দেশ নিয়ে কিছু ভাবনা

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

গতবার দেশে গিয়ে প্লেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। প্লেনে দেখলাম বিদেশি অল্প বয়সী এক দম্পতি চার বাচ্চা নিয়ে উঠেছেন। ছোটটা কয়েক মাসের। মায়ের পরনে আড়ংয়ের কাপড়। সবাই হাসিখুশি। মায়াবতী পরিবার। প্লেনে সবচেয়ে শেষের সিট তাঁদের। আমাদের ঠিক পিছে।

প্লেন ছাড়ার আগে আগে ঝামেলা শুরু হলো। একদম পেছনের সিটে ছোট্ট বাচ্চা কোলে নিয়ে বসা যাবে না। আমি আমার ছেলের পাশ থেকে উঠে গিয়ে ভদ্রমহিলার পাশে বসলাম। আর তাঁর স্বামী ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বসলেন আমার ছেলের পাশে।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথায় কথায় জানলাম, তাঁরা ফ্লোরিডার। কয়েক বছরের জন্য বাংলাদেশ এসেছেন।

জিজ্ঞেস করলাম কেন? বললেন, ডাক্তার হিসেবে তাঁর স্বামীর কাজ। তিনি নার্স কিন্তু আপাতত বাচ্চাদের জন্য কাজ করছেন না।

কথায় কথায় তাঁকে জানালাম, তাঁর দেশের হাসপাতালে আমি কাজ করি। এত দেশ থাকতে বাংলাদেশে এসেছেন কেন?

জানালেন এরিকের (তাঁর স্বামী) বাবা কিডনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এরিককে নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন বহুবার। এ দেশে প্রথম পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (পেটে বিশুদ্ধ তরল ইনফেকশনবিহীন পদ্ধতিতে ঢুকিয়ে রক্ত পরিশোধনের পর প্রতিদিন ওই তরল ফেলে আবার একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি) তিনি শুরু করেছিলেন। আর এরিকের ডাক্তারি পড়ার যে বিশাল ব্যয়ভার, সেটাও পে ব্যাক করা হবে আর এ রকম স্বপ্নের দেশে কিছু সাহায্য করা হবে।

ভদ্রমহিলার কথা শুনে অনেকক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি শুকিয়ে ফেললাম। আমার অনেক কলিগ বহুবার জিজ্ঞেস করেছেন, তাঁরা কীভাবে আমার দেশে গিয়ে সার্ভিস দিতে পারেন। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারের মতো অনেক সংস্থার সঙ্গে তাঁরা জড়িত। প্রতিবছর কোথাও না কোথাও তাঁরা যান।

চিন্তা করলাম, আমারও তো খুব সাধ নিজের কিছু সময় দিয়ে দেশে কিছু রোগীর সেবা করার। কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে নিজের কাছের লোকজন আর প্রতিবেশী ছাড়া তেমন কোথাও সুযোগ আসেনি সেবা করার। এখানে বাংলাদেশের অনেককে দেখি কোনো না কোনোভাবে দেশের সেবা করছেন। গরিব ছাত্রদের পড়ানো, এতিমখানায় সাহায্য, চিকিৎসার জন্য ফান্ড রাইজিং, নিজের এক্সপার্টিজ শেয়ার করা ইত্যাদি।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ শাহ আলম আমাদের মেডিকেলের। পাস করেছেন আমরা মেডিকেলে পা দেওয়ার অনেক আগে। সৌদি আরবে ডাক্তার হিসেবে কাজ করতেন।

প্রথম আলোর খবরে জানলাম, পরিবারের মত উপেক্ষা করে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। গ্রামের অসুস্থ শিশুদের জন্য একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর। স্বপ্নের হাসপাতালও বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই গ্রামের অদূরে দুষ্কৃতকারীরা থামিয়ে দেয় তাঁর জীবনপ্রদীপ।

ডা. আলম দেশের মায়ায় সীতাকুণ্ড চলে এসেছিলেন প্র্যাকটিস করতে। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যাঁরা দেশে থাকতে চান বা বিদেশ থেকে ফিরে গিয়ে সেবা দিতে চান, তাঁদের বাইরে থেকে যাওয়ার অপশনই থাকে বেশি। কেন এত অকালপ্রয়াণ?

শুনেছি দেশে মানসিক সমস্যা বেড়ে চলেছে। আবরারের মৃত্যুর মতো আবারও ধাক্কা খেলাম বিবেকের কাছে। ভালো অনেককেই জীবনে লাগবে না। আমাকেও অনেকের মতো বিরক্তিকর মনে হবে। কিন্তু তাই বলে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিতে হবে?

যে ভালোবাসা নিয়ে এরিকের মতো বিদেশিরা বা ডা. আলমের মতো এ দেশে বড় হওয়া মানুষ দেশে ফিরে যেতে চাইছেন, সেটা তো আমাদেরই সৃষ্টি। মানুষের ভালোবাসার সৃষ্টি।

কাছের বান্ধবী ট্রিনা কয়েক বছর ধরে ঘ্যান ঘ্যান করছে, আমার সঙ্গে দেশে গিয়ে রোগীদের সেবা করবে। তাঁকে নিয়ে যেতে চাই ভয়হীনভাবে, দেশের আনাচকানাচে। আমরা এত কষ্ট পেতে চাই না।