আমার দ্বিতীয় বাড়ি

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

ঢাকা শহরে আমার প্রথম আসা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। ওই সময় আমি কোচিং ও ভর্তি পরীক্ষার জন্য মাস দেড়েক ঢাকায় ছিলাম।

কুষ্টিয়ায় আমি যে কলেজে পড়তাম, সেই কলেজের আমরা কয়েকজন উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলাম। তাদের মধ্যে আমি বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। অন্যরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

বন্ধুরা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল, সেখানে সময়মতো ক্লাস শুরু হলেও কী এক কারণে ওই বছর বুয়েটে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল কয়েক মাস পর। এ সময় আমি কুষ্টিয়ায় ছিলাম।

যাহোক, ক্লাস শুরু হওয়ার পর যখন ঢাকায় এলাম, কয়েক দিন থাকার পর কুষ্টিয়ার বন্ধুদের বললাম, তোরা আমাকে বাসের টিকিট কেটে দে। আমি বাড়ি চলে যাব। এই নোংরা শহরে আমি থাকতে পারব না।

তখন পর্যন্ত আমার কল্পনারও অতীত ছিল এই শহরের জন্যই একদিন আমার পেট পুড়বে। আমি গ্রামের ছেলে। তাই পড়াশোনাটা কখনোই রুটিন মেনে করা হয়নি। যখন ইচ্ছা পড়তাম। ইচ্ছা হলে পড়তাম, না হলে পড়তাম না।

আমার মা-বাবা কখনোই পড়াশোনা নিয়ে পীড়াপীড়ি করতেন না। পড়াশোনাটা আমার কাছে একেবারে ছেলেখেলা ছিল। তাই বুয়েটের রুটিনবদ্ধ পড়াশোনার পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এই শহরে বোধ হয় আমি আর টিকতে পারলাম না।

বুয়েটে আমি সিট পেয়েছিলাম ড. এম এ রশীদ হলে। সিট পেলেও আমার রুমের বড় ভাইদের সিট ছাড়তে কয়েক দিন সময় লাগল। এ সময় আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে ছিলাম। বড় ভাইয়েরা রুম ছাড়ার পর আমি আমার নির্ধারিত সিটে উঠে পড়লাম। এরপর বাকিটা ইতিহাস।

জন্মের পর থেকে আমি আমার শিক্ষা পেয়েছিলাম মা–বাবার কাছ থেকে। আমার বড় ভাই ছিল না। তাই বড় ভাইদের আদর, বকা খুব মিস করতাম। হলের বড় ভাইয়েরা আমার জীবনের সেই অভাবটা পূরণ করে দিলেন নিমেষেই।

সত্যি কথা বলতে, আমার এক জীবনের যত অর্জন, তার প্রতিটির পেছনে রশীদ হলের বড় ভাইদের অবদান রয়েছে। আমি ছিলাম গ্রামের মুখচোরা এক ছেলে, যার কাছে চুলে সরিষার তেল দিয়ে চুল না আঁচড়ালে পরিপাটি হওয়া হয় না। কারও সামনে মুখ ফুটে কিছু বলার মতো সাহস আমার ছিল না।

কিন্তু এই হলের মানুষগুলোর অবদানে সেই আমিই আজকের এই আমি। তাঁরা আমাকে হাতেকলমে শিখিয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে শিখলাম একজন মানুষের মন ঠিক কতটা উদার হতে পারে। কীভাবে বাজার করতে হয়, কীভাবে অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে আয়োজন করতে হয়। তাঁদের কাছেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্ড খেলার হাতেখড়ি নিলাম।

মিছিলে পানি ঢালার জন্য বিছানায় তোশকের নিচে পলিথিন জমানো হতো। কোনো মিছিল আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে এক গ্রুপ বালতিতে পানি ভরার কাজে, দ্বিতীয় গ্রুপ বালতি থেকে মগ দিয়ে পলিথিনে ঢালার কাজে আর তৃতীয় গ্রুপ পলিথিনে গিট্টু দিয়ে অভেদ্য লক্ষ্যে ছোড়ার কাজে ব্যস্ত থাকত।

শুক্রবার রাত এলেই রুমে রুমে সাজ সাজ রব। কেউ বসে যেত কার্ড নিয়ে। কেউ বসে যেত কম্পিউটারের সামনে। আবার কেউ বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যেত বিভিন্ন স্থানে। সারা রাত ধরে কার্ড খেলা, মুভি দেখার পর দল বেঁধে ঠাঁটারীবাজারের স্টার হোটেলে গিয়ে বিরিয়ানি সঙ্গে নান-ডাল খাওয়া হতো।

সপ্তাহান্তের এই দুই দিনকে আমার দুই মিনিট মনে হতো। আর ভাবতাম, কেন যে প্রতিদিন শনিবার আর রোববার হয় না। হলে প্রায়ই বিভিন্ন উৎসবের উপলক্ষ তৈরি হয়ে যেত। কেউ নতুন টিউশনি পেয়েছে; আর শিক্ষার্থী যদি ছাত্রী হয়, তাহলে সবাই তার রুমে জড়ো হয়ে প্রথমে সেই ছাত্রীর চেহারা ও আচরণের ধরন শোনা হতো। তারপর ক্লু বের করা হতো আসলে সেই ছাত্রী ঠিক কী কী ভাবে কোন কোন দিক দিয়ে তার স্যারের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। এরপর ছাত্রীর মায়ের আচরণেরও ময়নাতদন্ত হতো। কী কী নাশতা দিয়েছেন ইত্যাদি।

এ ছাড়া দল বেঁধে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, সারা রাত ছাদে শুয়ে জ্যোৎস্নাস্নান—এগুলোও ছিল আমাদের পাগলামির মধ্যে। আর রাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিজের গলাটাকে একটু ঝালিয়ে নেওয়াও চলত।

রোজার সময় সব ধর্মের সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার, আমের মৌসুমে রাজশাহী থেকে ফরমালিনমুক্ত আম সংগ্রহ করে খাওয়া। ছুটির শেষে যার যার এলাকার স্পেশাল কিছু নিয়ে এসে ফ্লোরে বিলি করা, এমনই আরও হাজারো কর্মকাণ্ডে আমরা ব্যস্ত ছিলাম।

তবে আয়োজনের দিক দিয়ে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও গোছানো অনুষ্ঠান ছিল ফ্লোরের সিনিয়র ব্যাচের বিদায়। সেই দিন মনে হতো আমরা সবাই একই ক্লাসে পড়ি। অবশ্য অন্য সময়ের মেলামেশা দেখে কারও বোঝার উপায় ছিল না একজন আরেকজনের চেয়ে অন্তত চার–পাঁচ বছরের বড়।

বিদায়ের অনুষ্ঠানের স্লোগান ছিল যা হবে আজ রাতে সেটা এই রুমের মধ্যেই হবে। বিদায়ের শেষের দিকে এসে বিদায়ী ব্যাচের বেশির ভাগ সদস্যই আর নিজেদের আবেগকে সংবরণ করতে পারতেন না। এটা যেন বিবাহের পর কোনো মেয়ের বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরালয়ে গমনের মুহূর্তের বাঁধভাঙা কান্না। কিন্তু তাদের দেখে কে বলবে, চার পাঁচ বছর আগেও এরা কেউ কাউকে চিনত পর্যন্ত না।

বুয়েট থেকে পাস করার পরও রশীদ হলের এই পরিবারের সদস্যরাই আমার ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। পাস করার সময়ে হাতে বেশ কিছু ভালো টিউশনি থাকায় আমি চাকরির প্রতি তেমন আগ্রহ বোধ করতাম না। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বড় ভাইয়েরা আমাকে ফোন করে বলতেন, অমুক জায়গায় অমুক পদে লোক নেবে। সময়মতো আবেদন জমা দিয়ো। এভাবে জীবনের সব কটি চাকরিতে বড় ভাইদের কোনো না কোনোভাবে অবদান রয়েছে। এমনকি চাকরি পরিবর্তনের ব্যাপারেও সময়োপযোগী পরামর্শ দিয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছেন।