শিশুশিকারি সন্ত ও ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে…

ফেনীর আদালত চত্বরে সিরাজ উদদৌলা। ২৮ এপ্রিল ২০১৯। ছবি: প্রথম আলো
ফেনীর আদালত চত্বরে সিরাজ উদদৌলা। ২৮ এপ্রিল ২০১৯। ছবি: প্রথম আলো

আবরার ফাহাদ, তনু-রুপা-নুসরাত—এরা সবাই পশুশক্তির হাতে অসহায় শিকার। নুসরাত বাংলাদেশের ফেনী এলাকার সোনাগাজীর মেয়ে। সে ওখানেই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে কুপ্রস্তাব দেন।

প্রস্তাব অনুযায়ী সিরাজের ইচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করলে নুসরাত পরীক্ষার প্রশ্ন আগেভাগেই পাবে বলে সিরাজ উদদৌলা প্রতিশ্রুতি দেন। পিয়ন দিয়ে নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে শুধু প্রস্তাব দেওয়া নয়, তার শরীর স্পর্শ করতেও দ্বিধা করেননি সিরাজ উদদৌলা।

নুসরাতের পরিবার থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করে। একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হন সিরাজ উদদৌলা। ক্ষিপ্ত উন্মত্ত সিরাজ উদদৌলা জেলখানায় বসেই তার নুন নিমক খাওয়া চেলা ও আত্মীয়-বান্ধবীদের দিয়ে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন বা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে ও প্ররোচনা দেয়।

যে আগুনে নুসরাতের শরীরের ৭৫ ভাগ দগ্ধ হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাঁর সুচিকিৎসা শুরু হলেও নুসরাতকে বাঁচানো যায়নি।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মানেই একজন ভালো মানুষ হওয়ার কথা নয় কি? সিরাজ তাদের অপমান করেছেন। ধিক ধিক সিরাজ উদদৌলা। তার বংশধরেরা কীভাবে পাপী সিরাজ উদদৌলার গ্লানির বোঝা থেকে বাঁচবেন?

সব ধর্মেই সিরাজ উদদৌলার মতো লোক আছে। তারা অতি চালাক ও ধুরন্ধর। তারা জানে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে অকাজ–কুকাজ করা বেশ সুবিধাজনক। ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানুষ সমীহ করে তাদের। মানুষজন সরলমনে এদের শ্রদ্ধাও করে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ব্যক্তিরা কোনো অন্যায় করতে পারে, এটা আমাদের মতো সাদাসিধা ও সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না।

মাদ্রাসা-মক্তবসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব নোংরা কাজ হতে পারে, এমনটা মানুষ ভাবতেও পারে না। সাহস নিয়ে নুসরাত যখন অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার কুকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, অভিযোগ করল, তখন ওই তাদের কুৎসিত চেহারা মানুষ দেখতে পেল।

সিরাজ উদদৌলা একজন লেবাসধারী ধুরন্ধর ছাড়া আর কিছুই নয়। ভুলে গেলে হবে না, সব ধর্মেই এমন লেবাসধারী আছে। একজন নয়, বহু বহুজন অমন মানুষ দেখেছেন এবং বলছেন, ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারকারী ওই সব লোকের সমাজে-সংসারে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। তখন মানুষের ভক্তি–শ্রদ্ধা মিশ্রিত সুনজরে থেকে এরা অবলীলায় কুকর্ম চালিয়ে যায়।

অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক বিশপ কার্ডিনাল জর্জ পেল তেমনি একজন লেবাসধারী ধুরন্ধর। ভ্যাটিকানের তিন নম্বর শক্তিধর ক্যাথলিক নেতা ও ট্রেজারার ছিলেন জর্জ পেল। তার ধর্মের লেবাসের সঙ্গে বিনয়ী আচার–আচরণের কারণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ধর্মযাজক।

জর্জ পেলকে অস্ট্রেলিয়ার একসময়ের প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। মানুষের চোখে তার চরিত্র ছিল এমনি নিষ্পাপ আর পবিত্র। তবে জর্জ পেল ছিলেন শিশুশিকারি। তার লালসা মিটিয়েছেন শিশুদের দিয়ে। সব শিশুই অসহায়। তাই শিশুরা ভীত বিনীত থাকত এই সব বকধার্মিক পাদরি-পুরোহিত-বিশপদের সামনে।

শিশুদের কথা কেই বা শুনতে চায়। আর শুনলেও বিশ্বাস কেউ করবে কী? জর্জ পেলের শিকার শিশুরা দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিল না। টিভি খবরে দেখা গেল, এক ডাক্তার নারী জর্জ পেলের হাতে নির্যাতিত তার বালক পুত্রের কাহিনি বলে কার্ডিনালের কঠোর সাজা দাবি করছিলেন।

তার কৃত অপরাধের জন্য মেলবোর্নের আদালতে ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৭৭ বছর বয়সের জর্জ পেল ছয় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।

অবাক কাণ্ড, ছবিতে দেখা যাচ্ছে সিরাজ উদদৌলা ও জর্জ পেল দুজনের কারও চেহারায় কোনো গ্লানিবোধ নেই।

জর্জ পেল। ছবি: রয়টার্স
জর্জ পেল। ছবি: রয়টার্স

এরপর যে ধুরন্ধরের কাহিনি জানলাম, সে হরিয়ানার এক আশ্রমের গুরু। মানুষ ভক্তিতে বিগলিত হয়ে তাকে প্রণাম করে মাথায় তুলে রাখে। সেই আশ্রমের কুমারী মেয়ে বৈশাখী কাউর, যার কথা কবিতায় বর্ণিত হয়েছে, ধর্মগুরু আশ্রমের শ্রদ্ধেয় বাবার ভালোবাসার মরণকামড়ে অসহ্য হয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

চিঠি লিখেছিল বৈশাখী কাউর। গোটা সমাজ আশ্রমের সাধ্বী কুমারীদের পূজা করে। বাবা, কাকা, ভাই—সবাই বৈশাখীর মতো কুমারীদের পূজা করে। বৈশাখী জানে সে কুমারী নয়, সে সাধ্বী নয়। প্রতি ২৪ দিন পর পর এক রাতে বাবার ঘরে ডাক পড়ে বৈশাখীর। কাকে বলবে, কাকে জানাবে বৈশাখী তার অপমান, তার কুমারীত্ব হরণের লাঞ্ছনার কাহিনি। কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। মাকে বলতে চেয়েছে। একবার নয়, দু–তিনবার করে। মা থামিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বাস করেননি।

এরপর মা বলেছিলেন, ‘মানিয়ে নে। যেভাবে শিউলিগাছ মানিয়ে নেয় শুঁয়োপোকার সঙ্গে।’*

মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়া—এ দুই কাজই হচ্ছে মেয়েদের প্রধান কর্তব্য।

যদি কোনো মেয়ে মানতে না চায়, তখন মানিয়ে নেওয়া হয় কোনো কোনো মেয়ের পক্ষে মৃত্যুর শামিল। যেমন হয়েছিল বৈশাখীর। তাই মৃত্যুই তাকে মুক্তি দিয়েছিল।

ধার্মিক ধুরন্ধরেরা সবচেয়ে অসহায় যারা, তাদের ছোবল দেওয়ার জন্য তক্কে তক্কে থাকে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েরা আর শিশুরা অসহায়, নিরুপায়।

সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রযন্ত্র—সবাই যার যার সুবিধামতো মুখ খোলে, পদক্ষেপ নেয়।

বৈশাখী কাউর বলে—

‘লোকটাকে যে আপনি বাঁচিয়ে রেখেছেন
আপনি তার ৫ কোটি ভক্তকে
চটাবেন না জানি
ওটা আপনার ভোট।
আপনারা ইভিএম মেশিন বানিয়েছেন
সেটা কে চালায়, গণতন্ত্র?
সেটা চালায় রিভলবার
সেটা চালায় আশ্রম
সেটা চালায় বাবা।’ *

*সুবোধ সরকারের কবিতার বই ‘বৈশাখী ও বব ডিলান’ থেকে উদ্ধৃত।