অ-বিবাহ

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাংলাদেশে থাকতে চাকরিজীবনে ছোটবড় সবার এক মহাবিরক্তিকর প্রশ্নের সামনে পড়তাম প্রায়ই—‘আপনি বিবাহিতা?’

প্রশ্নটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের। মনে মনে বলতাম, কেনরে ব্যাটা আমি বিয়ে করেছি কি করিনি তা দিয়ে তোর বাপের কী? তবে মুখের ওপর এভাবে বলাটা ঠিক ভদ্রসন্তানের পর্যায়ে পড়ে না বিধায় বাধ্য হয়ে মুখে কিছুটা হাসি টেনে উত্তর দিতাম, ‘না’।

প্রশ্নকর্তার চোখের বিদ্রূপ আমার নজরে পড়লেও উপেক্ষা করতাম সেটা। কিছু মানুষ তো আবার আরেক কাঠি সরেস—‘ছ্যাঁকা খেয়েছেন বুঝি?’

এবার কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি ঢেলেই বলতাম, ‘জি না। তবে কিছু লেজকাটা বাঁদরকে ছ্যাঁকা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাদের উদ্ভট অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিতে পারিনি বলে। তাই কোনো বাঁদরের বউ হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।’

এবার প্রশ্নে ছেদ পড়ত কিছুটা। কিছু অতি কৌতূহলী পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। এবার পুরুষ নয়। ক্লাসে খাতা দেখার ফাঁকে প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রীদের প্রশ্ন—‘আপনি মা হতে চান না?’

মধ্যপঞ্চাশের তিনজন ছাত্রী ছিল আমার। যাঁদের আন্টি বলে ডাকতাম। কোনো এক পরীক্ষা নেবার ফাঁকে তাঁদের একজনের আচমকা ফিসফিস, (যা আমার কাছে প্রায় সাপের হিসহিসের মতোই ছিল), ‘শারীরিক চাহিদাকেও কি অস্বীকার করবে, মা?’

আমাকে মা ডেকে খালাদের বয়সী কোনো নারী যে এ হেন প্রশ্ন করতে পারেন, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। মনে মনে বললাম, হে ধরণি, দ্বিধা হও! যাক সে কথা।

আমি পুরুষবিদ্বেষী নই মোটেও। আজও আমার পৃথিবীর অনেক বড় একটা অংশ জুড়ে থাকেন আব্বু। যার বয়স এখন প্রায় আশি। বড় ভাইদের একজন পরপারে চলে গেছেন। আরেকজন আছেন মাথার ওপর ছাতা হয়ে। খুব কাছের কিছু মানুষকে আমি বান্ধবী নয়, বন্ধু বা ছোট ভাই বলেই জানি। যাদের এক আপু ডাকেই যত রাগ গলে পানি হয়ে যায়।

তবে ওই বৈবাহিক সম্পর্কটা নিয়েই আমার যত আপত্তি। মূল্যবোধের প্রশ্নে ছাড় দিতে আমি রাজি নই মোটেও। আর বিয়ের পর ওই তেল নুন কড়াই, প্রতিদিন লড়াই? ও আমার দ্বারা একেবারেই হবে নারে ভাই। ভীষণ আদরে বড় হওয়া, বেশ স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবাদী মেয়ে আমি। লেজকাটা বাঁদরদের পছন্দ হওয়ার যোগ্য নই। বেশ কিছু শারীরিক সীমাবদ্ধতাও আছে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ সে জন্য। এ কারণে দ্বিমুখী চরিত্র বোঝাটা হয়তো সহজ হয়।

আর রইল বাকি মাতৃত্ব। কোনো শিশুকে ভালোবাসতে হলে, তাকে জন্ম দেওয়াটা কি খুবই জরুরি? আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, আমি শিশুদের কী পরিমাণ ভালোবাসি। তবে সে শিশুকে কি মানবশিশুই হতে হবে? ইচ্ছা আছে, ভবিষ্যতে অনেক কুকুর পোষার। অবলা জীব হয়তো ওই সব দ্বিমুখী নারী-পুরুষের মতো আমার বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হবে না। অতএব বিবাহ? চুলায় যাক, আমি অবিবাহিতাই বেশ আছি।