স্বপ্নভ্রম

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

শীতের সকাল। ঘিয়ে ভাজা গরম-গরম পরোটার সঙ্গে গরুর মাংসের ভুনা আয়েশ করে খাচ্ছেন ফরিদ সাহেব। নাশতার ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছেন।

ফরিদ সাহেবের স্ত্রী শায়লা সুলতানা ধোঁয়া–ওঠা চায়ের কাপটা এনে ফরিদ সাহেবের সামনে রাখলেন।

: দেখো তো চিনি ঠিক আছে কি না?

ফরিদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে চায়ে চুমুক দিলেন। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে শায়লাকে বললেন, শায়লা তোমার আমার বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো?

শায়লা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, বারো!

: হুমম এক যুগ! এই এক যুগেও তুমি স্বামীর চায়ে ঠিকমতো চিনি দিতে শিখলে না? আমি দেড় চামচ থেকে একটু বেশি আর দুই চামচ থেকে একটু কম পরিমাণ চিনি চায়ে দিতে বলি। আর তুমি?

শায়লা বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, তোমার এই উদ্ভট চিনির পরিমাণ আমি বুঝতে পারি না। আমার কাছে ঠিকই মনে হয়। তুমিই প্রতিদিন আমার ভুল ধরার জন্য বসে থাকো।

: কী বললে? আমি তোমার ভুল ধরি? এটা চা না শরবত? তুমি চিনির দাম কত হয়েছে জানো? জানবে কী করে? তুমি তো আর চাকরি করো না। সারা দিন বাসায় বসে থাকো। টাকা কোন দিক দিয়ে খরচ হয় টের পাও?

: দেখো কথায় কথায় চাকরি নিয়ে খোঁচা দেবে না। প্রতিদিন সকালে তোমার ঝগড়া করতে হবে এটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি সারা দিন বসে থাকি না। আমার অনেক কাজ থাকে সংসারে।

ফরিদ সাহেব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, তোমার আর কাজ! আচ্ছা শোনো, আমার সাদা শার্টটা ভালো করে ধুয়ে আয়রন করে রাখবে। কাল আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে।

মলিন মুখে শায়লা শার্টটার দিকে তাকাল। তারপর বলল, তোমাকে কত করে বলেছি একটা কাজের বুয়া রাখি, তুমি কিছুতেই রাজি হও না। এত কাজ আমি একা সামাল দিতে হিমশিম খাই। বাথরুম ভরা কাপড়। আবার শার্টটাও ধরিয়ে দিলে। রান্নাঘরে এতগুলো হাঁড়ি–পাতিল, থালা-বাসন। সব আমাকেই ধুতে হবে।

ফরিদ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন। কী বললে? কাজের বুয়া? তুমি কি চাকরি করো যে কাজের বুয়া লাগবে? সারা দিন বাসায় থেকে সংসারের কাজ করতে তোমার এত কষ্ট লাগে? আমি অফিসে কত কাজ করি সে হিসাব আছে তোমার? এত আলসেমি ভালো না। আমাদের কোনো সন্তানও নেই যে তোমার...।

ফরিদ সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। বারো বছরের সংসারজীবনে একটি সন্তানের অভাব তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

: শার্টটা ধুয়ে আয়রন করে রেখো। বলে ফরিদ সাহেব নীরবে বের হয়ে গেলেন।

শায়লা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। সন্তানের কথা উঠলেই বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমা হওয়ার আগে নিজেকে সামলে নিল শায়লা। সোজা বাথরুমে চলে গেল কাপড় ধুতে।

এক বালতি কাপড় ছাদে শুকাতে দিয়ে এসে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল শায়লা।

আর পারি না। জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেল। সারা দিন কাজ আর কাজ। এই অ্যাপার্টমেন্টে সবার ঘরে কাজের লোক আছে শুধু আমার ঘরেই নেই। আমার ঘরেও কাজ করতে হবে, বাজার সদাইও করতে হবে। উনি কেবল অফিস করবেন আর আমাকে সবকিছু নিয়ে কথা শোনাবেন। অসহ্য! একটা সন্তান নেই বলে কত তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে অথচ বিয়ের ছয় মাসের মধ্যে যখন সন্তান গর্ভে এল তখন তার জন্যই জন্মের আগেই সেই সন্তানকে...কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল শায়লার।

ফরিদ তখন বেকার। পালিয়ে দুজন বিয়ে করেছে। কিন্তু সংসার চালানোর অর্থ নেই। দুজন মিলে টিউশনি করে কোনোরকমে দিন পার করছে। এর মধ্যে সন্তান যেন অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফরিদের চাপাচাপিতেই অ্যাবরশন করতে বাধ্য হয়েছিল শায়লা। আজ তারই মাশুল দিচ্ছে। এরপর বারো বছরে আর একটিবারের জন্য শায়লা সন্তানসম্ভবা হয়নি। শায়লার ধারণা, বিধাতা তাকে অভিশাপ দিয়েছেন। তাই আজ শত চেষ্টায় সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছে না।

এসব কথা মনে পড়লে মেজাজ আরও বিগড়ে যায়।

সিঙ্কের ওপর পড়ে থাকা এঁটো বাসনপত্র ধোয়া শেষ করে পুরোনো পাতিলটায় হাত দিল শায়লা। তলাটা একেবারে কালো হয়ে আছে। না মেজে উপায় নেই। শায়লা প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে পাতিলটা মাজা শুরু করল। কিছুতেই কালো দাগ দূর হচ্ছে না। শায়লা একা একাই চিৎকার করছে।

সে কি আমাকে মানুষ মনে করে? সকাল থেকে আমার কাজ শুরু হয় আর শেষ হয় রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। আরে একটা ছুটা বুয়া রাখলেও তো হয়। সব তার ষড়যন্ত্র! আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই এমন করে। ঢাকা শহরে কার বাড়িতে বুয়া নেই? শুধু আমিই হতভাগী। আজ যদি আমার কাছে আলাদিনের একটা জাদুর প্রদীপ থাকত, তবে আমিও প্রদীপ ঘষে একটা দৈত্য নিয়ে আসতাম। তাকে আদেশ করতাম আমার সব কাজ করে দাও। আমি একটু বিশ্রাম করি। কত দিন হারমোনিয়ামটা অযত্নে পড়ে আছে। একটু গলা সাধি।

কালো পাতিলটায় সজোরে ঘষা দিল শায়লা। মুহূর্তে চারদিকে ধূম্রজালের সৃষ্টি হলো। কিছু সময়ের জন্য শায়লা কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ শুনতে পেল...হু হা হা হা খালাম্মা?

শায়লা চমকে উঠে বলল, কে?

শায়লার সামনে বিকট আকৃতির কালো, মোটা এক দৈত্য। ফকফকে সাদা দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসছে। তবে এ দৈত্য পুরুষ না। নারী। একদম এক প্যাঁচে শাড়ি পরা কাজের বুয়াসদৃশ। শায়লার চোখ চকচক করে উঠল।

বুয়া? শায়লা যেন খুশিতে আত্মহারা।

তুমি কখন এলে? নিশ্চয়ই তোমার খালুজান পাঠিয়েছে? ও একবার বলেছিল অফিসের স্টাফ বশিরকে বলেছে একটা কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করতে। দেখো তো আমি কী? কতই না ভুল বুঝেছি ওকে। যাকগে সেসব কথা। বুয়া এই পাতিলটা তাড়াতাড়ি মেজে দাও। কিছুতেই কালো দাগ তুলতে পারছি না।

খালাম্মা? আপনি আমারে বুয়া মনে করলেন? আমারে কোন দিক দিয়া বুয়া মনে হয়?

শায়লা ভ্রু কুঁচকে বলল, চলনে–বলেনে সব দিক দিয়েই বুয়া মনে হয়। কেন বুয়া ডাক শুনতে তোমার আপত্তি আছে? তাহলে তোমার নাম কী বলো। আমি নাম ধরেই ডাকব।

আমার নাম জিনি।

জিনি? বাহ্ সুন্দর নাম। যাও জিনি হাতের কাজগুলো শেষ করে ফেলো। আমি ওদিকটায় দেখি।

জিনি চিৎকার করে উঠল।

আপনি আবারও আমাকে বুয়াই মনে করছেন। আমি বুয়া না। আমি আপনার পাতিলের দৈত্য জিনি। আপনি আমার মুনিব। আপনি আমাকে যা বলবেন আমি তা–ই করব। আমি আপনার তিনটা উইশ পূরণ করবই।

উইশ? শায়লার চোখ কপালে!

জি উইশ! আবার জন্মদিনের উইশ ভাইবেন না। আমি তিনটা ইচ্ছাপূরণের কথা বলছি।

বুয়া তুমি কী যা–তা বলছ?

উহ্! আবার বুয়া! আমি বুয়া নই। আমি জিনি। আপনার পাতিলের দৈত্য। আপনি পাতিল ঘষা দিলেন আর আমি বাইর হইলাম। একটু ভালো কইরা দ্যাখেন আমারে।

শায়লা এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল। মুহূর্তেই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এল। এক চিৎকারেই মূর্ছা!

আধা ঘণ্টা পর।

চোখ খোলেন খালাম্মা! ভয় নাই। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আমি আপনার সব আদেশ পালন করতে বাধ্য।

শায়লা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই আলাদিনের সেই দৈত্য? সে তো প্রদীপের ভেতরে ছিল। তুমি পাতিলের ভেতরে কী করে এলে?

আমি আলাদিনের দৈত্য হব কেন? তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। আমাদের দৈত্যসমাজে কি শুধু একজন দৈত্য? হাজার হাজার দৈত্য। কেউ প্রদীপে থাকে, কেউ কেউ পাতিলে থাকে, কেউ জগে, কেউ মগে, কেউ বদনায়...।

থাক, থাক! আর বলতে হবে না। তুমি পাতিলে কী করে এলে?

সে এক বিরাট ইতিহাস! পরে একসময় বলব। এত দিন এক গ্রামে কৃষকের বাড়িতে ছিলাম। তারা বড়ই বোকা। পাতিলটায় ঘষা দিয়া কখনো আমারে স্মরণ করে নাই। তাই আমিও বাইর হই নাই। তাদের সুখ–দুঃখের কথা শুনতে শুনতে আমিও তাদের মতো কথা বলি। কখনো শুদ্ধ, কখনো অশুদ্ধ। এই পাতিল তো আর কম জায়গায় ঘোরে নাই!

শায়লা বিরক্ত হয়ে বলল, পাতিল থেকে বের হয়ে গেলেই পারতে! সারাক্ষণ পাতিলের ভেতরে বসে থেকে তোমার দম বন্ধ হয়ে আসত না? বিরক্ত লাগত না? কাজ নেই। শুধু বসে থাকা!

জিনি বিজ্ঞের মতো বলল, বিরক্ত লাগব ক্যান? আমি কি পাতিলের ভেতর এমনি এমনি বইসা ছিলাম? এখনকার জমানায় কেউ বইসা থাকে? সবাই তো ফেসবুক চালায়। আর আমি হইলাম আমাদের ভূত রাজ্যের অ্যাডমিন। গ্রুপের কত কাজ করতে হয়! কত কত পোস্ট অ্যাপ্রুভ করতে হয়!

শায়লার চোখ কপালে! কী বলছ যা–তা? চাপা মারার আর জায়গা পাওনা! যত্তসব। দৈত্য চালায় ফেসবুক!

খালাম্মা আপনি কিন্তু আমারে ইনসাল্ট করতাছেন!

উহ্ যাও তো জিনি। আর কথা বাড়িয়ো না। আমি যেহেতু তোমার মনিব, তুমি আমার সব কাজ করতে বাধ্য। হাঁড়ি–পাতিল ধুয়ে বাসাটা পরিষ্কার করো। আর শোনো, এগুলো আমার তিনটা ইচ্ছার মধ্যে পড়ে না। আমার ইচ্ছাগুলোর কথা পরে তোমাকে সময় করে বলব।

বেডরুমে বসে শায়লা ভাবছে, সত্যি কি জিনি দৈত্য? বিশ্বাস হচ্ছে না। আজকে অনেক দিন পর নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে শায়লার। হাতের কাজগুলো কেউ একজন করে দিচ্ছে। জিনিকে বললে বাজারেও যেতে হবে না। আজ অনেক দিন পর শায়লা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় ধরে নিজেকে দেখল। নিজেকে এখন আর যত্ন করে দেখা হয় না। ফরিদ শেষ কবে শায়লাকে দেখেছে, শায়লার মনে পড়ে না। এখন আর এসব বিষয় নিয়ে মন খারাপ হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। তবু আজ সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে। শায়লা অনেকটা সময় নিয়ে সাজল। ঠিক আগের মতো! কপালে টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। একটা সময় ছিল শায়লা কপালে টিপ না পরলে ফরিদ ভীষণ রাগ করত। এখন আর এসব ব্যাপার খেয়ালই করে না! সুন্দর আর সুখময় স্মৃতিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়!

হারমোনিয়ামটায় ধুলো জমে আছে। কত দিন যে এই হারমোনিয়ামটা শায়লার আঙুলের স্পর্শ পায় না। কত দিন সাত সুরে বাঁধে না। অথচ শায়লার মিষ্টি কণ্ঠে বিমোহিত হয়নি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। দীর্ঘদিন না গাইতে গাইতে এখন কেন জানি শায়লার কণ্ঠে সুর আসতে চায় না। দম কোথায় যেন ফুরিয়ে যায়। অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। পুরোনো স্মৃতির ধুলোমাখা হারমোনিয়ামটা মুছে শায়লা আবারও স্পর্শ করল অভিমানী বাদ্যযন্ত্রটিতে। কিন্তু সুর কেন ছলনা করছে? কণ্ঠও সায় দেয় না। এমন কোনো হচ্ছে? সংসারের জটিল অঙ্কের হিসাব কষতে কষতে সব স্বরলিপিই ভুলে গেছে শায়লা। মনটা কেমন উদাসী মেঘের মতো বিষণ্ন হয়ে গেল।

খালাম্মা! বিকট শব্দ তুলে জিনি এসে দাঁড়াল সামনে। আমার সব কাজ শেষ! এবার আপনার তিনটা ইচ্ছে আমায় আদেশ করুন!

শায়লা আলতো হাতে হারমোনিয়ামটা ছুঁয়ে বলল, জিনি আমি আবার আগের মতো গাইতে চাই। সবার মাঝে আমার গানের সুর ছড়িয়ে দিতে চাই। আবারও মঞ্চে উঠতে চাই।

জিনি বিজ্ঞের মতো বলে উঠল, তার মানে আপনি গান শিখতে চান? ঠিক আছে আমি শিখিয়ে দেব। শুরু করেন সা–আ–আ–আ।

জিনির কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠে শায়লা বলল, তুমি আমাকে গান শেখাবে? ওই হেঁড়ে গলায়? তাহলেই হয়েছে। আমাকে শেখাতে হবে না। আমি গাইতে জানি কিন্তু কী জানি কী হলো কণ্ঠে আমার সুর আসছে না।

জিনি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, বুঝছি। আপনে ওই জিনিসটা হারায়ে ফেলছেন খালাম্মা।

কোন জিনিস হারিয়েছি?

ওই যে যেইডা হারাইলে মানুষ কিছু করনের সাহস পায় না।

কোনটা হারালে? আর জিনি তুমি তো শুদ্ধ করে কথা বলতে জানো, তাহলে কেন আবার এভাবে বলা শুরু করলে।

সরি খালাম্মা। এখন থেকে শুদ্ধ, সুন্দর, প্রমিত ভাষায় কথা বলব। আসলে যখন যেই পরিবেশে থাকি, যে ভাষার মানুষের সঙ্গে থাকি সে ভাষাই ধারণ করি। যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন তো অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতাম।

শায়লা খেপে গিয়ে বলল, তুমি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলে? চাপা মারার জায়গা পাও না?

না খালাম্মা, চাপা না, সত্য!

দেখো এমনিতেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। গাইতে পারছি না, তার ওপর তুমি আজগুবি কথা নিয়ে এসেছ! তুমি আমার গানের জন্য কিছু করো! আমি আবারও গাইতে চাই। মঞ্চে উঠে গানের সুরে সবার মন মাতাতে চাই, ঠিক আগের মতো!

জিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর চোখ বন্ধ করে বলল, হিং টিং ছট! খালাম্মা আপনি মনে মনে বলেন আমি পারব। অবশ্যই পারব। দেখবেন আপনি গাইতে পারছেন। আপনার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে গেছে।

ঠিক আছে তুমি যাও। অন্য কাজ করো।

জিনি চলে যাওয়ার পর শায়লা দুচোখ বন্ধ করে কিছুটা সময় হারমোনিয়াম ছুঁয়ে বসে থাকল। তারপর প্রিয় গানটা গাইতে চেষ্টা করল। অবিশ্বাস্যভাবে লক্ষ করল, ঠিক যেন আগের মতো গানেরা স্বরলিপির হাত ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে। কী মধুর সেই সুর! নিজের কাছেই ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আত্মবিশ্বাসটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি।

শায়লার কণ্ঠে বাজছে, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে...!’

জিনি দৌড়ে এল। আহা কী সুন্দর কণ্ঠ! বলেছিলাম না আপনি পারবেন।

শায়লার মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। জিনি এবার আবার প্রশ্ন করল।

আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছেটা বলেন। প্রথম ইচ্ছা তো পূরণ হলো।

শায়লা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, আমার একটা অনলাইন বিজনেস করার ইচ্ছা। নিজের হাতে তৈরি পোশাক অনলাইনের মাধ্যমে সবার হাতে পৌঁছে দিতে চাই। কিন্তু তোমার খালু কিছুতেই রাজি না। সব কাজেই বাধা দেওয়া তার অভ্যাস। সে বলে লাইভে এসে নারীরা কাপড় বিক্রি করে। এ দৃশ্য তার পছন্দ না! একটা বুটিক শপ দিতে চাইলাম, সেটাও নিষেধ! আমি স্বাবলম্বী হতে চাই। যুগটা এখন আগের মতো নেই। নারীরা এখন সব ক্ষেত্রে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। ঘরে আমার সময় কাটে না। আমি খুব সুন্দর পোশাক তৈরি করতে পারি। তুমি যেহেতু আছ, তুমি ঘরের কাজে সাহায্য করবে আর আমি গানের পাশাপাশি অনলাইন বিজনেসটা চালু করব।

জো হুকুম জনাবে আলা। আপনার এই ইচ্ছাও পূরণ হবে!

শায়লা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, কীভাবে? ওকে তো কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না!

জিনি বলল, হিং টিং ছট! খালু এখন অফিসে একটা বড়সড় বাঁশ খাবেন এবং আপনাকে ফোন দেবেন।

কী বলছ? সত্যি?

জিনি কিছু না বলেই রুম থেকে চলে গেল। দুই মিনিটের মাথায় ফরিদ ফোন করল।

: শায়লা শুনছ?

: হুমম বলো। আজ সূর্য কোথায় উঠল? লাঞ্চ আওয়ারে ফোন দিলে?

: কেন আমি কি কখনো লাঞ্চ আওয়ারে ফোন দিইনি?

: হুমম দিয়েছ। কোনো এক হলুদ স্মৃতিতে মোড়া সোনালি অতীতে। এখন আর আমাকে অফিসে গেলে স্মরণ করো না!

ফরিদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বেশ উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, জানো আজ অফিসে ফয়সাল সাহেবের নিজের বউ নিয়ে সে কী গর্ব! তার বউ এই করে সেই করে। গুণের নাকি অভাব নেই। পুরুষ মানুষ বাইরের মানুষের কাছে স্ত্রীকে নিয়ে এত প্রশংসা করে? আর দেখো, কত বড় স্ত্রৈণ। সে নাকি বাসায় স্ত্রীর সব কাজে সাহায্য করে। কখনো কখনো ছুটির দিনও রান্না করে। পুরুষ মানুষ রান্না করে! ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই তার। এরা আসলে বউয়ের আঁচলের তলায় থাকতে থাকতে নিজেকেই দাস বানিয়ে ফেলেছে।

শায়লা গম্ভীরভাবে কথাগুলো শুনল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, স্ত্রীর প্রশংসা করলে, তার কাজে সাহায্য করলে কেউ ছোট হয় না। স্ত্রৈণও হয় না। ফয়সাল সাহেব অনেক বড় মনের মানুষ। তিনি স্ত্রীর সহযোগী।

ফরিদ সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, ও তুমিও ফয়সালের জন্য সাফাই গাচ্ছ?

: তুমি কি আমাকে ফয়সাল সাহেবের বদনাম করার জন্য ফোন করেছ?

: না, বদনাম করার জন্য ফোন করিনি। ফয়সাল তো ধূর্ত শেয়াল। সে বসের সামনে তার বউয়ের হাজারটা প্রশংসা করেছে। স্যার তো খুশিতে গদগদ। এবার বোধ হয় ওর প্রমোশনটা হয়েই যাবে। তুমি না অনলাইন বিজনেস করতে চেয়েছিলে? শুরু করে দাও। তুমি কত সুন্দর পোশাক তৈরি করতে পারো। এবার অনলাইনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে। আমাদের বসের বউ আর ফয়সালের বউকে অ্যাড করে নিয়ো। তারাও জানুক, আমি সুনাম না করলেও আমার বউও কম গুণের না!

শায়লা বুকের মধ্যে চাপা একটা কষ্ট নিয়ে বলল, স্ত্রীর প্রশংসা করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না বরং স্ত্রী অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও দ্বিগুণ হয়। তুমি সেটা বোঝো না ফরিদ! যা–ই হোক, আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছেটা পূরণ করার জন্য ধন্যবাদ।

: হুমম, তো ঠিক আছে শায়লা, এখন রাখি!

: ফরিদ আরেকটা কথা।

: কী কথা আবার?

: জানো আজ অনেক দিন পর গাইলাম! কী যে ভালো লাগছিল। আমি আবারও আগের মতো গাইতে চাই। প্রোগ্রাম করতে চাই। তুমি আমার এই স্বপ্নটা পূরণ করবে, প্লিজ?

ফরিদ সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে করো। ফয়সাল আর আমার বসও জানুক আমার ঘরেও রত্ন আছে!

ফরিদ সাহেব ফোন রেখে দেওয়ার পর শায়লা খুশিতে আত্মহারা হয়ে জিনিকে ডাকল।

জিনি তুমি আসলেই আলাদিনের দৈত্য। আমার দুটো ইচ্ছা কী অদ্ভুতভাবে পূরণ হয়ে গেল!

খালাম্মা আমি আলাদিনের দৈত্য হব কেন? আমি আপনার দৈত্য। আপনার আর একটা ইচ্ছা পূরণ হওয়ার বাকি আছে। বলে ফেলেন।

জিনির প্রতি এখন ভরসা দ্বিগুণ বেড়েছে। শায়লা ধীরে ধীরে ওয়ার্ডরোবের কাছে গেল। একটা ড্রয়ার খুলে ছোট অনেকগুলো জামা বের করল। সেই জামাগুলো বুকের ভেতর চেপে ধরে অঝোরে কেঁদে উঠল।

জানো জিনি, গেল বারো বছর ধরে আমি এই জামাগুলো বানাচ্ছি কিন্তু কাউকে পরাতে পারছি না। জিনি আমি মা হতে চাই। আমার ছোট্ট সোনাকে এই জামাগুলো পরাতে চাই।

এই প্রথম জিনির চোখে জল এল। শায়লার খুব কাছে এসে বলল, জামাগুলো আর ওয়ার্ডরোবে পড়ে থাকবে না। খুব শিগগির রঙিন এই জামাগুলো পরার জন্য ছোট্ট এক পরির আগমন ঘটবে এ ঘরে। ফরিদ–শায়লা দম্পতির জীবনে আর কোনো অশান্তি থাকবে না। প্রতিটি দিন হবে ফুলের মতো সুন্দর। বলেই জিনি কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।

শায়লা কিছু সময়ের জন্য যেন হারিয়ে গেল কল্পনার জগতে! ছোট্ট একটা ফুটফুটে পরি যেন সারা ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পরনে শায়লার বানানো লাল ফ্রকটি। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! শায়লার হঠাৎ জিনির কথা মনে পড়তেই বেডরুম থেকে বের হয়ে জিনিকে খুঁজতে লাগল। জিনির কোনো সাড়াশব্দ নেই। শায়লা জিনিকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে চলে গেল। পুরোটা রান্নাঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। শায়লা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তারপরও জিনিকে ডেকেই যাচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক পর।

শায়লা চোখ খোলো, শায়লা?

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ফরিদের কণ্ঠ শুনে শায়লা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ফরিদ মাথার কাছেই বসা। খুব আদুরে কণ্ঠে শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এখন কেমন লাগছে শায়লা? যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!

শায়লা কিছুই বুঝতে পারছে না। উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু ফরিদ সাহেব জোর করে শুইয়ে দিলেন। আদেশের সুরে বললেন, একদম উঠবে না। এখন থেকে সম্পূর্ণ রেস্ট!

শায়লা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মানে কী?

মানে আর তোমাকে বলতে হবে না। ভাগ্যিস আমার কাছে বাসার ডুপ্লিকেট চাবিটা ছিল। তা না হলে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেত!

দুর্ঘটনা? কিসের দুর্ঘটনা?

তুমি রান্নাঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা হওয়ার পর ড. মুনমুন আমাকে ফোনে যে খবরটা দিল তাতে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম এত বড় খুশির খবরটা তোমাকে সরাসরি বাসায় ফিরে দেব কিন্তু আমি আসার আগেই তুমি...ড. মুনমুন এসে তোমাকে দেখে গেছেন।

শায়লার মাথায় কিছুই কাজ করছে না। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম? ড. মুনমুন কখন এলেন?

আমি এসেই তোমার এমন অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিয়েছি। ভাগ্যিস, চেম্বারটা কাছে।


আর কিসের সুখবর ফরিদ?

ফরিদ সাহেব খুশিতে শায়লাকে জড়িয়ে ধরলেন।

: শায়লা দীর্ঘ বারো বছর প্রতীক্ষার পর আমরা বাবা–মা হচ্ছি। তোমার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। ভাবা যায়, আমাদের বিবর্ণ পৃথিবীটা রঙিন করতে কেউ একজন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে?

নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না শায়লার। এক সমুদ্র আনন্দাশ্রুতে ভিজিয়ে দিল ফরিদের তৃষ্ণার্ত বক্ষ। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে অজস্র ধন্যবাদ দিল।

জিনির কথা মনে আসতেই শায়লা চারপাশে তাকাল। জিনি কোথায়?

ফরিদ সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জিনি? সে আবার কে?

: জিনি, ওই যে পাতিলের দৈত্য। আমার তিনটা ইচ্ছা পূরণ করল!

ফরিদ সাহেবের চোখ কপালে। কী বলছ যা–তা? জ্ঞান হারিয়ে এতক্ষণ এসব দেখেছ তাই না? বাদ দাও তো। একটু শান্ত হও। তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।

: সারপ্রাইজ?

ফরিদ সাহেব উচ্চ স্বরে ডাক দিলেন, জরিনা?

শায়লা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, জরিনাটা আবার কে?

: বুয়া। তুমি অনেক দিন ধরেই একটা বুয়ার জন্য বলছিলে। অফিসের বশিরকে বলে রেখেছিলাম। আজ জরিনাকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিল। তোমার আর কোনো কাজ করতে হবে না, এ শরীর নিয়ে। তুমি শুধু বিশ্রাম করবে, গান করবে আর তোমার যদি ইচ্ছে হয় অনলাইন বিজনেসটা চালু রাখবে।

জরিনা এসে হাজির হলো।

জরিনাকে দেখে শায়লা চিৎকার করে উঠল, জিনি? এই তোমার আসার সময় হলো? তোমাকে ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে ফেলেছি। রান্নাঘরে গিয়ে অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে?

জরিনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ফরিদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা এগুলা কী কয় খালু? আমি জিনি হমু কেন? আমার নাম জরিনা। বাড়ি ভোলা।

: শায়লা তোমার কী হয়েছে বলো তো? কী সব বলছ?

শায়লা অবাক বিস্ময়ে জরিনার দিকে চেয়ে রইল। অবিকল জিনি। শুধু জিনির মতো বিশাল আকৃতির নয়। আজ সারা দিন যা ঘটল, তা কি অপার্থিব? শুধুই রহস্য? শায়লার কল্পনা? নাকি স্বপ্নভ্রম? জিনি বলে কেউ কি ছিল না? তাহলে অদৃশ্য আলাপনে এমনিই দিন কেটেছে শায়লার? জিনির যেখানে অস্তিত্ব নেই, সেখানে ফরিদকে কী বলে বিশ্বাস করাবে? এর চেয়ে নিশ্চুপ থাকাই ভালো।

ফরিদ সাহেব শায়লার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন, শায়লা একটু বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ফরিদ সাহেব জরিনাকে বললেন, তুমি শায়লাকে দেখে রাখবে। ওর যত্ন করবে। ঠিক আছে?

ফরিদ সাহেব চলে যাওয়ার পর শায়লা জরিনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

জরিনা খিলখিল করে হেসে উঠল।

খালাম্মা আপনার জন্য এক গ্লাস গরম দুধ নিয়া আসতেছি। যাওয়ার সময় শায়লার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে রহস্যের এক হাসির রেখা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
–––

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।