একুশ শতকের জীবপ্রযুক্তি

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জীবপ্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে কোষ ও কোষের অংশ বিশেষ বা জীবের অঙ্গ ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি।

জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ অনুসারে জীবপ্রযুক্তি হলো যেকোনো প্রকারের প্রায়োগিক প্রাযুক্তিক কাজ, যা জৈবিক ব্যবস্থা, মৃত জৈবিক বস্তু অথবা এর থেকে প্রাপ্ত কোনো অংশকে ব্যবহার করে কোনো দ্রব্য বা পদ্ধতি উৎপন্ন করে বা পরিবর্তন করে, যা বিশেষ ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়।

একুশ শতকের জীবপ্রযুক্তি হলো প্রযুক্তিবিদ্যার মূল চাবিকাঠি। জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন নতুন থেরাপি উদ্ভাবনে ও শিল্প খাতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

এ ছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজ ফলন আরও টেকসই করতে জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার আমরা আগে থেকেই জানি।

জেনোম সিকুয়েন্সিং আর CRISPR-Cas–এর আবিষ্কারের মাধ্যমে জীবপ্রযুক্তির নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে। রোগ ডায়াগনোসিস থেকে শুরু করে রোগ প্রতিকার—সব জায়গায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকাল বাড়িয়ে দিয়েছে।

জার্মান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাদের এক গবেষণাপত্রে জার্মানির ওষুধশিল্প বিপ্লবে জীবপ্রযুক্তির অবদান উল্লেখ করেছে।

তাদের গবেষণা অনুসারে জার্মানির শুধু ‘বাডেন ওয়ারটেমবার্গ’ স্টেটেই গড়ে উঠেছে ১৫৬টি জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানি। এদের মধ্যে তিনটি কোম্পানি ক্যানসার নিরাময়ের জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া সহজে ও দ্রুত রোগের জীবাণু শনাক্তকরণে অনেকগুলো কোম্পানি কাজ করছে।

জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তারপরও জীবপ্রযুক্তিভিত্তিক ওষুধশিল্প–ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর বড় কারণ বোধ হয় গবেষণা থেকে শুরু করে ওষুধ উৎপাদন পর্যন্ত যেতে কোম্পানিগুলোকে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়।

এ ছাড়া গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রায়োগিক খাতে নিয়ে আসতে অনেক সময় বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। যেমন, হেরাল্ড জ্যুর হাসেন ২০০৮ সালে ফিজিওলজি ও মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ পান সার্ভিক্যাল ক্যানসার নিরাময়ে তাঁর অবদানের জন্য। মজার ব্যাপার হলো তিনি ১৯৭৬ সালে প্রথম ধারণা করেন সার্ভিক্যাল ক্যানসারের জন্য হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) দায়ী। তাঁর অনুমান সত্যি হয় ১৯৮০ সালে। আর এই রোগের ভ্যাকসিন বাজারে আসে ২০০৬ সালে।

আমরা সবাই এপিজেনেটিক্সের কথা জানি। এপিজেনেটিক্স ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছে ২০০ বছর। ২০০ বছর আগে বিজ্ঞানী লামার্ক ‘থিওরি অব ট্রান্সফরমেশন’–এর ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি এমন একটি কৌশলের কথা বলেন, যার মাধ্যমে কোনো একটি পরিবর্তন আস্তে আস্তে একটি প্রজাতির মধ্যে শুরু হয় এবং পরে বংশানুক্রমিকভাবে তা প্রবাহিত হয়। এই কয়েক বছর হলো আমরা এই পরিবর্তনকে এপিজেনেটিক্স বলছি। এপিজেনেটিক্স হলো এমন একটি প্রসেস, যার মাধ্যমে পরিবেশ থেকে আসা ফ্যাক্টরসমূহ আমাদের বংশগতির ধারক ডিএনএ–কে প্রভাবিত করে। আর এই আবিষ্কার ‘পোস্টট্রান্সলেশন মডিফিকেশন’ গবেষণায় আমূল পরিবর্তন এনেছে।

লম্বা সময় ও অধিক অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় বলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জীবপ্রযুক্তির তেমন প্রসার ঘটেনি। তারপরও বলব আমাদের ওষুধশিল্প–ব্যবস্থায় এই প্রযুক্তির প্রসার ঘটানোর সময় এসেছে। শিল্প খাতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন কর্মসংস্থান ছাড়াও বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

তথ্যসূত্র: <gesundheitsindustrie-bw.de/en/article/news/biotechnology-key-technology-of-the-21st-century>
–––

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।