতরাং থাকার জায়গা বলতে ওই হলের বারান্দা, ছাদ বা সবুজ ঘাসের বিছানা ছাড়া আর কিছুই জোটার কথা নয়।

আমাকে সবুজ ঘাসের বিছানায় না রেখে হলে নরম চৌকিতে রেখেছিলেন আমার বন্ধু তরিকুল ইসলাম মিলন। আমি হলের প্রথম টার্ম তাঁর সঙ্গেই শেয়ার করে পার করে দিলাম। এই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার প্রথম জন্মস্থান চুয়াডাঙ্গার খেলার মাঠে। বুয়েটে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে। সেই স্বল্প পরিচয়ের একজন বন্ধুকে তিনি সেদিন খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখেননি। ওই সময় তিনি আমাকে যদি তাঁর বিছানায় না রাখতেন, তাহলে আমার কিছুই করার ছিল না। ওইটুকু সেমি সিঙ্গেল বিছানায় আমার সঙ্গে হাসিমুখে থাকতে তাঁর নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। আমাকে কোনো দিন কিছুই বুঝতে দেননি। মনে মনে বুঝেছি, আমি হঠাৎ করেই অনেক উন্নত চরিত্রের একজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম।

এই হলজীবন দেখতে আমার বাবা এসেছিলেন বুয়েটে। শুধু দেখে গেলেন না, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে বেশ গল্পগুজব করে গেলেন। আমার বন্ধুরা সেদিন বুঝেছিলেন, আমি একটি অকর্মণ্য গোছের মানুষ। আমাকে দিয়ে জীবনে কোনো ভালো কাজ হবে না। আজ এইক্ষণে আমার আরেক বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে। তাঁর নাম আসাদুজ্জামান আদল। ইংরেজিতে লিখলে হয় একটি পুতুল (A doll)। খুব শান্তশিষ্ট বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী একজন মানুষ। তিনি আমার বাবার কথা মিলিয়ে দেখলেন, কাপড়চোপড় কাচার ব্যাপারে আমার একরকম অনীহা আছে। আর কাচলেও আমার খুব কষ্ট হয়। আমি কাপড় কাচার কায়দাও ঠিকমতো জানি না। আমার এই বন্ধু মাঝে মাঝে নিজের কাপড়ের সঙ্গে আমার কাপড় নিয়ে কেচে দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। আমি খুবই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। কী রকম নিঃস্বার্থ একজন মানুষ হলে এ রকম করতে পারে। বেশ বুঝতে পারছিলাম আমাকে স্রষ্টা ভালো কিছু বন্ধুভাগ্য দিয়েছেন।

আমার হলজীবনের অনেক ঘটনাই আজ মনে পড়ছে। আমি তখন মিলনের রুম থেকে অন্য রুমে নিজস্ব সিটে থাকি। যেদিন আমি মিলনের রুম ছেড়ে আমার নিজের বেডে উঠতে যাচ্ছি, সেদিন চতুর্থ বর্ষের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি ওই হলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তিনি ছাত্রদল করতেন।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোন রুমে সিট পেয়েছি। আমি ৪০১০ রুমের কথা বলতেই তিনি বলেছিলেন, ও। ওই রুমে হল ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আমাদের ছাত্রদলের একটি ছেলে থাকে। ওরা বেশ ভালো ছেলে। আশা করি তোমার অসুবিধা হবে না।

আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। যদিও একটি টার্ম তিতুমীর হলে কাটিয়ে ফেলেছি। তবু অবাক হওয়ার কারণ হলো, একই রুমে দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষের সহাবস্থান। যেদিন আমি ওই রুমে উঠলাম, সেদিন আরও অবাক হয়ে দেখলাম যে তাঁরা যথেষ্ট ভালোভাবেই আমাকে গ্রহণ করলেন। মজার ব্যাপার হলো, ওই রুমের সিনিয়র ভাইয়েরা কখনোই আমাকে কোনো রাজনৈতিক দলে আসার ব্যাপারে বল প্রয়োগ করেননি, বরং প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে উৎসাহ দিতেন ভালো রেজাল্ট করবার। যদিও সেই ভালো রেজাল্ট আমার হয়নি।

তিতুমীর হলের ৪০১০–এর ওই রুমে আমাদের পুরকৌশলের একজন বড় ভাই থাকতেন। সব সময় দেখতাম তাঁর কম্পিউটারের সিপিইউ খোলা ও শোয়ানো থাকত। তখন হলে কম্পিউটার খুবই কম মানুষেরই ছিল। আমার আবার ছিল কম্পিউটারের ব্যাপারে বিশাল আগ্রহ। সেই আগ্রহ দেখে তিনি একদিন আমাকে সিপিইউর ভেতরের সব হার্ডওয়্যার নিয়ে জ্ঞান দিলেন। তারপর কীভাবে একটি সিপিইউ অ্যাসেম্বলিং করতে হয়, কীভাবে উইন্ডোজ, মাইক্রোসফট অফিস ও অন্যান্য সফটওয়্যার ইনস্টল করতে হয় শেখালেন। এতে আমার খুব লাভ হলো। অন্য বন্ধুমহলে আমার বেশ নামডাক পড়ে গেল। অনেক বন্ধু যাঁরা অন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তাঁরা আমাকে তাঁদের নিজেদের কম্পিউটার ঠিক করতে ও সফটওয়্যার ইনস্টল করতে ডাকাডাকি করতেন। বেশ একটা ভাব ছিল সে সময় আমার।

আরও একটি মজার কথা মনে পড়ছে আজ আমার। আমার পলাশের রুমে সিএসইর কয়েকজন বড় ভাই থাকতেন। একবার এক ভাই আমাকে তাঁর কম্পিউটারে বসে কীভাবে এক্সেল সফটওয়্যার দিয়ে প্রোগ্রামিং করতে হয়, তা হাতেকলমে শেখালেন। এই এক্সেল আজও আমাকে দেশে ও বিদেশে চাকরি–বাকরিতে খুব উপকার করে চলেছে। আমি আজও সেই সব বড় ভাইয়ের কাছে ঋণী।

ওই রুমটিতে আমি বেশ কিছু সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু একটি সমস্যা ছিল সেই রুমে। মাঝে মাঝে এক বড় ভাই আসতেন যিনি বুয়েটের লেখাপড়া বাদ দিয়ে নাট্যদলে কাজ করতেন। তিনি অনেক সিনিয়র মানুষ। ৮৪ বা ৮৫ সালের ব্যাচ সম্ভবত। তিনি তখনো মনে করতেন, ওই সিটটি তাঁর রেজিস্ট্রি করা। আমার রুমের অন্য সিনিয়র ভাইয়েরা ভদ্রতাবশত তাঁকে কিছু বলতেন না। আমি সেই কথা আমার পরম প্রিয় বন্ধু জাকারিয়া পারভেজকে বলেছিলাম একদিন বিকেলে চা খেতে খেতে। সে তখন বলেছিল, আমার রুমে একটি সিট খালি হয়েছে। আমি আমাদের সিনিয়র ভাইয়ের কাছ থেকে অনুমতি যদি পাই, তাহলে তুই আমার রুমে উঠতে পারিস।

আমি এই কথা শুনে টিউশনিতে চলে গেলাম। রাত ৯টা বা ১০টার দিকে ফিরে রুমে ফিরে দেখি, আমার বেড থেকে আমার বালিশ তোশক গায়েব। আমি আমার রুমমেটদের জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিছানা কই? সবাই বলল, জাকারিয়া নিয়ে গেছে তার রুমে। জাকারিয়াকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি ওই রুমে থাকাকালে। এত জ্ঞানী, নিরহংকার, বুদ্ধিমান ও অকৃত্রিম বন্ধু সবার জোটে না। আমি ভাগ্যবান। আমি আমার বুয়েটের শেষ দিনগুলো সেই রুমেই থেকে পার করেছিলাম। ওই রুমটিই হলো আমার জীবনে বেহেশতের মতো একটি জায়গা।

ওই রুমে আমার একজন সিনিয়র রুমমেট ছিলেন, সবুজ ভাই। এত ভালো, নির্ভেজাল, সুন্দর মনের মানুষ খুব কমই দেখেছি জীবনে। তিনি আমাদের এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। আমার আজও মনে আছে, যেদিন তিনি হল ছেড়ে চলে গেলেন পাস করার পর, সেদিন জাকারিয়ার মতো অত শক্ত মনের মানুষও কাঁদতে কাঁদতে চোখের পাতা ফুলিয়ে ফেলেছিল।

থাকার জায়গা নিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম। একটু পড়াশোনার দিকে মন দেওয়া যাক। আমি তো জীবনে কোনো দিন পড়াশোনায় ভালো বা সিরিয়াস ছিলাম না। বুয়েটে কীভাবে চান্স পেয়েছি, সেটি একটি অতি বিস্ময় আমার কাছে আজও। আমাদের খুব পরোপকারী বন্ধু হলো তাপস চৌধুরী। সে খুবই মনোযোগী ছাত্র। নিয়মিত ক্লাসনোট তোলে। চোথা তৈরি করে থাকে। প্রতি টার্ম ফাইনালের আগে সে হলে এসে তার নিজের তৈরি করা চোথা আমাদেরকে ফটোকপি করে দিত। মনে হতো এটা যেন ওর দায়িত্ব–কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেই চোথা পড়েই পাস করতাম বুয়েটে প্রতিটি টার্মে।

মমতা শব্দটি সাধারণত স্ত্রীলিঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। শুরু করেছিলাম বন্ধুভাগ্যের কথা দিয়ে। এখন বলব একজন মমতাভরা শিক্ষকের কথা। বুয়েটের অন্য সবার মতো আমিও তখন একটি বাসায় টিউশনি করতাম। ঠিকমতো বেতন পেতাম না। ১ তারিখের বেতন সাধারণত ১০ তারিখে পেতাম। তাতে আমার খুব সমস্যা হতো না।

এ রকম চলতে চলতে রমজান মাস চলে এল। কিন্তু তারা আজ দেব বা কাল দেব বলে বেতন দিচ্ছিল না। বেতন না পাওয়ায় বাড়ি যাওয়ার টিকিট কিনতে পারছিলাম না। এদিকে হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাইরে ইফতারি বা সাহরি করতে হচ্ছে। খরচ আরও বেশি। মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। তখন মোবাইল ফোন সবার হাতে ছিল না। প্রতিদিন বাড়িতে কথা হতো না। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা বলতে পারিনি।

আমি সেই সময় চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। থিসিস করছি। আমার সুপারভাইজার ড. জয়নাল আবেদীন স্যার তখন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ)। একদিন বুয়েট শহীদ মিনারে বসে এক ঠোঙা মুড়ি কিনে বসে আছি ইফতারের সময়ের অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখি জয়নাল স্যার গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে ডাকছেন। আমি গাড়ির কাছে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সামনে ঈদ। আমি কেন বাড়ি যাইনি। আমি পুরো ঘটনা তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, যদি কাল বেতন না পাও, আমার বাসায় এসে বাড়ি যাওয়ার টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবে। আমি যেন তোমাকে আর বুয়েট ক্যাম্পাসে না দেখি।

আমি তাঁর কথা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। যদিও আমার বাবা কীভাবে যেন আমার বেতন না পাওয়ার কথা জানতে পেরে বাড়ি যাওয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন।

পুরো সময় নিজের কথাই বললাম। এবার আমার আরেক বন্ধুর বিপদে কীভাবে জয়নাল স্যার ছাত্রকল্যাণ পরিচালক হিসেবে এগিয়ে এসেছিলেন তা বলি। আমার একই ক্লাসের ও তিতুমীর হলের এক বন্ধু হঠাৎ করেই কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন টেস্ট করে জানা গেল, তাঁর কিডনিতে অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু সে জন্য তো অনেক অর্থের প্রয়োজন। আমাদের অন্য বন্ধুরা অর্থ সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লেন একটুও সময় অপচয় না করে। তাঁরা জয়নাল স্যারের কাছে গেলেন, যদি বুয়েট কোনোভাবে কিছু সাহায্য করতে পারে।

সব শুনে তিনি বললেন, আমরা বুয়েট থেকেই তো পুরো ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আজ যত দূর মনে পড়ে, স্যারের কারণে বুয়েট চিকিৎসার জন্য বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করেছিল। আর আমার সেই চ্যাম্পিয়ন বন্ধুরা প্রতি রাতে একজন একজন করে রাতে হাসপাতালে গিয়ে সেবা করতেন আমার ওই বন্ধুটিকে। ছাত্রদের জন্য অসম্ভব দরদ ও বন্ধুত্বের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা না থাকলে কোনো শিক্ষক ও কোনো বন্ধু এভাবে মানুষের জন্য এগিয়ে আসতে পারে না। এসবই ছিল আমার বুয়েট থেকে শেখা অমূল্য শিক্ষা। যার জন্য আমরা সবাই গর্ব করে বলতে পারি Proud to Be a BUET Graduate। আর আমি বলি কাঠখোট্টার জঙ্গল বুয়েট আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান।