দীনতায় ভরা দেশপ্রেম আমার

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

প্রাচুর্যময় দেশ, সুন্দর সাজানো–গোছানো, নিপাট পরিপাটি, তক্কে তক্কে সবুজাভ সুন্দরী দেশ সুইজারল্যান্ড। আইনের প্রতি অতি সচেতনতাবোধ, শৃঙ্খলাপরায়ণ, শান্তিপ্রিয় উচ্চমার্গীয় জীবনবোধ সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীদের।

নৈসর্গপ্রেমী সুইসরা প্রকৃতির একরাশ শূন্যতা ও নিবিড় সান্নিধ্যে সম্পূর্ণ গ্রামীণ আবহে প্রকৃতির কোলে যেন সমর্পিত আর সাধারণ জীবন যাপন করেন। কেউ কারও কাজে নাক গলান না। কারও প্রতি বিরুদ্ধাচার আচরণ করেন না।

পাহাড়ের ঢালু পথে আঙুর আর আপেলখেতের মাঝে দোতলা কাঠের বাড়ি। সঙ্গে লাগোয়া সবজিবাগান বা ফার্ম হাউস। বাগান থেকে উঠিয়ে বাগানেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া। এটা কিন্তু এখানকার গ্রীষ্মকালের চিত্রপট।

আমরা সবাই জানি, গ্রীষ্মকালে ইউরোপজুড়েই একটা ছুটির আমেজ। সবাই ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করে। এই ঘোরাঘুরির মধ্যে আছে এক মানসিক প্রশান্তি। দেখা ও জানার এক অপার শিক্ষালয় যেন।

পাহাড়ে বা ফার্ম হাউসগুলোয় তারা শৌখিনভাবে নিজেদের প্রকৃতির কাজে লাগায়। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কখনো নষ্ট করে নয়। পাহাড়ের উচ্চতা বা আদল অনুযায়ী বাড়িগুলো তৈরি করে। পাহাড় কেটে নয়।

প্রকৃতি বাঁচিয়ে নিজেদের আবাস ঠিক করে। আবাসের জন্য সবুজকে বিসর্জন দেয় না; বরং বাঁচিয়ে রাখে। নাগরিক জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা সব জায়গায় সমান বলেই সুইসরা গহিন অরণ্যেও এত সুন্দর জীবন কাটায়।

জনগণ কীভাবে কিসে ভালো থাকবে, তার ওপর নির্ভর করে সুইস সরকারের কাজকর্ম। অর্থাৎ সবকিছুই জনগণবান্ধব নীতিমালা। রাত ১০টার পর কোনো উচ্চকিত শব্দ বা আওয়াজ করা যাবে না। কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না।

প্রায়ই চিন্তা করি, এত কিছু থাকা সত্ত্বেও পোড়া মন, পোড়া চোখ আমার। শুধু পোড়া দেশটার কাছেই ছুটে চলে।

চ্যানেল আইয়ের টিভি পর্দায় সেদিন দেখলাম মেয়র আতিকুল ইসলাম সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আমরা দেশের বাইরে থাকলে সে দেশের নিয়ম নীতিগুলো খুব সুন্দর আর সম্মানের সঙ্গে পালন করি। কিন্তু নিজ দেশে আমরা কজন তা করি। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক জায়গায় সুসম্পন্নভাবে করলেই আমরাও একটি সুন্দর নগর তৈরি করতে পারি।’

সচেতনতা বোধ আর সুশাসনের অভাবে আমাদের অনেক ভালো কাজ আর অর্জনগুলো আমরা ধরে রাখতে পারছি না। ন্যূনতম দেশপ্রেমের আলোটা জ্বালিয়ে রাখা বড্ড দরকারি হয়ে পড়েছে। শুধু সুস্থ মানসিকতার আর পারস্পরিক সম্পর্কের শ্রদ্ধাবোধের অভাবে আমরা সৃষ্টির সেরা জীবের পরিচয়টুকু হারিয়ে ফেলছি।

চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী জীবিত থাকাকালে এক প্রদর্শনীতে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশপ্রেম বলতে তিনি কী বোঝেন। স্যার সহাস্যে বললেন, ‘তুমি আগে তোমার নিজেকে ভালোবাসো। নিজেকে ভালোবাসলে স্বাভাবিকভাবে তুমি অনেক ভালোত্ব ধারণ করতে পারবে। আর সেই শুভবোধ থেকেই তুমি দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করবে। শুভবোধ আর তাগিদই আমার কাছে দেশপ্রেম।’

আজ অনেক দিন পর স্যারের কথাগুলো মনে পড়ল। এখন নিজেকে আমি সেই শুভবোধের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দেখি। নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদা, খাবিখাওয়ার তত্ত্ব বিলাস, বিভেদ, হায় হায়, খাই খাই, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটিতে দেশপ্রেম আজ দুই আনার সিকির মতোই অচল সাধারণের কাছে। এখন তো বর্গি নেই। হায়েনা নেই। শোষক নেই। স্বৈরাচার নেই। তাহলে অনেক আশার মাঝে, সফলতার মাঝে কেন এত নিরাশা আর নৃশংসতা!

ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম বা বর্ণের হলেই মানুষ মানুষকে মেরে ফেলতে হবে? চারিত্রিক জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গায়ে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে? সম্পত্তির জন্য ছেলে বাবাকে, বাবা ছেলেকে মেরে ফেলতে পারে?

মা তাঁর সন্তানের জন্য রুটি, গোশত রান্না করে দিয়েছিলেন। হলে ফিরে ছেলে খাবে। বুয়েটের হলে ছেলে সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকবে, তাই মেডিকেলে পড়তে পাঠাননি।

ছেলেটি মাটির ঘরে শুয়ে ঘুমায় এখন!

অথচ আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা উদাত্ত আহ্বানে বাংলার মানুষ মা-মাটির মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন কিন্তু মানুষে মানুষে কোনো ধর্ম, বর্ণ ও দলভেদ ছিল না। এক বাঙালি জাতিসত্তার জন্য বাঙালি পরিচয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

ব্যর্থতা একান্তই রাষ্ট্রের হতে পারে না। আমরা জনগণ কতটুকু মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হতে পেরেছি? সেটা আগে ভাবতে হবে। পাপীকে ছেড়ে আগে পাপ ছাড়ি। নিজের শরীর থেকে আগে দুর্গন্ধ ছাড়াই, তারপর অন্যের দিকে তাকাই। তা না হলে থুতু কিন্তু নিজের গায়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

আজকের লেখাটি সম্পূর্ণ আমার কিছু ব্যক্তিগত রসদ দিয়ে সাজিয়েছি। কারণ, আমি নিজে যা ধারণ করি, শ্রদ্ধা করি তাই প্রকাশ করতে পছন্দ করি। শুধু ঘুরে বেড়ানোর তাগিদে আমি কোথাও যাই না। আমার লেখালেখির বিষয় আর সেই সঙ্গে নতুন দেশ বা জায়গাটার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ইতিহাস জানার এক প্রবল ইচ্ছা আমার মধ্যে কাজ করে। যেখানে যত দূরে যাই না কেন, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ধারণ করে মনে হয় নিজের দেশের জন্য বয়ে নিয়ে যাই।

কিছুদিন আগে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়া গিয়েছিলাম। কাজিন আনিস ইসলামের আমন্ত্রণে দেশটা ঘুরে দেখে জানতে পারি অনেক কিছু। গুগলে সার্চ দিলে হয়তো অনেক তথ্য–উপাত্ত জানা যায় ঠিকই, কিন্তু দেখার চোখ হচ্ছে সবচেয়ে জীবন্ত উদাহরণ। আমি তাই মনে করি।

দক্ষিণ–মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া। ঐতিহাসিকভাবে দেশটি নানা সময়ে নানান দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে স্লোভেনিয়ার জন্ম। আর এই সময়ের মধ্যে নানা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্যেও স্লোভেনিয়ার অর্থনীতি ক্ষুদ্র, উন্মুক্ত ও রপ্তানিনির্ভর। আর এর মূল শক্তি অর্থাৎ অর্থনৈতিক মূল শক্তি হচ্ছে সেবা খাত ও শিল্প খাতের মাধ্যমে স্লোভেনিয়া দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রত্যয়ের পেছনে আছে এদের অদম্য দেশপ্রেম। আগে যা হওয়ার হয়েছে, এখন তারা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, একতাবদ্ধ হয়ে দেশের স্বার্থে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি আর তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতের তৈরি মাটির জিনিসপত্র, বিভিন্ন দামি পাথরের, তৈজসপত্র দেখে খুব ভালো লাগল। অল্পতেই যেন তুষ্ট ওরা। ১৯৯১ সাল থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।

আমরা ১৯৭১ থেকে চেষ্টা করছি দশ কদম এগিয়ে যেতে। কিন্তু পাঁচ কদম পিছিয়ে যাচ্ছি। শুধু ব্যক্তিগত লোভ, কলহ আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবে।

প্রবাসজীবনে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি মনটাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়, তা হলো আমরা বাঙালিরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করি। নিজেদের বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে অমুক তমুক জেলা বা এলাকার পরিচয়ে আবার অমুক জেলা সমিতি, সংগঠন নামে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। একবারও ভেবে দেখি না, ওই অমুক তমুক জেলা কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অংশ। দেশটাকেই আপন করে নিতে পারি না, তার ওপর সভা সমিতির পরিচয়!

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় ইস্যুতে কিন্তু সব দল আর মতের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে দেশের স্বার্থে।

ছাত্রজীবনের শেষ পর্যায়ে ডেনমার্ক সরকারের আর্থিক সহায়তায় সাংবাদিকতার ওপর একটি ফেলোশিপ কোর্সে আমি মনোনীত হই এবং যথারীতি করেও ফেলি। সৌভাগ্যবশত, দেশের প্রথিতযশা অনেক সিনিয়র সাংবাদিককে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম।

অন দ্য রেকর্ড আর অব দ্য রেকর্ড বোঝার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনে তৎকালীন নির্বাচিত সাংসদ প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকার নিতে আমাদের তিনজন শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, দেশপ্রেম বলতে তিনি কী বোঝেন। উত্তরে জানালেন, ‘শুধু চটি জুতা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে কাঁধে ঝোলানো চটের ব্যাগে দেশি মাগুর মাছ আর দেশি মুরগির ঠ্যাংয়ের মধ্যেই দেশপ্রেম বসে থাকে না।’ তাঁর কাছে দেশপ্রেম মানে নিজে না খেয়ে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া, যা তিনি দেখেছেন হাওরে জেগে থাকা অভুক্ত জেলেদের চোখে। সাধারণরা যেভাবে ধারণ করেন, আমরা সবাই যদি ঠিক সেভাবেই দেশটাকে ধারণ করতে পারতাম।

অব দ্য রেকর্ডের কথা না হয় বাদই দিলাম।

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন রিপোর্ট দপ্তরের সাবেক পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সেলিম জাহান প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অকপটে আমাদের বর্তমান বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ‘সামাজিকভাবে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আগে আমরা আত্মিক সম্পর্কে আর এখন আর্থিক সম্পর্কের দিকে ধাবমান। সমাজব্যবস্থা ভেঙে আমরা আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আগ্রাসী পুঁজিবাদের কারণে আমাদের মধ্যে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে এসেছে। শুধু বিত্তশালী নয়, প্রান্তিক দুর্বলদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতে হবে। উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে।’

আমিও এই কথাগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করি বলেই আমার এই লেখায় তাঁর বক্তব্যের সারাংশ তুলে ধরেছি।

বিশ্বাস থাকে চেতনা ও মর্যাদায়। সেই মর্যাদায় আমাদের আরও সুসংহত হতে হবে। শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জীবনবোধকে ভাইরাল না করে, অতিরঞ্জিত শো অফ না করে জীবনকে জীবনের মতোই সাদাসিধে দেখা উচিত।

একমুঠো মাটির জন্য, ক্ষমতার জন্য, নিজেকে শক্তিধর জাহিরের জন্য দেশের ক্ষতি করা থেকে কেন আমরা পিছপা হব না। এই মাটি আর ক্ষমতার জন্যই তো আমাদের এত বিভেদ, হানাহানি, মারামারি, পৃথিবীজুড়ে অস্থিরতা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে হইচই, সর্বত্র আমিত্ববাদ, কামনা বাসনায় পশুত্ব ভাব। কোথায় যাচ্ছি আমরা? ঠিকানা শুধু সাড়ে তিন হাত মাটি, সেই মাটির ঘরে কিছুই নিয়ে যাওয়ার জো আমাদের নেই। এরপরও কিন্তু থামতে হবে।

পোড়া মন আজ শুধু পোড়া দৃষ্টি নিয়ে লিউ তলস্তয়ের বিখ্যাত উক্তিটিকে আওড়ে যাচ্ছে: ‘How much Land Does a man require?’