বডি শেমিং

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

‘আমি মোটা হয়েছি নাকি শুকিয়েছি; কালো হয়েছি নাকি ফরসা হয়েছি; সেই তথ্য আপনার আমাকে না দিলেও চলবে। বিশ্বাস করুন, আমার বাসায় আয়না আছে; ওয়েট মাপার একটা মেশিনও আছে, আপনার লাগবে? দেব না!’

পোস্টটি লিখেই ফেসবুক থেকে লগআউট করে নিল অথৈ। সে জানে, ফেসবুকে এখন দুই পক্ষ দুই ধরনের মন্তব্যে তাকে জর্জরিত করবে। এক পক্ষ ভীষণ অবাক হয়ে আলোচ্য পোস্টের বিরুদ্ধে নিজেদের পজিটিভিটি জাহির করবে। অথৈকে ঘটনা পাত্তা না দেওয়ার উপদেশ দেবে। হা–হুতাশ করবে। ব্যাপকভাবে সমালোচনা করবে। সর্বোপরি অথৈর জন্য এক বস্তা সহানুভূতি দেখাবে। আদতে তারা কতটা অথৈর পোস্টের মর্মার্থ বুঝতে পেরেছে সে প্রসঙ্গ থাকুক।

আরেকটা পক্ষের অনেক সাহস। লজ্জাটজ্জা নেই। তাদের মুখ লাগামছাড়া। তারা জনসমক্ষে নেগেটিভ কথা বলে মানুষকে আক্রমণ করতে ভীষণ পছন্দ করে। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, তারা এই দায়িত্বটা পালন করে কোনো প্রকার বেতন–ভাতা ছাড়াই।

এই সব কয়েক ঘণ্টা পরে সামলালেও চলবে। আপাতত পোস্ট দিয়ে রাগটা কমাল সে। এখন একটু সতেজ অনুভব করছে। গত দিনের ছবিগুলো আবার দেখতে লাগল। সে একটু মোটা হয়েছে বৈকি। কিন্তু এই বাড়তি ওজনটায় মোটেও বেঢপ লাগছে না তাকে। উল্টো চেহারায় একটা লাবণ্যতা দেখা যাচ্ছে। শুকিয়ে গেলে মুখের ওপর কেমন একটা কাঠখোট্টা ভাব চলে আসে। রুক্ষ রুক্ষ চেহারা মেকআপ দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়।

অথৈ সিলেটে গিয়েছিল একটা ফটোশুটের কাজে। সে ছোটখাটো একজন মডেল। বাংলাদেশে একনামে যেসব মডেলকে সবাই চেনে, অথৈ সে রকম কেউ নয়। বরং তাকে পাওয়া যাবে ওই বিখ্যাত মডেলদের সঙ্গে সাইড মডেল কিংবা এক্সট্রা মডেল হিসেবে। যারা প্রধান চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে যায়। কোথাও তারা চোখে পড়ে না অথচ সর্বত্রই বিরাজমান।

কারণ, পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী সবাই শুধু চ্যাম্পিয়নকেই মনে রাখে। সেকেন্ড যে হয়েছে তার কথা কেউ জানে না। প্রতিবছর মিস ওয়ার্ল্ড কে হয় সেটা অনেকেই জানে। সেই চ্যাম্পিয়নকে নিয়েই সারাটি বছরজুড়ে মাতামাতি। প্রথম ও দ্বিতীয় রানারআপকে সবাই ভুলে যায়। তাদের অস্তিত্ব যেন থেকেও নেই!

অথৈর বিষয়টাও এ রকম। টুকটাক জনপ্রিয় মডেলদের সঙ্গে কাজ করেছে সে। কিন্তু জনপ্রিয়তার সিঁড়ির প্রথম ধাপটিও খুঁজে বের করতে পারেনি। মূলত তার মডেলিং জীবন থেকে হাতখরচের সামান্য কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই পায়নি সে। সঙ্গে আছে ফেসবুকের কয়েক শ ফলোয়ার। এরা কেন আছে, তা অথৈ জানে না। সে চাইলে ফলোয়িং অপশন বন্ধ রাখলেই পারে। অনেকবার ভাবেনি যে তা নয়। পরক্ষণেই মনে হয় থাকুক কিছু চেনাজানা ভার্চ্যুয়াল জগতে। চলতি পথে তো তার কোনো ফ্যান ফলোয়ার নেই। পথের ধারে অথৈর ছবিঅলা কোনো বিলবোর্ডও নেই। এই ফেসবুকটাই বিখ্যাত হওয়ার একটি ছোট অবলম্বন। সেই ফেসবুকই এখন বলতে গেলে শত্রু।

একজন মন্তব্য করে বসে, ‘অমুক বিখ্যাত মডেলের ছাতা হাতে আপনাকে দেখেছি।’

কী লজ্জা! কী লজ্জা!

শুধু কী তাই? কালকের সিলেটের ফটোশুটের ছবিগুলো হাতে পাওয়ায় আজ কিছুক্ষণ আগে নিজের একটা ছবি আপলোড দিল। তাতে অনাকাঙ্ক্ষিত বডি শেমিং শুরু।

‘আপু আপনি মোটা হয়ে গেলেন’, ‘আপু আপনাকে মোটা লাগছে’, ‘আপু চা–বাগানের তীব্র রোদে কিন্তু কালো দেখাচ্ছে আপনাকে!’

অথৈ মনে মনে বলে, আরে, যদি বুঝতেই পারছিস রোদের কারণে কালো দেখাচ্ছে, সে কথা বলার কী? ভালো কিছু বল! বলতে তো পারিস ‘আপু চা–বাগানের তীব্র রোদে আত্মবিশ্বাস নিয়ে পোজ দিয়েছেন’।

কত উৎসাহ পাওয়া যায় এ রকম একটা কথা বললে? ‘সুন্দর লাগছে’ বলার দরকার নেই তো রে বাপ!

একটু মন ভালো করা কথা লিখলেই তো হয়। আর না হলে লিখিস না। ভীষণ অস্বস্তি বোধ হয় তার। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পোস্ট দিয়ে বসে। এখন মনে হচ্ছে ঠিক করেনি একদম। কী লাভ মানুষকে জানিয়ে এসব? আদতে সবাই একরকম। অন্যের দুঃখজনক পোস্ট দেখলে মজা নেয় আর হাসিখুশি পোস্ট দেখলে হিংসা করে! সত্যিই আরেকজনের ঝামেলায় দুঃখ অনুভব করা এবং আরেকজনের আনন্দে সুখ অনুভব করার বিষয়টাকে এখন জাদুঘরেই ঠাঁই দিতে হবে।

অথৈ নিজেও জনপ্রিয় মডেলদের সাফল্যের পোস্টে শতভাগ খুশি হতে পারে না। নিজের অজান্তেই কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায়। অথৈ ভুলতে পারে না সে–ও ঠিক ততটাই জনপ্রিয় হতে চেয়েছিল। পরক্ষণেই আবার সে নিজেকে বোঝায়, ওই জনপ্রিয় মানুষগুলো তো আর একদিনে সাফল্য পায়নি। এ রকম লাখ লাখ খারাপ মন্তব্য তারাও হজম করেছে। হুট করে রেগে গিয়ে দুই কথা শুনিয়ে দেওয়া কোনো ভদ্র মানুষের আচরণ হতে পারে না। মানুষ অসংখ্য ভালো কাজ মনে রাখবে না। কিন্তু ওই রাগের মাথায় দুই লাইনের অভদ্র আচরণটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবে।

অথৈ তাড়াতাড়ি ফেসবুক লগ ইন করল। ইতিমধ্যেই ছাব্বিশটা মন্তব্য। দেরি না করে পোস্টটি ডিলিট করে দিল। হঠাৎ তার মনে হলো, এই পোস্টের মূলকথা নিয়ে একটা জরিপ করে দেখলে কেমন হয়?

যে ভাবা সেই কাজ। এবার নতুন পোস্ট দিল। লিখল, ‘আমার ফ্রেন্ড লিস্টে কোন মেয়েগুলো সমাজে চলতে ফিরতে বডি শেমিংয়ের শিকার হচ্ছ? Let’s talk.’

পরবর্তী তিন ঘণ্টা যেন চোখের পলকে চলে গেল। শত শত মন্তব্য অথৈর পোস্টে। অথৈ সেগুলো পড়তে পড়তে ও মন্তব্যের উত্তর দিতে দিতে পাগলপ্রায়।

কেউ বলে, ‘আপু আমার গায়ের রংটা কালো। রং ফরসাকারী ক্রিম ব্যবহার করে চেহারায় মেছতার দাগ হয়েছে। সবার মুখ থেকে শুনতে হয় গাল পুড়ল কীভাবে? আসলে সবাই দেখলেই বুঝতে পারে এগুলো মেছতার দাগ। তবুও এভাবে খোঁচা মেরে কথা বলে মজা নেয়!’

অথৈ প্রতিটা মন্তব্য পড়ে কমেন্টদাতার প্রোফাইল দেখতে লাগল। গালে মেছতা হওয়া মেয়েটা স্বনামধন্য একটা সরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তার মুখের দাগের কারণে আমজনতা দ্বারা অপমানিত হচ্ছে। কী ভয়ংকর!

আরেকটি মন্তব্য চোখে পড়ল। ‘আপু পাত্রপক্ষ দেখতে এসে চা–নাশতা খেয়ে আমাকে রিজেক্ট করে চলে যায়, আমার উচ্চতা কম বলে। আমার কথা হলো, বায়োডাটাতে আমার উচ্চতা লেখা আছে। তারা তো জানেই আমি খাটো। এরপরও আমাকে দেখতে আসে শুধু মুখের ওপর শোনানোর জন্য যে আমি অযোগ্য; আমি খাটো!’

শিউরে উঠল অথৈ। এই যুগে এখনো এ রকম মানসিকতার মানুষ আছে? মেয়েটার প্রোফাইল দেখে এসে তো অথৈ অবাক! কী অপূর্ব মায়াবী চেহারার একটা পরি। এই মেয়েকে সামনাসামনি দেখে কেউ রিজেক্ট করতে পারবে?

পরের মন্তব্য দেখে অথৈর মাথায় রক্ত উঠে গেল। এক মেয়ে লিখেছে, বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে তার স্বপ্নের জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে সে বাদ পড়েছে। তার কারণ, সে অস্বাভাবিক মোটা। আলোচ্য ওই কোম্পানিটা যুক্তি দেখিয়েছে, এই মেয়ে তাদের অফিসে জয়েন করলে বুলিংয়ের শিকার হবে প্রচুর। এর থেকে ভালো যে চাকরিটাই সে না করুক।

অথৈ মনে মনে বলে, কী অদ্ভুত। তুমি জানো তোমার কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বুলিং করে। তুমি তাদের না থামিয়ে একজন যোগ্য ক্যান্ডিডেটকে বাতিল করে দিয়েছ আর গর্ব করছ খুব।

অথৈ খেয়াল করল সে তো এত জনপ্রিয় না। তাকে এত মানুষ কীভাবে মন্তব্য করছ? অতঃপর সে বুঝল তার পোস্টটি প্রচুর শেয়ার হচ্ছে। যারাই দেখছে তারাই অথৈর প্রোফাইলে এসে মূল পোস্টে মন্তব্য করছে। হায়, মানুষের এত কিছু বলার থাকতে পারে? মেয়েরা এত জঘন্যভাবে বডি শেমিংয়ের শিকার হচ্ছে! কেন?

সেদিন রাতে অথৈর অজান্তে আরও একটি ঘটনা ঘটল। অথৈর পোস্টটি চোখে পড়ল একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের। তিনি কোনো রকম চিন্তা না করেই অথৈর ছবি সংগ্রহ করে সেই পোস্টের ওপর একটা আর্টিকেল লিখে ফেললেন। পরের দিন বিখ্যাত এক দৈনিক কাগজে অথৈর ছবি! মডেলিংয়ের কারণে ওই বিখ্যাত দৈনিকে নিজের একটা ছবি ছাপা হোক; সেটা ছিল অথৈর স্বপ্ন! সেই জন্য দেশের সেরা সেই দৈনিক পত্রিকা সে তার বাসায় রাখত নিয়মিত।

পরদিন সকালে পত্রিকা খুলে অথৈর চক্ষু চড়কগাছ।

‘বডি শেমিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সাধারণ এক মেয়ে।’

হেডলাইনটা খুব পছন্দ হলো তার। সাধারণ এক মেয়ের জায়গায় সাধারণ এক মডেল লেখা থাকলে খুব কষ্ট পেত সে। সাধারণ এক মডেল হতে চায় না সে। অনেক জনপ্রিয় সাফল্যধারী একজন মডেল হওয়ার সুপ্ত বাসনা তার হৃদয়ে চব্বিশ ঘণ্টা উঁকি মারে।

অথৈ তাকে নিয়ে লেখা খবরটা চারবার পড়ল। কাল পর্যন্ত যে বিষয়টার সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে যাচ্ছিল সে; আজ দেখল বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে এই সমস্যার মুখোমুখি হওয়া মেয়ের অভাব নেই। ভীষণ অবাক হলো সে। সাংবাদিক অথৈ সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। তাই তাকে উপাধি দিয়েছে উঠতি মডেল। হাসল অথৈ। দুই বছর ধরে লাগাতার সংগ্রাম করে মডেলিং ক্যারিয়ারের সিঁড়ি খুঁজছে সে। আজ তার উপাধি উঠতি মডেল। কী হাস্যকর!

হঠাৎ তার মনে হলো, যেই বিষয়ে এত এত মেয়েদের সমস্যা। সেই বিষয়ে সবাই একজোট হয়ে কাজ করলে কেমন হয়? সেই জন্য কী করা যায়? একটা মিটিং করা? পরক্ষণেই তার মনে হলো, মিটিং ডাকলে সবাই আসতে পারবে না। এ শহরে শত শত মেয়ের শত শত দায়িত্ব, কাজ।

কিন্তু সবার সব সমস্যা না শুনলে তো এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব নয়। তারপরই তার মনে হলো কাল সামান্য এক জরিপে যে পরিমাণ সাড়া সে পেয়েছে, তাতে করে এই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার অনেক সহজ উপায় দরজায় কড়া নাড়ছে।

কথা না বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে ফেসবুক আইডি লগ ইন করল। গত দুই বছর যা হয়নি আজ তাই হলো। অজস্র ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ও ফলোয়ারসের নোটিফিকেশনস! অথৈ কিছু সময়ের জন্য সেগুলো দেখল। তার অনেক প্রিয় কিছু মডেলও আজ তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। অথৈর মনে পড়ে যায়, এ রকম অনেকের সঙ্গে সে কাজ করেছে; এতটুকু পাত্তা পায়নি। কারও কারও সঙ্গে সেলফি তুলতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের প্রচণ্ড ব্যস্ততা দেখে সেলফি তুলতে বলার আর সাহস হয়নি। অথৈ সবার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল। কারণ সে বিখ্যাত হতে চেয়েছিল। বাস্তবজীবনে বিখ্যাত হতে হলে আগে ফেসবুকে বিখ্যাত হতে হয়।

ফলোয়ারের সংখ্যা শতক থেকে হাজারে পৌঁছে গিয়েছে কেবল এক রাতে। বিস্মিত হয়ে দেখল আশি ভাগ নতুন ফলোয়ার মেয়ে। অথৈ নিশ্চিত, এরা প্রায় সবাই বিভিন্নভাবে বডি শেমিংয়ের শিকার। এদের সবার নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানার আছে, বলার আছে।

মেসেজ রিকোয়েস্টিং বক্স পুরো ভেসে যাচ্ছে মেয়েদের বডি শেমিং–সংক্রান্ত মেসেজে। কত প্রতিভাবান, কত সুন্দরী, গুণী মেয়েরা অকপটে নিজেদের কথা লিখেছে। তারা অথৈকে চেনেও না; এটাও জানে না অথৈ তাদের মেসেজ পড়বে কিনা। শুধু একটা কথা অথৈ বলেছিল; lets talk! হাজার হাজার মেয়ে তাদের মনের দুঃখ অচেনা কারও সঙ্গে শেয়ার করে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টায় মত্ত।

অথৈ আর দেরি করল না। সবচেয়ে সহজ উপায়ে এতগুলো মেয়ের কাছে পৌঁছানোর সহজ সমাধানটি হলো ফেসবুক লাইভে যাওয়া। সে সেটাই করল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আনাড়ি অথৈ এটাও জানত না, ফেসবুক লাইভ হওয়ার আগে একটা পোস্ট দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় জানিয়ে দিতে হয়। তবেই না প্রচুর ভিউয়ারস পাওয়া যাবে!

তবে সে রাতের পর সবাই হয়তো অথৈর প্রোফাইলেই আনাগোনা করছিল। সে লাইভ স্টার্ট করার আধ ঘণ্টার ভেতরে হাজার হাজার ভিউয়ারস জয়েন করল। প্রায় সবার মন্তব্য পড়ে উত্তর দিয়ে কথাবার্তা বলার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে লাইভ করল অথৈ। লাইভের মাঝেই অনেকগুলো বিষয় নোটবুকে টুকে রাখল। প্রচুর শেয়ার হতে লাগল তার লাইভ। যেখানে আজকাল জামাকাপড় বিক্রির লাইভ শেয়ার করা বাবদ পুরস্কার দেওয়া হয়; মেকআপ লাইভ শেয়ার করা মাত্র ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়; ব্লগিং ও ভ্লগিং লাইভের যুগে অথৈর একটি সচেতনতামূলক মেয়েঘটিত সমস্যাজনিত লাইভ এত শেয়ার হবে, তা সে ভাবতেও পারেনি। যত শেয়ার তত তার ভিউয়ারস বৃদ্ধি পাচ্ছে। যতগুলো ভিউ পর্যন্ত পৌঁছেছে সে তার প্রায় পঞ্চাশ ভাগ আবার তার প্রোফাইলে এসে ফলো অপশনে ক্লিক করে ফলেয়ার হয়ে যাচ্ছে।

অথৈ একদিকে ভীষণ খুশি। রাতারাতি তার ফলোয়ারের সংখ্যা কয়েক হাজার হয়ে গেল তাই। আবার ভীষণ দুঃখ অনুভব করছে এই ভেবে যে এই ছোট্ট স্বাধীন দেশটায় মানুষ একে অন্যের বাহ্যিক গড়ন নিয়ে এত পরাধীনতার পরিচয় কীভাবে দেয়?

লাইভ শেষ করে অথৈ তার নোটবুকটা হাতে নিল। যে পয়েন্টগুলো টুকে রেখেছিল সেগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল। প্রায় কয়েক ঘণ্টার ঘাঁটাঘাঁটির পর সে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপার খেয়াল করল।

একটা সুন্দর স্বাস্থ্যের মেয়ের অল্প একটু ওজন বাড়াতে তাকে মোটা উপাধি দিচ্ছে তারই মোটা বান্ধবীটি।

একইভাবে দেখল অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল বর্ণের অধিকারী মেয়েগুলো কোনো একটা মেয়ের রোদে পোড়া চেহারা দেখে তাকে ‘কালো’ বলে খোঁচাচ্ছে!

এ রকম আরও গবেষণা করে অথৈ বুঝল আসলে যে মেয়েগুলো ছোট থেকেই পরিবার ও পরিবেশ দ্বারা পরোক্ষভাবে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছিল, তারাই বেশির ভাগ এই কাজটা করে আরেকজনের ওপর। এর থেকে অবাক করা বিষয় হলো, একটি মেয়ে অপর মেয়ের শরীরের খুঁত বের করতে যেন তৎপর! অন্যদিকে ছেলেদের পক্ষ থেকেও বডি শেমিং মন্তব্য আসে কিন্তু সেটি মেয়েদের অনুপাতে কম!

তার পরবর্তী পয়েন্ট সে দেখল, একটা মেয়ে আরেকটি মেয়ের শারীরিক কোনো খুঁত দেখলে যতটা আগ্রহী থাকে মন্তব্য করতে, পুরোপুরি খুঁতহীন মেয়েটি তত পরিমাণে প্রশংসনীয় মন্তব্য পায় না। মানে কী দাঁড়াল? তোমার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই? তবে তোমায় কেউ দেখেও দেখবে না। তোমার মধ্যে সমস্যা পাওয়া গিয়েছে? এবার তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখে আঙুল দিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করার মানুষের কোনো অভাব থাকবে না।

অথৈ জানে, সে অতিসাধারণ একজন। না সে পারবে পৃথিবী বদলাতে, আর না পারবে মানুষের মানসিকতা পাল্টাতে। তবু এতগুলো মেয়ে যখন তার কাছে মন খুলে সমস্যা শেয়ার করছে, তার একটা সচেতনতা প্রতিষ্ঠা করার কাজ সে করবে।

লেখিকা
লেখিকা

নিজের আবিষ্কার করা পয়েন্টগুলো সাজিয়ে অথৈ একটা পোস্ট দিল। সঙ্গে আরও লিখল, ‘আমরা মানুষেরা শুধু আমাদের শারীরিক সমস্যা খুঁজে বের করতেই সদাপ্রস্তুত! আমাদের এই সব বডি শেমিং মনোভাব এক দিনে; এক বছরে কিংবা এক প্রজন্মের ব্যবধানে দূর হবে না। আমরা যা করতে পারি, তা হলো নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসী থাকা। আমার আত্মবিশ্বাসই আমাকে বাঁচাতে পারবে জঘন্য বডি শেমিং আচরণের বিরুদ্ধে।’

অথৈ এই কথাগুলো শুধু লেখার জন্যই লিখল না, সে এই কথাগুলো নিজের ভেতরে খুব গভীরভাবে ধারণ করল। নিজেকে নিজে প্রতিজ্ঞা করল আর কখনোই কারও কথায় রেগে গিয়ে নিজের ওপর আস্থা হারাবে না। অত্যন্ত ব্যস্ত একটা দিন শেষ করে ঘুমোতে গেল বেশ শান্তিতে।

কিন্তু অথৈ জানত না, তার জন্য আরও অনেক চমক অপেক্ষা করছে। পরদিন সকাল হতে না হতেই ফোনের পর ফোন। বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নিতে চায়। তার মোটিভেশনাল বক্তব্য রেকর্ড করতে চায়।

অথৈ যেন স্বপ্নেই বসবাস করছিল। অনেক কষ্টে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো যে আসলেই তার সঙ্গে এমন কিছু হচ্ছে। যা সে চেয়েছিল গত দুই বছর ধরে। যা পাওয়ার জন্য হাতড়ে বেড়িয়েছে সুযোগ। আজ ধরা দিল সেই সুযোগ। খুশিতে পাগল হয়ে অথৈ প্রতিটা পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলকেই সময় দিয়ে ফেলল। বিখ্যাত হওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে যেন আবার কোনো ভুল না হয়ে যায়।

মাস তিনেক পরের কথা। এই তিনটা মাস কেমন টর্নেডোর মতো চলে গেল। হঠাৎ একটা টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউ বাতিল হওয়ার দরুন অথৈর হাতে আজকের দিনটা একদম ফাঁকা। এত দিনে যতটুকু বিখ্যাত হওয়ার সাধ ছিল তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি জনপ্রিয়তা সে পেয়েছে। ব্যস্ততার ফাঁকে যেন ফেসবুকের দেয়ালেও আনাগোনা করার সময় পেত না। আজ এত দিন পর ফাঁকা বিকেলে চায়ের কাপ হাতে ফেসবুকেই মন দিল।

মনের অজান্তেই মেসেজ রিকোয়েস্টে চোখ গেল। কত যে মেসেজ জমা রয়ে গিয়েছে। সেদিনের কথা মনে পড়ল তার। একটা একটা করে সব মেসেজ পড়ে উত্তর দিয়েছিল সে। এরপর? জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আর কখনো বডি শেমিংয়ের শিকার ওই মেয়েগুলোর কথা শোনার সময় হয়নি তার। আর কখনো জানতে ইচ্ছে করেনি সেই মেয়েগুলো কতটা আত্মবিশ্বাসী হতে পেরেছিল। তার জীবন বদলে গিয়েছে। সে শুধু তার বদলানো জীবনটাই উপভোগে ব্যস্ত!

নিজের ওপর কেমন একটা ধিক্কার জন্মাল অথৈর। কই, যে বিষয়টা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে আজ সে এত জনপ্রিয়, সেই বিষয়টা নিয়ে কী কাজ করল সে? পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলগুলোই বা কতটুকু সোচ্চার হলো? সবাই শুধু নতুন কনটেন্টের খোঁজে মরিয়া! অথৈ ভিন্ন বিষয়বস্তু তুলে ধরেছে। তাই তাকে নিয়ে মাতামাতি। বিষয়টা তো মাটিচাপা হয়েই রইল। খুব লজ্জিত বোধ করল সে। নিজের লাগাম নিজেই টেনে ধরল সে। সব ভুলে গিয়ে নতুন করে ফিরে গেল; যেখানে তার ফিরে যাওয়ার কথা।

অথৈ নতুন একটা পোস্ট দিয়ে আবারও মাঠে নামল; ‘বডি শেমিংয়ের শিকার বন্ধুরা; কে কতটুকু আত্মবিশ্বাসী হতে পেরেছ জানাও। Let’s talk!’

অথৈর পোস্টে কেমন সাড়া পেয়েছিল সে আমরা কল্পনায় দেখে নিতে পারি। অথৈ কতটা সচেতনতা তৈরি করতে পারবে তা হয়তো সে নিজেও জানে না। কিন্তু জীবনে সাফল্যের স্রোতে ভেসে যেতে যেতেও সে যে নিজের দায়িত্বটুকু মনে রাখতে পেরেছে, তাই বা কম কিসে! শ্রদ্ধা সেই সব কটি মেয়েকে, যারা প্রতিনিয়ত সমাজের কাছে নিজের খুঁত লুকানোর যুদ্ধে নিয়োজিত। আমরা কখনোই ভাবি না, স্রষ্টার তৈরি করা প্রতিটি জীব অনন্যসুন্দর। খুঁত ঢাকার মতো কোনো খুঁত আদতে আমাদের কারও মাঝেই বিরাজ করে না।