নরখাদকের হিংস্রতায় কলুষিত ললাট

প্রতীকী ছবি। ছবি: প্রথম আলো
প্রতীকী ছবি। ছবি: প্রথম আলো

ধানমন্ডির দুই ইউনিটের একটি বাড়ির তৃতীয় তলায় আমরা থাকতাম। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের অংশটি অসমাপ্ত ছিল। সেই জায়গাটা প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটে ছাদ হিসেবে ব্যবহার করত।

ডিসেম্বর মাসের উষ্ণ শীতের দুপুর। চারপাশের নৈঃশব্দ্যতা মধ্য দুপুরকে যেন গিলে খাচ্ছে। ফেরিওয়ালারা হাঁক দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কাকগুলোও ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

কলেজ থেকে ফিরে খাওয়ার পর্ব শেষ করে প্রায়ই রোদের আমেজ নেওয়ার জন্য কখনো শীর্ষেন্দু-সুনীল, কখনো বা সমরেশ আবার কখনো হুমায়ূন আহমেদের একটি বই হাতে নিয়ে ছাদের ইজি চেয়ারটায় আয়েশ করে গিয়ে বসি। কোথাও কোনো শব্দ নেই, এমন এক দুপুরে ছাদের চিলেকোঠার বন্ধ দ্বারের সামনে চেয়ারটায় বসে বই পড়ছিলাম।

হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের খটখট আওয়াজে নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। কেউ হয়তো ওপরে উঠে আসছে। ফিরে তাকাতেই দেখি দোতলায় এক খালাম্মা থাকেন। তিনি অনেক ভালো অমায়িক স্বভাবের একজন নারী। তাঁর ছোট বোন বিথি। কিছুদিন হলো বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর দুই বছরের কিউট একটি বাচ্চা ছেলে আছে। নাম তার নীল। সারাক্ষণ পটপট করে কথা বলে। দেখা হলেই আধো আধো গলায় কথা বলতে শুরু করে। কত যে প্রশ্ন তার চোখেমুখে! মাঝেমধ্যে খালাম্মার সঙ্গে আমাদের বাসায় আসে।

এক হাতে একটি কম্বল আর অন্য হাতে বালটি ভর্তি সদ্য ধোয়া কাপড় নিয়ে এসেছেন বিথি ছাদে শুকানোর জন্য। শাড়ির অর্ধেক কোমরে গোঁজা। যার নিচ থেকে ধবধবে সাদা পা উঁকি দিচ্ছে। দেখতে অনেক সুন্দরী কিন্তু চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা রাগী রাগী ভাব। সব সময়ই গম্ভীর হয়ে থাকেন। যেন রাজ্যের সব মানুষের রাগ তিনি ধার করে এনে নিজের চেহারায় লেপে রেখেছেন। তাঁকে কখনো হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই কারণে সচরাচর তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলা হয়ে ওঠে না।

একবার আড়চোখে তাঁকে দেখে আবার বই পড়তে লাগলাম। কাপড় মেলে দিয়ে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় আমাকে উদ্দেশ করে বলে গেলেন, এই মেয়ে, এমন রোদ্দুরে বসে আছ কেন? গায়ের বরণ কালো হয়ে যাবে তো। তাঁর উদ্বেগ দেখে আমি অবাক! মনের মাঝে একটুখানি ভালো লাগাও কাজ করল। বই থেকে চোখ সরিয়ে মিষ্টি করে একটু হাসি দিয়ে আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলাম।

কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পর আবারও শুনতে পেলাম কেউ ওপরে উঠে আসছে। এবার এল দোতলার অন্য ফ্ল্যাটের কাজের মেয়ে সালমা। যে ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছিল বাড়িওয়ালি আন্টির তিনজন অবিবাহিত ভাই আর সালমা একা। বাড়িওয়ালা বাড়িতে থাকতেন না বলে এই তিন ভাই একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। আর সালমা তাঁদের রান্নাসহ সব কাজ করে দিত। আমরা ভাইবোন সবাই তাঁদের মামা বলে সম্বোধন করতাম। বড় ভাই ব্যবসা করতেন আর ছোট দুজন ছিলেন বুয়েটে পড়া ছাত্র। মাঝেমধ্যে আমার দুই ভাই লেখাপড়ার ব্যাপারে দোতলায় তাঁদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে যেত।

১২ বছরের লম্বাচওড়া শ্যামলা গড়নের মেয়ে সালমা। মাথাভর্তি ঘন কালো লম্বা চুল কোমর পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটি দেখা হলেই একগাল হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আফা, কেমুন আছেন?

প্রতিদিন ছাদে আসে কাপড় শুকাতে। মাঝেমধ্যে টুকটাক এটা-সেটা নিয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের কথা বলে। আমিও আগ্রহ প্রকাশ করে ওর আপনজনদের কথা শুনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সালমা সবার বড়। অভাবের কারণে খালার হাত ধরে এক বছর আগে বরিশাল থেকে মা–বাবা, ভাইবোন ছেড়ে কাজের সন্ধানে এই স্বপ্নিল শহর ঢাকায় এসেছে।

এখানে কাজ হওয়ার পর থেকে মাস শেষে ওর খালা এসে মামাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যান তার মা–বাবাকে পাঠানোর জন্য।

সালমা প্রায়ই কিছুটা সময় পাশে বসে নিজের কথা বলে আবার চলে যায়। সেদিন কাপড় মেলে দেওয়ার পর আর সামনে এল না। আমি যেখানে বসে ছিলাম, সে জায়গা থেকে কিছুটা দূরে ছাদের এক প্রান্তে বিষণ্ন চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিল।

হঠাৎ অস্পষ্ট একটা আওয়াজ কানে ভেসে এল। কেউ ফুপিয়ে কাঁদছে। বই হতে মুখ সরিয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে কাঁদছে। বই বন্ধ করে ওকে কাছে আসার জন্য ডাকলাম। চোখ মুছতে মুছতে আমার সামনে এসে ধপ করে বসে পড়ল।

চোখমুখ দেখে বুঝতে বাকি রইল না মেয়েটি অনেক কেঁদেছে। এখনো কাঁদছে।

জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছিস কেন? কিছু বলল না। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? কেন কান্না করছিস? কেউ কি মেরেছে? মাথা নেড়ে না–সূচক জবাব দিল।

সালমার দিকে তাকিয়ে আমি অপেক্ষায় রইলাম। সে নিজ থেকেই যেন আমাকে বলে কী কারণে কাঁদছে। চুপ করে রইলাম বলে আবারও কাঁদতে লাগল। একসময় কাঁদতে কাঁদতে এমন কিছু কথা বলল, যা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। আতঙ্কে আমি নড়েচড়ে বসলাম। কী সব কথা বলছে এই মেয়ে!

সালমা বলল, প্রত্যেক দিন রাইতে ঘুমের মধ্যে মেজ মামায় (রুপন) আইসা আমার শরীর হাতড়ায়।

বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম। মানে? কোথায় হাত দেয়?

বলল সব জায়গায়। বলেই ফুঁপিয়ে আবার কাঁদতে লাগল। অনেক ব্যথা পাই আফা।

ও কী বলতে চাইছে বুঝতে আমার আর বাকি রইল না। সালমার শরীরের অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় রুপন মামা হাত দেন। জিজ্ঞেস করলাম, কবে ঘটেছে এই ঘটনা?

সালমা বলল, রোজ রাইতেই এমন করে আফা। আইজকা জোর কইরা পায়জামার ফিতাখান ছিঁড়া ফালাইছে। ব্যথায় টিকতে না পাইরা যহন জোরে জোরে কান্দন লাগছি, তহন মুখ চাইপা ধইরা আমারে কয় চুপ কর, চুপ চুপ। চিল্লাইলে মাইরা ফেলামু। খবরদার কাউরে কইবি না এই কথা। বলেই আমার হাত দুটো ধরে পায়ের কাছে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সব কথা শুনে আমার হাত-পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। নিজের অজান্তেই মনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম। আসলেই কি এই মেয়ে সত্যি বলছে? পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, মিথ্যা বললেই বা ওর স্বার্থ কোথায়?

এতটুকু একটি মেয়ের কান্না, কষ্ট দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। সালমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে-ভেতরে আমিও ডুকরে কেঁদে উঠলাম। ওকে বুঝিয়ে বললাম, আমাকে যে সব কথা বলে দিয়েছিস, এইটা যেন মামা জানতে না পারে। আর তোর খালা এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস।

মাথা নিচু করে কতক্ষণ বসে ছিলাম, জানি না। একসময় খেয়াল করলাম বইয়ের পৃষ্ঠা ভিজে যাচ্ছে। সালমার জন্য কী করতে পারি? কিছু একটা তো করা উচিত—এই মনোবল নিয়ে নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালাম। দুই রাত ঘুমাতে পারলাম না। মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারছি না ঘটনাটি। থেকে থেকে সালমার নিষ্পাপ চেহারা চোখে ভেসে উঠছে। যতবার ওর কান্না জড়ানো কণ্ঠ কানে বেজে ওঠে, ততবারই আমার হৃদ্‌যন্ত্রের আওয়াজ আরও বেড়ে যায়।

শিক্ষিত আর ভদ্রতার মুখোশ পরা রুপন মামার কথা মনে পড়তেই বমি আসে। বই পড়ার বাহানায় সালমার অপেক্ষায় থাকি কখন ও ছাদে আসবে। কলেজ থেকে ফিরে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেলেই ছাদে দৌড়ে যাই। কিন্তু ওকে আর দেখতে পাই না। মনের মধ্যে প্রচণ্ড রকম এক ভয় আর অস্থিরতা কাজ করছে সালমার জন্য। আমার এই অস্বাভাবিক আচরণ একসময় মায়ের চোখকে আর এড়ানো সম্ভব হলো না। মাকে সব কথা খুলে বললাম। যেহেতু বাড়িওয়ালি আন্টির ভাই সেখানে, মায়ের মাধ্যমে আন্টির কান পর্যন্ত ঘটনাটি পৌঁছাতে আর সময় লাগল না।

কিছুদিন পর সালমা আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল, আফনে খালারে বুঝাইয়া না কইলে আমার কথায় খালা কোনো দিন বিশ্বাস করত না। আফনের কথা আমার সব সময় মনে থাকব আফা। তার দুই মাস পর আমরাও নতুন এক বাসায় গিয়ে উঠলাম যে বাড়িতে কোনো ব্যাচেলর ছিল না।

এই ভূখণ্ডের কতশত ঘরে না জানি এমন অসহায়–নিপীড়িত সালমারা নিজের সর্বস্ব হারিয়ে বেঁচে আছে। পেটের দায়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে এসে ভদ্রতার আবরণে আবৃত, মুখোশধারী নরখাদকদের কাছে রাতের আঁধারে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে ভোগের শিকার হচ্ছে। সম্ভ্রম হারিয়ে নিজের অসহায় পরিস্থিতিকে শিকার করে দিনের আলোয় নীরবে চোখের জল ফেলে পরিবারের পেটের খোরাক জোগান দিচ্ছে।

দুই
বছরে অন্তত একবার হলেও গরম অথবা শীতের সময় ছুটিতে পরিবারসহ আব্বু আমাদের সাত দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে দাদির কাছে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই সাত দিন আমরা তিন ভাইবোন দাদির আদরে, আহ্লাদে বছরের শ্রেষ্ঠ সময় কাটাতাম। তখন মায়ের শাসন আর বাঁধাধরা কোনো নিয়মের বেড়াজাল থাকত না।

দাদি রাশভারী টাইপ গম্ভীর নারী ছিলেন বলে সবাই তাঁকে অনেক ভয় পেত। সহজে কেউ তাঁর কাছে ঘেঁষতে সাহস পেত না। কিন্তু আমাদের বেলায় তাঁর আচরণ ছিল একেবারেই ভিন্ন। তাঁর মনটা ছিল অনেক কোমল। নারকেলের মতো ওপর দিয়ে শক্ত ভেতরে একদম নরম।

আমরা বাড়িতে গেলেই তাঁর আদরের ভান্ডার যেন উপচে পড়ত। দাদির হাতের হরেক রকমের পিঠা মজার মজার খাবার। ফুপি, চাচা, চাচি সবার আদরে কী করে যে সময় পেরিয়ে যেত, টেরই পেতাম না। সঙ্গে বোনাস হিসেবে থাকত কাজিন আর তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সারা দিনব্যাপী আনন্দ খেলা আর মোউজ-মাস্তি করা।

গ্রামে আব্বুর ছোটবেলার এক বন্ধু ছিলেন। দুজনের একই নামে নাম। গ্রামের বাড়িতে যখনই যেতাম, এক রাত হলেও আমরা সবাই তাদের বাসায় বেড়াতাম। ওই চাচুর ছোট মেয়ে বেলা ছিল আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই একই ক্লাসে পড়তাম চতুর্থ শ্রেণিতে। সারা দিন কত যে আনন্দ আর দুষ্টুমি করতাম দুজনে মিলে, স্মৃতির মণিমালায় গেঁথে আছে ফেলে আসা সেই দিনগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনি। এখনো সেসব দিনের কথা মনে পড়লে পুলকিত হই।

সাঁতার জানি না বলে পুকুরপাড়ের ঘাটে বসেই সব সময় জগ দিয়ে গোসল করি। বান্ধবী বেলা আমাকে ছোট ছোট মাছ ধরে দেয় আর একটু পরপর সাঁতার দিয়ে আমার গোসল করার জন্য দূরে পুকুরের মাঝখান থেকে জগ ভর্তি করে পরিষ্কার পানি নিয়ে আসে। ঘণ্টা ধরে পানি দিয়ে খেলা করতে করতে আমরা দুজনে গোসল করি। যেখানে বসে আমি গোসল করি ঠিক তার নিচে পানিতে ছোট ছোট মাছ সাঁতার কাটে। দেখতে আমার কী যে ভালো লাগে। বেলা সেই মাছ মুঠো করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। আমি সুড়সুড়ি অনুভব করি হাতে নিয়ে মাছের সাঁতার কাটা দেখি। একটা একটা করে মাছ জগের ভেতরে জমা করে রাখি। এইটা ছিল আমাদের কাছে মজার একটি খেলা। আমার আনন্দের সীমা নেই দেখে বেলা আরও উৎসাহ নিয়ে আমাকে মাছ ধরে এনে দেয়।

এমনই একদিন দুজনে মিলে গোসলের বাহানায় মাছ ধরার খেলা করছিলাম। ওই মুহূর্তে সেই জায়গায় বেলার এক চাচা নাম মানিক পুকুরে গোসল করতে নামলেন। আমাদের সামনেই গোসল করছিলেন তিনি। আমার নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জানো না? বললাম, না। তিনি বললেন, আসো তোমারে শিখাইয়া দিই। বললাম না, আমি ভয় পাই পানিতে নামতে। ভয়ের কিছু নাই, আসো, অনেক সহজ। দুই দিন ট্রেনিং দিলেই শিখা যাইবা, আসো।

আমি আবারও মাথা নেড়ে না বললাম।

তিনি একটু হাসি দিয়ে গোসল করতে লাগলেন।

হঠাৎ দেখতে পেলাম পানির ওপর ধস্তাধস্তি চলছে। বেলা প্রাণপণ চেষ্টা করছে চাচার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আর চিৎকার করে বলছে, ছাড়েন আমারে ছাড়েন। আমার মনে হচ্ছিল চাচা হয়তো দুষ্টুমি করে বেলার পা ধরে টেনে রেখেছেন। ছেড়ে দিচ্ছেন না বলে ও চিৎকার করছে আর এসব দেখে আমি হাসছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম চাচা বেলাকে ছেড়ে দিয়ে সাঁতার কেটে অন্যদিকে চলে গেলেন আর বেলা হাঁপাতে হাঁপাতে পানি থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসল। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম বেলা কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? ও কিছু বলল না, কাঁদতে লাগল।

ভয় পেয়ে গেলাম, রাগ করে আমার সঙ্গে হয়তো বন্ধুত্ব রাখবে না বেলা। ভাবলাম আমি হেসেছি বলে বেলা এই কারণে কষ্ট পেয়ে কাঁদছে। ও কিছু বলার আগেই আমি তৎক্ষণাৎ হরবর করে ওকে সরি সরি বলতে শুরু করলাম। বেলা মাথা নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল তোমার হাসির জন্য কান্না করছি না। তবে কেন কাঁদছ? আমি তো ভেবেছি চাচা তোমার পা ধরে রেখেছেন, তাই হাসতেছিলাম। বেলা বলল, না, পা টেনে ধরেননি। সে বলল, মানিক চাচা পানিতে নামার পর বেলাকে ধরে রেখেছে ঠিকই কিন্তু ওর শরীরের গোপন স্থানে জোর করে হাত দিয়ে রেখেছিলেন। তাই বেলা তাঁর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল।

এতটুকু বয়সে এমন ভয়ংকর কথা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। পানির মধ্যে বসে ছিলাম, ভয়ে আমার শরীরের রক্ত যেন হিমশীতল হয়ে গেল। চোখের সামনে এমন লজ্জাজনক ঘটনায় আমি হতভম্ব বিহ্বল।

লেখিকা
লেখিকা

তাড়াতাড়ি গোসল সেরে মায়ের কাছে দৌড়ে গেলাম। মাকে বললাম, আমি এক্ষুনি দাদির বাড়িতে চলে যাব। চলে যেতে চাচ্ছি শুনে মা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, কেন যেতে চাও? তুমিই না এই বাড়িতে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকো, তবে যেতে চাইছ কেন? কিছু না বলে মায়ের ধমক খেয়ে আরও আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে শুরু করলাম, আমি দাদির বাড়িতে যাব। এবার মা একটু অবাকই হয়ে গেলেন। মায়ের এই সামান্য ধমকের কারণে কান্না করার মতো মেয়ে আমি নই। কান্না দেখে তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে মা আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বলো তো আমাকে। কেন চলে যেতে চাইছ? কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর আমি কিছুই না বলাতে কান্না থামানোর জন্য মা বুকে টেনে নিয়ে আমাকে আদর করতে লাগলেন। আদর পেয়ে মনে কিছুটা সাহস পেলাম। কিছুটা শান্ত হওয়ার পর মায়ের কাছে নির্ভয়ে সব ঘটনার বর্ণনা করলাম। কথা শুনে মা আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।

বেলাকে ডাকা হলো মা আর চাচির সামনে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য। আমি মাকে যা যা বলেছিলাম, বেলাও চাচির সামনে কাঁদতে কাঁদতে একই কথা বলল।

শুধু এতটুকুই মনে আছে সেদিনের কথা। ওই বাড়িতে অনেক বড়সড় একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। সেবার ওই ঘটনার কারণে আমাদের সব আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে মা আমাকে সব সময় তাঁর চোখের পলকের মাঝে রাখতেন। একা কোথাও যেতে দিতেন না। যেখানেই যেতাম অথবা বাসায়ও কেউ এলে মা সব সময়ই আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন। আজও ওই দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেলে ঘৃণায় আমার পেট গুলিয়ে ওঠে চাচা নামক পিশাচ লোকটির প্রতি।

ঘরের মানুষের কাছে যদি একটি শিশু বাচ্চার নিরাপত্তা না থাকে, তবে বাইরের মানুষের কাছে আর কী ভরসা? আমার মা আমাকে চোখের পলকে রেখে নিজের ছায়া দিয়ে যে পথে হেঁটে এসেছেন, ঠিক সেই পথেই আমিও আমার সন্তানদের নিয়ে হেঁটে চলার চেষ্টা করছি। আমাদের এই তথাকথিত সমাজে প্রতিটি ঘরে ঘরে অবুঝ শিশু, কিশোরীদের এমন ভদ্রবেশী মুখোশধারী হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি মায়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।