ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: কমলা রোদের মাল্টা-১

মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা
মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা

চারদিক রুক্ষ। মরুভূমি মরুভূমি চেহারা। ক্যাকটাস গাছগুলো দেখিয়ে আদিবা বলেই ফেলল, ‘মনে হচ্ছে যেন সৌদি আরব চলে এসেছি।’ শুনে খিক্ করে হেসে ফেললাম। টাইলসের দোকান, বিউটি পারলার আর ইংরেজি শেখার কোচিং সেন্টারগুলোর গা ঘেঁষে প্যাঁচ খেয়ে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তার দেখিয়ে বললাম, ‘আমার তো মনে হচ্ছে পুরাই ঢাকা। ফিলিং হোমলি।’ বাকিরাও স্বীকার করে নিল, কথা মিছে নয়।

বাকিরা বলতে আদিবার মেয়ের বাপ আকরাম আর আমার ছেলের বাবা রুমি। যাদের গাঁটের পয়সার বদৌলতে এই নতুন দেশে ঘুরতে আসা। এরা এবার বেশ ঝামেলা দিচ্ছে। তাদের দাবি, আদিবা আর আমি দুজনই যেহেতু টুকটাক চাকরি করি, তাই আমাদেরও এ যাত্রায় হাত খুলে খরচ করতে হবে।

আমরা অবশ্য উল্টো বুঝিয়ে দিয়েছি, বিবি-বাচ্চা নিয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরতে যাওয়া পরহেজগার মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। তাতে পয়সাপাতি নামক তেজপাতা যত বেরিয়ে যাবে, ইমান তত পোক্ত হবে।

কড়া এক ডোজ সবক দেওয়ার পর থেকে বাবারা কেমন ঝিম মেরে চুপ হয়ে গেছে। তবে ঝিম ধরার আগে ছানা দুটির কাঁধে তাদের মায়েদের জ্বালানোর দায়িত্ব সুচারুভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছুগুলোর কেউ ছুটে চলা মাইক্রোবাসটার জানালা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটছে। কেউবা মিহি সুরে খুন খুন করে এই ভ্রমণের আগাম মুণ্ডুপাত করছে।

মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা
মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা

এদিকে ধুলাবালুর বহর দেখে আমরা কিছুটা হতাশ। এই কিনা অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপদেশ মাল্টা! দেশটা প্রায় দেড় শ বছর ব্রিটিশ কলোনিও ছিল। অত দিনের ভাঙা কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কী সোজা কথা। এই ভেবে যখন সান্ত্বনা খুঁজছি, তখন নীল রঙের কিসের এক ঝলক চোখে ঝাপটা মেরে গেল।

গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তায় বাঁক নিতেই ভূমধ্যসাগর নামের নীল ময়ূর পেখম মেলে দেখা দিল। চোখ ঝলসে গেলেও ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তবে বাবাদের হাসিটা অন্য রকম। ইসকো ক্যাহেতে হ্যায় ‘প্যায়সা উসুল’ মুসকান। তাদের পয়সাটা ঠিকঠাক জলে গিয়েছে। এক্কেবারে সাগর জলে। স্রষ্টা নিজের হাতে এই দেশের চারপাশে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বালতি দিয়ে এমন মহার্ঘ্য ঢেলে দিয়েছেন যে, হাজার লুটেরা মিলে লুটে নিলেও ফুরাবে না।

মিউনিখ থেকে মাল্টা মাত্র দুই ঘণ্টার আকাশপথ। কিন্তু তাতেই ঘরের দরজা থেকে হোটেলের দরজা অবধি আসতে ঘড়ির কাঁটা সকাল আটটা থেকে ঘুরে বিকেল চারটায় এসে থেমেছে।

হোটেল বললে ভুল হবে, রিসোর্ট আর কী। লবিতে দাঁড়িয়ে ঝিঁঝি ধরে যাওয়া পা টান করছি। হঠাৎ পড়ন্ত বিকেলের এক ফালি কমলা রোদ আমাদের চটজলদি অভ্যর্থনা জানিয়ে কই যেন ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেল। আমরাও ‘বাচ্চাদের খিদে পেয়েছে’—এই অজুহাতে চেকইনের লাইনে দাঁড়ানো তাদের বাবাদের হাতে পাসপোর্ট গুঁজে দিয়ে ছানা বগলে নিয়ে ভেতরের রেস্তোরাঁ বরাবর পালিয়ে বাঁচলাম।

রিসোর্ট থেকে মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা
রিসোর্ট থেকে মাল্টার একটি দৃশ্য। ছবি : আদিবা

ধাতস্থ হয়ে একটু ঘুরে দেখলাম চারপাশটা। রেস্তোরাঁই তো দেখি সাত-আটটা। বুঝে নিলাম, সাগরপাড় ঘেঁষে শহর থেকে অনেক দূরে এই অট্টালিকা বানানোর উদ্দেশ্যটা ভীষণ দুষ্টু। লোকে বেড়াতে এসে যেন এখানেই আটকে পড়ে থাকে। সে জন্য জায়গায় জায়গায় টোপ ফেলা আছে। সার্ফিং থেকে শুরু করে প্যারা সেইলিংয়ের সব সরঞ্জাম সাগরতীর ঘেঁষে সাজিয়ে রাখা আছে।

এত গেল রোমাঞ্চপ্রিয় লোকজনকে আটকানোর ব্যবস্থা। রোমাঞ্চের নিকুচি করা লোকদের জন্য আছে আরেক আয়োজন। সামান্য তফাতেই সারি সারি রোদ চেয়ার। অলস, কুমির প্রকৃতি লোকেরা যেন তাতে গা ডুবিয়ে শুয়ে-বসে মোহিতো কী মার্গারিটা টেনে আর ভাব দেখিয়ে হারুকি মুরাকামি কী পাওলো কোয়েলহো উল্টে বেলার পর বেলা কাটিয়ে দেয়।

বোঝা গেল এই প্রমোদ ভবন আসলে একটা হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া। একবার ঢুকেছ তো মরেছ। ‘You can check out any time you like, But you can never leave!’ ভাবতেই এখান থেকে যেকোনো প্রকারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মনটা আইঢাই করছে।

কিন্তু সে রাতে আর বেরোনো গেল কই। গলা পর্যন্ত বুফে ডিনারের ব্যাপক সৎকার করে একে একে সবাই পেতে রাখা রোদ চেয়ারগুলোতে গা এলিয়ে দিলাম। রোদের বদলে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো গায়ে এসে পড়ছে। পাশেই কতগুলো বিড়াল সাবধানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের কানে ছোট-বড় ফুটো। ফুটোগুলো নম্বরের কাজ করে। তার মানে এগুলো হোটেলের পোষা বিড়াল। আপাতত এদের সঙ্গে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির সব সদস্য একই রকম ভঙ্গিতে পেট ভাসিয়ে শুয়ে আছি। বিড়াল-জীবনই সত্য জীবন।

পরদিন পিট পিট করে চোখ মেলতেই দেখি পামগাছটা মাথা নুইয়ে বারান্দা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। কাছেই ঢেউয়ের শব্দ। মাল্টায় বালুর সৈকত তেমন চোখে পড়েনি। সাগরের কোল ঘেঁষে পাথুরে খাড়া পাড়। একটু এগোতেই সে চেহারা বদলে রূপ নেয় খাড়া পাহাড়ে। অদ্ভুত রুক্ষ, রুদ্র সৌন্দর্য। আছড়ে পড়া ঢেউগুলো তাতে শুধু প্রশ্রয়ই পায়, আশ্রয় আর জোটে না।

শহরের একটি সড়ক। ছবি : আদিবা
শহরের একটি সড়ক। ছবি : আদিবা

আজকের ঘোরাঘুরির ফন্দি গত রাতে আঁটা হয়ে গেছে। আজকে হবে জার্নি বাই বাস। বাস এসে রিসোর্ট থেকে তুলে নিয়ে যাবে। এগুলোকে বলে হপ অন-হপ অফ বাস। এই নাম বার কয়েক আমাদের মুখে মুখে ঘুরে শেষমেশ হিপহপে এসে ঠেকল। সময়মতো মধ্যবিত্ত চেহারার এক দোতলা বাস চলে এল। তার এখানে ওখানে রং চটে চটক উবে গেছে। কিন্তু আমাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। হই হই করে আমরা হিপহপ বাসে চাপলাম। আদিবা-আকরামরা ছোট্ট আমালিয়াকে নিয়ে নিচে বসল। আর আমাদের তাফসু মিয়ার চিল চিৎকারের দাপটে ছাদ খোলা দোতলায় কড়া রোদের মাঝে বসলাম আচারের বয়াম হয়ে।

মজার ব্যাপার, প্রায় আধা দিন হয়ে গেল, কিন্তু কোনো স্থানীয় লোকের দেখা পেলাম না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা গেল, সে এসেছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপালের মতো দেশ থেকে অথবা ইউরোপের অন্য দেশ থেকে। গত রাতে তো এক বাংলা বলা আসামের লোকও পেয়েছি। হোটেলের বাবুর্চি। খুব যত্ন করে মেক্সিকান টাকো বানিয়ে দিল। আবার চমৎকার উচ্চারণে বলল, ‘আরেকটা বানিয়ে দিই?’ হেসে আপত্তি জানিয়ে জানতে চাইলাম, ‘মাল্টার লোকজন সব গেল কই?’

বাবুর্চি উত্তর না দিয়ে রহস্য করে বলল, ‘সবাই ইম্পোর্টেড’। পরে অবশ্য আরেকজনকে একই কথা পাড়তে জবাব দিয়েছে, ‘আছে তো মাল্টার লোক। ইয়া মোটা আর এই বেঁটে দেখতে। তবে ইউরোপিয়ানদের মতো সাদা। দেখবে তুমি? কালকে আমার মাল্টিজ কলিগকে নিয়ে আসব নে তোমার নাশতার টেবিলে।’ সকালে অতি দ্রুততার সঙ্গে নাশতা করে পালিয়েছি। নইলে খাস মাল্টিজ এনে আমাকে বলা হতো, ‘কী বলেছিলাম না ফরসা, মোটু আর বাঁটকু? এবার তোমার সাধ মিটেছে?’ সেই মাল্টিজের চেহারাই-বা কী হতো তখন, আমিই–বা কই লুকাতাম?

বিমান থেকে মাল্টা। ছবি : আদিবা
বিমান থেকে মাল্টা। ছবি : আদিবা

বাস ঢিমেতালে না চলে শাঁ শাঁ করে বাতাস কেটে চলছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় আর তার পাশে ছাত্রদের হোস্টেল চোখে পড়ল। লাল ইটের দেখে মনে হচ্ছে যেন কার্জন হলের ফজলুল হক হল। তারপর তাজ্জব বনে গিয়ে দেখলাম, লুঙ্গির মতো কী একটা ঘাড়ে ফেলে কোমরে তোয়ালে প্যাঁচানো কেউ একজন পাট করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ব্যাপক উৎসাহে হাত নাড়ছে। পর্যটন দেশ মাল্টার পর্যটনশিল্পের সেও এক অংশীদার। হাত নেড়ে অতিথি বরণ তার কর্তব্যের ভেতর পড়ে। হোক না সেটা গোসল শেষের আদুল গায়ে।

নানান জায়গায় বাস থামতে শুরু করেছে। সঙ্গের ছোট শিশুদের কারণে দৌড়ঝাঁপ করে সবকিছু এক বসায় দেখে ফেলা অসম্ভব। ঠিক হলো, স্লিমা যাব। নামটা আরবি ‘সালাম’ থেকে এসেছে। সেখান থেকে হবে জার্নি বাই বোট। ঘণ্টাখানেকের নৌবিহার। এও মন্দ কী? আসন থেকে উঠে এসে চালক বাস চাপড়ে কড়া ব্রিটিশ উচ্চারণে হাঁক ছাড়ল, ‘স্লিমা এসে গেছি। কে নামবে নামো।’ এই লোকের চোস্ত ইংরেজির অত্যাচারে কানের বারোটা বেজেছে এতক্ষণ। বেচারা যেচে পড়ে শহরের বিবরণ দিচ্ছিল। এর বদলে সে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দিলে চোখ বুজে জিওফ্রে বয়কটদের ভাত মেরে দিত। যা হোক, নেমে পড়ে বাঁচলাম। (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।