স্যার, আপনি ছাড়া নিষ্প্রভ শাবিপ্রবি
শিক্ষক হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ২০১২ সালের শুরুর দিকে যোগ দিয়েছি মাত্র। তার আগে থেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এমএস করছিলাম। শাবিপ্রবিতে যোগ দেওয়ার পর খণ্ডকালীন হয়ে যাই। শনিবার দিন করে ক্লাস। সপ্তাহান্তে দুদিন করে থাকি ঢাকায়। শহীদ স্মৃতি হলে।
এই হল থেকে বের হলে হাতের ডানে জহির রায়হান রোড। সেই সড়ক ধরে খানিকটা এগোলেই একুশে হল। এই হলে থাকত আমার কলেজজীবনের প্রিয় বন্ধু আল আমিন।
অনেক দিন পর কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আল আমিনের রুমে তখন থাকত ঢাকা মেডিকেলের আরেক কলেজবন্ধু রাসেল। সে বেশ সাহিত্যপড়ুয়া। রাসেল আমাকে দেখেই বেশ করে জড়িয়ে ধরল। ভাবলাম, অনেক অনেক দিন পর বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা বলে কথা।
কিন্তু খানিক বাদেই রাসেল আমাকে অনেকটা অবাক করে দিল। বলল, নিজেকে আজ বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে। বললাম, কেন? বলল, আজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের একজন কলিগের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে পেরেছি। ওর বিস্ময় দেখে অভিভূত না হয়ে পারিনি সেদিন। একটুখানি নতুন করে ভাবলাম, সত্যিই কি আমি জাফর ইকবাল স্যারের কলিগ?
বাসে চড়েছি, ট্রেনে চড়েছি, প্লেনে উঠেছি। যখন যেখানে গিয়েছি, সেখানেই দু-একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাঁরা কোনো না কোনোভাবে দু-চার কথার পরেই মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। স্যার কি ক্লাস নেওয়ার সময় পান? স্যারের অফিসটা কি খুবই বিশাল? স্যার কি ক্যাম্পাসে হেঁটে চলেন? স্যারের বাসা কোথায়? আরও কত–কী?
আজ অবধি প্রিয় স্যারের প্রতি এমনি করে নানা মানুষের নানা কৌতূহল দেখে আসছি পথে–প্রান্তরে। সেসব সুখস্মৃতি আজও নিজেকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করে, উদ্বেলিত করে, করে গর্বিত।
দুই.
মেঘে মেঘে কখন যে এতটা বেলা হয়ে গেল, ঠিক টেরই পাইনি। আসলে টের পেলেও বিশ্বাসটুকু হয়তো করতে পারিনি। আজ কদিন ধরে বিশ্বাস করতেই হচ্ছে। বিশ্বাস করতে হচ্ছে প্রিয় শিক্ষক প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
গত বছর থেকে স্যার প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে ছিলেন। খুব করে আশা করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সরকার কেউ না কেউ গুণী এই পণ্ডিততুল্য শিক্ষককে তাঁর যোগ্য সম্মানটুকু দিতে উদ্যোগী হবেন। কেমন করে যেন মনের ভেতরে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস ছিল তাঁর সৃষ্টিশীল দক্ষতা, তাঁর দেশ-বিদেশের নানা অভিজ্ঞতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে, দেশের কাজে লাগানোর জন্য কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। বড় প্রত্যাশা ছিল সৃষ্টিশীল এই মানুষকে করা হবে প্রফেসর অব ইমেরিটাস। কিন্তু দুঃখের কথা, আজ অবধি কেউই উদ্যোগী হয়ে আসেননি। এ কারণে চরম অবিশ্বাসটাকেই আজ সত্য বলে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?
তিন.
প্রায় বছর দুই হলো দেশের বাইরে এসেছি। ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোকে প্রায়ই মনে পড়ে। তবে কেন যেন কদিন ধরে লাল ইটের সবুজ ক্যাম্পাসে প্রিয় জাফর ইকবাল স্যারের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি একটু বেশিই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রিয় স্যারের কিছু কিছু অসামান্য অবদানের কথা। মনে পড়ছে কিছু কিছু জনশ্রুতি। সেসব রোমন্থন করতে আসিনি আজ। তবু ছোট একটা জনশ্রুতি একটুখানি বলে নিই।
আমাদের ছোট ক্যাম্পাস। মুখে মুখে চলে অনেক কথা। এমনই একটা কথা আছে সিলেটের এক দানবীরকে নিয়ে, যিনি তাঁর নামে একটি হল করে দিতে চেয়েছিলেন। শুধু গলার কাঁটা ছিলেন নাকি জাফর ইকবাল স্যার। এটা নাকি স্যারের একরোখা স্বভাব। এমন হেলাফেলা স্যার কেন করলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করত।
একবার একজন গুণী স্যারের কাছে এর আসল হেতু জানতে চাইলাম। স্যার বললেন, যে ভদ্রলোক এই হল করে দিতে চেয়েছিলেন, তিনি একজন ভূমিদস্যু। অনেক হিন্দু পরিবারকে উৎখাত করে ভদ্রলোক তাঁর সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাই স্যার চাননি এমন একজন মানুষের নামে একটি হল হোক।
এর কিছুদিন পরে অবশ্য দেখেছি, সরকার সেই দানবীর লোকের বিরুদ্ধে অন্যের সম্পদ দখলের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। এ কারণে স্যারের একরোখা স্বভাবের যথার্থতা বুঝতে আর কি বাকি থাকে?
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরতে পরতে অনেক কিছুই শেখার থাকে। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সে রকমই হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ফটক, ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া, অলিগলি—সবকিছুতেই থাকতে হয় একধরনের মহৎ প্রাণের ছোঁয়া, আদর্শের স্মৃতিফলক। সেখানে যদি একটি হল হয় এমন একজনের নামে, যিনি কিনা একজন মানবতাবিরোধী, ভূমিদস্যু, তাহলে ছাত্ররা তা থেকে কী শিখবে?
স্যার, আপনার চলনে, বলনে, জীবনদর্শনে আমরা নানাভাবে অনুপ্রাণিত। আপনার জীবনদর্শনের ব্যাপ্তি দেখে মনে পড়ে কবি শক্তিব্রত বর্মচারীর দুটি কথা—
‘যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সে কেড়েছে ভয়
আকাশ জোড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।’
চার.
কদিন ধরে ভাবনার জগতে শুধু এটাই ঘুরপাক খাচ্ছে, প্রিয় এই গুণী মানুষটি যখন ক্যাম্পাসে থাকবেন না, তখন কেমন থাকবে শাবিপ্রবি পরিবার? কেমন করে বর্ষা কিংবা ফাগুনের দিনগুলোয় প্রিয় স্যার আমাদের স্মৃতির জগতে উঁকিঝুঁকি দেবেন?
স্যার, আপনি যখন থাকবেন না, তখনো হয়তো বর্ষা নামবে সবুজ ক্যাম্পাসে। শ্রাবণ মেঘের দিনে কাজলকালো মেঘের মায়া আছড়ে পড়বে। মুষলধারে বৃষ্টি হবে সরু লেকের ধারে। হলুদ কদম ফুলের সাদা সাদা রেণুগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখবে অনিন্দ্যসুন্দরের বন্যা। সাঁঝবেলায় ঝুপ করে নেমে আসবে অন্ধকার। পথের মিটি মিটি আলোকে ছন্দ তুলবে ঝিরঝির বৃষ্টি। ঘন কালো মেঘের রাতে ব্যাঙের ডাকে চারপাশটা হয়তো আগের মতোই ভারী হয়ে উঠবে। হয়তো আরও কত আয়োজনে ভারী হবে চারপাশ। প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই সেজে যাবে অবিরাম। এত সব নির্মল আয়োজনের পরেও কোথাও যেন থাকবে একধরনের হাহাকার। এটাই হয়তো অমোঘ সত্য আর আমাদের নির্মম বাস্তবতা।
স্যার, আপনার পায়ের ধূলি যখন আর পড়বে না, তখনো হয়তো শিমুলরাঙা ফাগুন আসবে, বাসন্তী রঙে রঙিন হবে শাবিপ্রবি। বেলা বাড়তে বাড়তে বাড়বে রঙিন মানুষের ভিড়। বাসন্তী সাজে সাজবে ক্যাম্পাসের নানা আয়োজন। বিকেলটা একটু একটু করে পড়ন্ত হবে। গোল চত্বরটা ছাপিয়ে ভিড় জমবে বাসন্তী মঞ্চে। ভালোবাসার রঙে রঙিন হবে রম্য বিতর্ক। তবে সেই বিতর্ক থাকবে কিছুটা ম্লান, কিছুটা নির্জীব। সবকিছু ছাপিয়ে থাকবে একজন সাদাসিধে মানুষের দারুণ অভাব। সাদা চুলের চিরচেনা সেই প্রিয় বিতার্কিক মানুষটিকে হয়তো আর দেখা যাবে না ভালোবাসার কোনো রঙিন মঞ্চে। বিতর্ক টেবিল ছাপিয়ে কেউ হয়তো আর মেলে ধরবে না প্রেমিকার প্রতি অন্তহীন প্রেমের চিঠি। হয়তো উৎসুক জনতার এমন বাঁধভাঙা অট্টহাসির রঙে রঙিন হবে না আর কোনো মুক্তমঞ্চ।
একটা সময় হয়তো পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেশে ফিরব। ক্যাম্পাসের অদূরেই ছোট্ট একটা বাসা থাকবে। ঠিক ফেলে আসা দিনগুলোর মতো করেই ভোর হবে। পথের ছায়াপথ ধরে চিকচিকে মিষ্টি রোদের লুকোচুরির ভেতর দিয়ে হেঁটে চলব। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় বঙ্গবন্ধু চত্বরে পৌঁছে যাব। নিজের অজান্তেই চোখজোড়া স্থির হয়ে যাবে সবুজ চত্বরের বাঁ পাশে, সরু রাস্তার পথে। সোনালি অতীতের এক টুকরো স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠবে ক্ষণিক সময়ের জন্য। দুজন রঙিন মানুষ। একটি রঙিন ছাতা। মানুষ দুজন একই ছাতার তলে, পাশাপাশি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলেছেন নিজ নিজ বিভাগে। কী অপূর্ব দৃশ্য! কী স্নিগ্ধ শ্রদ্ধামিশ্রিত প্রাণবন্ত দুটি প্রিয় মুখ। সেসব আজ কেবলই স্মৃতি, এক টুকরো সোনালি অতীত বৈকি।
ফেলে আসা দিনগুলোর মতো করেই হয়তো একটা সময় বিভাগের কাজের মধ্যে ডুবে যাব। তারপর দিনান্তের শেষে ঝুপ করেই নামবে অন্ধকার। ই-বিল্ডিংয়ে মাগরিব পড়ে নীড়ের টানে পথ চলব। ক্যাফেটেরিয়া, অর্জুনতলা, গোল চত্বর ফেলে এম ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবনের পথ ধরে। হঠাৎ করেই হয়তো চোখে এসে পড়বে হ্যালোজেন আলোর রশ্মি। অনেকটা আনমনা হয়ে এগিয়ে চলব আরও কিছু পথ। তারপর চোখজোড়া যেন আচমকাই স্থির হয়ে দাঁড়াবে। ছলছল নয়নে কিছুটা ঝাপসা হয়ে উঠবে সেদিনের সেই ছোট্ট কনফারেন্স রুম, ধেয়ে আসা মিটিমিটি আলোর বিচ্ছুরণ। স্মৃতির জগতে ঢেউ তুলবে হারিয়ে যাওয়া টুইসডে আড্ডার কিছু অতীত স্মৃতি। সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সাহিত্য, সংগীত, বিজ্ঞান—কী না থাকত আড্ডার টেবিলে? হাসি কান্না, আনন্দ-বেদনার কত শত স্মৃতি! বরফের মতো জমাটবাঁধা স্মৃতিগুলো হয়তো চির চির করে গলতে থাকবে।
তারপর দু-এক পা করে এগোতে থাকব। শীতল বাতাস আছড়ে পরবে চোখে মুখে। হৃদয়ের মধ্যে গুন গুন করে যেন বেজে উঠবে—
‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর–একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুঃখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।’
পাঁচ.
দিনপঞ্জিকার পাতা থেকে খসে পড়ে একটি একটি করে ২৫টি বছর। কেটে যায় ২৫টি বসন্ত। মেঘের ওপরে জমে মেঘ। আঁধারের ওপর আঁধার। বেদনার পালকি চড়ে ঘনিয়ে আসে বিদায়। এমন ক্রান্তিলগ্নে, ভারাক্রান্ত মনে, কোন ভাষাতে জানাব বিদায়, ভাবছি ক্ষণে ক্ষণে। আপন ভাষা আজ নিরুদ্দেশ। তাই সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় প্রিয় মানুষ, প্রিয় স্যারকে শুধু এইটুকুই বলি—
‘কেহ ভালোবাসিল না ভেবে—
যেন আজো মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
তুমি যাবে যাও, তবে বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।’
মো. মনির হোসেন, ডক্টরাল ফেলো, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি।
ই–মেইল: <[email protected]>