টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর

টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা
টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা

কানাডার টরন্টোয় শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার পঞ্চদশ আসর হয়ে গেল কালজয়ী সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে। মান্না দের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবারের আসরে আলোচিত হয় তাঁর সংগীতবিষয়ক আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন ‘জীবনের জলসাঘরে’।

১৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার এগলিন্টন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজিত এবারের আসরে আলোচনা করেন সংগীতশিক্ষক ও শিল্পী ইখতিয়ার ওমর। সঞ্চালনা ও সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করেন ফারহানা আজিম শিউলী।

শুরুতেই বইটির ওপর সামগ্রিকভাবে আলোকপাত করা হয়। ‘জীবনের জলসাঘরে’ বইটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। ৩৬৮ পাতার এই বইটির অনুলেখক গৌতম রায়। বইটি বের হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমোরিজ কাম অ্যালাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়।

মান্না দের ভাষ্যে বইটিতে আমরা পাই কৈশোর থেকে শুরু হয়ে একেবারে পরিণত বয়স পর্যন্ত তাঁর সংগীতজীবনের বর্ণনা। পারিবারিক সাংগীতিক আবহে, প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছোট কাকা সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে গানের হাতেখড়ি। কাকার অপত্য স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠা ও গান শেখা, মুম্বাইয়ে নিজেকে শিল্পী হিসেবে দাঁড় করানোর প্রাণান্ত সংগ্রাম। প্রবোধ চন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে ওঠা এবং একসময় মুম্বাই, কলকাতাসহ সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ে গান দিয়ে আসীন হওয়ার গল্প। বাংলা আধুনিক গানের জগতে কিংবদন্তিতুল্য সম্রাটের আসনে আসীন হওয়ার গল্প।

সর্বভারতীয় শিল্পী মান্না দে বাংলা, হিন্দিসহ গেয়েছেন তামিল, মালয়ালাম, গুজরাটি, মারাঠি, ভোজপুরি, অসমিয়া, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় নানা স্বাদের গান। রেকর্ডকৃত আছে তাঁর সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান। পেয়েছেন পদ্মশ্রী (১৯৭১), পদ্মবিভূষণ (২০০৫), দাদাসাহেব ফালকে (২০০৭) ও বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা।

সুদীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় মান্না দে তাঁর সংগীতসাধনাকে অব্যাহত রেখেছেন অপরিসীম নিষ্ঠায়। সময়টা অনেকটা দীর্ঘ। আর তাই তাঁর বইজুড়ে এসেছে অসংখ্য সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক, সংগীতশিল্পী, অ্যারেঞ্জার, যন্ত্রী, অভিনেতাসহ প্রাসঙ্গিক আরও মানুষের গল্প। এসেছে গানের পেছনের না বলা গল্প। এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত ও সংগীতজীবনের বড় আশ্রয় মা ও স্ত্রীর কথা। বিচ্ছিন্নভাবে তিনি এসবের কিছুটা কখনো-সখনো লিখেছেন বটে, কিন্তু ‘জীবনের জলসাঘরে’ই তাঁর পূর্ণাঙ্গ আত্মকথা। এখানে সংগীতজীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের অন্দরমহলও তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন নিঃসংকোচে।

অনুলেখনের কারণে লেখায় একটা বৈঠকি ভাব আছে। ফলে সব সময় বর্ণনায় স্থান-কাল-পাত্রের ধারাবাহিকতা সেভাবে রক্ষিত হয়নি। তবে সাবলীলভাবেই এসেছে শিল্পী মান্না দের সংগীতের দীর্ঘ জীবনের টুকরা টুকরা গল্প।

বইজুড়ে কিছুটা আত্মপ্রেমী শিল্পী মান্না দে ধরা দিলেও অর্ধশতাব্দী ধরে সংগীতজগতে নিজের প্রবল ছাপ রেখে যাওয়া, লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত শিল্পীর কিছুটা আত্মশ্লাঘা যথার্থই মনে হয়। পায়ের নিচে এক ফোঁটা মাটি খুঁজে পাওয়ার জন্য মুম্বাইয়ে বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, সময় সময় হতোদ্যম হয়ে পড়া, অপমানিত-বঞ্চিত মান্না দেও একই সঙ্গে ধরা দেন আমাদের কাছে।

বইয়ের শেষে পরিশিষ্টে আছে মান্না দের গাওয়া গানের একটি তালিকা। নানা ভাষায়, নানা স্বাদের ১২৩ পাতাজুড়ে বিস্তৃত এই কয়েক হাজার গানের এই তালিকা সাক্ষ্য দেয় তাঁর গানের সুবিশাল পরিসর, গানের ব্যাপ্তি। এতে শুধু আধুনিক বাংলা গানই আছে ৩২১টি, বাংলা চলচ্চিত্রের গান ৬০০টি ও হিন্দি চলচ্চিত্রের গান ১ হাজার ৪০০টি।

টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা
টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা

মূল আলোচনার শুরুতেই ইখতিয়ার ওমর তুলে ধরেন, সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের সংগীতজীবন ও মান্না দের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অপরিসীম ভূমিকার কথা। ইখতিয়ার বলেন, কে সি দে (মান্না দে ডাকতেন বাবু কাকা বলে) আসলে জন্মান্ধ ছিলেন না। তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান ১৩ বছর বয়সে। মা তাঁর মধ্যে সংগীতের সহজাত প্রতিভা দেখতে পেয়ে ওস্তাদ হরেন্দ্রনাথ শীলের কাছে নিয়ে যান। কে সি দে দবির খান, বাদল খানদের মতো অনেক বড় বড় ওস্তাদের কাছে তালিম নেন। ১৮ বছর বয়সেই তিনি অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে নাম করেন। গাইতেন খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার, ঠুমরি, কীর্তন, এমনকি হামদ, নাতও। তিনি বিচিত্র ধরনের গান শিখতে ও শুনতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রসংগীতও গাইতেন। আর এর প্রভাব পরবর্তী সময়ে মান্না দের ওপরও প্রবলভাবে পড়ে।

কে সি দে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের নামকরা অভিনেতাও ছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় গাওয়ার জন্য সেই ভাষা শেখার প্রতি তিনি গুরুত্ব দিতেন। যাতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অন্য ভাষায় গান উপস্থাপন করা যায়। তিনি ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসেন ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খান, রামপুর ঘরানার দবির খান, বাদল খান, আবদুল করিম খান, ফাইয়াজ খান, রাই চাঁদ বড়াল ও বেগম আখতারের। শচীন দেববর্মন কিছুকাল তাঁর কাছে গান শেখেন। তাঁরা মান্না দের বাড়িতে আসতেন। কাকা অন্ধ ছিলেন বলে বাড়িতেই তালিম নিতেন। আর কাকার সুবাদে এসব গুণীজনের সান্নিধ্যধন্য হন মান্না দে নিজেও।

কে সি দে বিশ্বাস করতেন, সংগীত অনুভব করে শেখার বিষয়। শিক্ষক কেবল ছাত্রকে সেই পথটুকু বাতলে দেবেন। এই কে সি দে স্বভাবজাত স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষণপদ্ধতির মধ্য দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলেন মান্না দে–কে। ওস্তাদেরা এলে তিনি মান্না দে-কে ডেকে বসিয়ে কখনো হারমোনিয়াম, কখনো তানপুরা ধরিয়ে দিতেন। এভাবেই এই দুই যন্ত্রে দক্ষ হয়ে ওঠেন মান্না দে। মান্না দের সঙ্গে তখন তাঁর অন্য ভাইয়েরাও কাকার কাছে শিখতেন। আসলে কাকা যখন ওস্তাদদের কাছে শিখতেন, তখন খাতা-পেনসিল নিয়ে কাউকে না কাউকে বসতে হতো নোট নিতে কিংবা কোনো রাগের বিষয়গুলো লিখতে। এসব করে করে খুব ছোটবেলা থেকেই মান্না দের গান শেখার পর্ব শুরু হয়ে যায়।

কৃষ্ণচন্দ্র দে বলতেন, সংগীতসাধনাই ঈশ্বর-সাধনা। মান্না দেও ব্যক্তিগত জীবনে একেবারেই ধর্ম-কর্মের ধারেকাছে ঘেঁষতেন না এবং তিনিও সারা জীবন সংগীতকেই ঈশ্বর জ্ঞান করেছেন।

এ পর্যায়ে কৃষ্ণচন্দ্র দের কণ্ঠে ১৯৪০ সালের রেকর্ডকৃত অত্যন্ত বিখ্যাত গান ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক তা মিছেই কল্পনা’র কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয়। গানটি পরবর্তী সময়ে মান্না দেও রেকর্ড করেন। কলকাতায় তাঁর গানের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবেও তিনি এই গানটি গেয়েছিলেন।

ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসা। ছাদের পাঁচিল টপকে অন্যের বাড়ির আচার চুরি করে খাওয়া শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত মান্না দের গল্প বলতে গিয়ে ইখতিয়ার বলেন, মান্না দে কুস্তি ভীষণ পছন্দ করতেন। স্বনামধন্য কুস্তিগির যতীন্দ্রচরণ গুহর (গোবর বাবু) কাছে কুস্তি শেখেন তিনি। আন্তকলেজ চ্যাম্পিয়নশিপে বিজয়ী হন ও অল বেঙ্গল রেসলিং প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অবতীর্ণ হন। কিন্তু স্কটিশ চার্চ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালে তাঁকে চশমা নিতে হয় ও চশমা পরে কুস্তি চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সংগীতশিল্পী হবেন, না কুস্তিগির—এই পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রথম প্রেম সংগীতকেই বেছে নেন। কুস্তিগির হতে গিয়ে প্রবোধ চন্দ্র দে হয়ে গেলেন সংগীতশিল্পী মান্না দে।

ইখতিয়ার বলেন, স্কটিশ চার্চ কলেজ ছিল মান্না দের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। কলেজের প্রিন্সিপাল আরকুহার্টের উৎসাহে তিনি আন্তকলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে অংশ নেন। তিনি ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, ঠুমরি ও আধুনিক গানের প্রতিটিতে প্রথম এবং পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৩৭ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে সব বিভাগে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ন হন।

উল্লেখ্য, এখানে পড়ার সময়ই মান্না দে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে নিজের সুরারোপিত কিছু বাংলা আধুনিক গানে এর সার্থক প্রয়োগ করেন।

এর মধ্যেই আসে মেজ কাকা হেমচন্দ্র দের ফরমান, মান্না দে-কে ওকালতি পড়তে হবে। কিছুতেই গানের শিল্পী হওয়া যাবে না। মান্না দের ভাইয়েরা কেউ ডাক্তারি, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন আর তিনি পড়ে আছেন দিনরাত গান নিয়ে। মেজ কাকা বলেন, গানে ডিসিপ্লিন নেই, অর্থকড়ি নেই, সে রকম সামাজিক সম্মানও নেই। কিন্তু মান্না দে গোঁ ধরে থাকেন। মায়ের নীরব সম্মতি ছিল এতে। আর বাবু কাকাই মেজ কাকাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মান্না দে-কে শেষমেশ উদ্ধার করেন। এ সময় মান্না দে বিদ্যাসাগর কলেজে বিএ পড়ছিলেন।

ইখতিয়ার ওমর বলেন, মান্না দে তখন বাবু কাকার সঙ্গে নিয়মিত নিউ থিয়েটার্সে যাওয়া-আসা করতেন। নিউ থিয়েটার্স তখন চাঁদের হাট। ওখানে তখন নিয়মিত আসতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাই চাঁদ বড়াল, তিমির বরণ ও ক্ষেমচাঁদ প্রকাশরা। কাকার সঙ্গে নিউ থিয়েটার্সে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। গানের টেকনিক্যাল বিষয়াদি হাতে-কলমে শেখেন। শেখেন যন্ত্রের যথাযথ ব্যবহার, শেখেন গানের শর্টহ্যান্ড নোটেশন ইত্যাদি। নিউ থিয়েটার্সে যেতে যেতেই একসময় কাকার সহকারী সংগীত পরিচালক (সেকেন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট) হন মান্না দে। প্রধান সহকারী সংগীত পরিচালক ছিলেন বিষ্ণু মিত্র। এখান থেকেই মান্না দের সুরকারের হাতেখড়ি হয়। তত দিনে তিনি রেডিওতে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিকাভুক্ত শিল্পী। মুম্বাই যাওয়ার আগের তিন-চার বছর কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত খেয়াল, ঠুমরি, লঘু সংগীত গেয়েছেন তিনি।

এরপর ইখতিয়ার বলেন মান্না দের জীবনের আরেক টার্নিং পয়েন্টের কথা। ১৯৪২ সাল। কলকাতায় জাপানি বোমার আক্রমণ। ভারত ছাড়ো আন্দোলন, উত্তাল কলকাতা ইত্যাদি মিলিয়ে গান-বাজনা ও ছায়াছবির কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সবাই তখন মুম্বাইগামী। সেই বছরেরই শেষ দিকে বাবু কাকার সঙ্গে মুম্বাই যান মান্না দে। কাকার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল অন্য ভাইয়ের, কিন্তু খুব আগ্রহ করে মান্না দে-ই সঙ্গে যান। ত্রিবেদীর আমন্ত্রণে, সিরকো প্রোডাকশনসের (পরবর্তী সময়ে কারদার স্টুডিও) ব্যানারে ‘তামান্না’ ছবির কাজে, নামকরা দলবলসহ কৃষ্ণচন্দ্র দে যান সংগীত পরিচালক হিসেবে।

আলোচক বলেন, মান্না দের হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক ১৯৪৩ সালে, কাকার সংগীত পরিচালনায় ‘তামান্না’ চলচ্চিত্রে। ‘জাগো আই ঊষা' গানটি সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈতভাবে গাওয়া। ‘তামান্না’র পরিচালক ছিলেন ফণী মজুমদার। ওই একই বছরে অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে শংকর রাও ব্যাসের সংগীত পরিচালনায় রামরাজ্য ছবিতে একক প্লেব্যাক করেন মান্না দে। গান ‘ভারত কী এক’। কাকার বদলে অবশ্য তিনি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা
টরন্টোয় সংগীতশিল্পী মান্না দে-কে নিয়ে পাঠশালার আসর। ছবি: পাঠশালা

এ সময়কালে কাকার পরামর্শে মুম্বাইয়ে তালিম নিতে থাকেন মান্না দে। কারণ, মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রজগতে তখন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কাকা তাঁকে বলেন আরও তৈরি হতে। মান্না দে প্রথমে শেখেন কিংবদন্তিতুল্য ওস্তাদ আমন আলী খাঁর কাছে (১৯৪৪)। শাস্ত্রীয় সংগীতের নানা দিকের সঙ্গে নুমও শেখেন তিনি কয়েক মাস ধরে। নুম হচ্ছে সুরের মধ্য দিয়ে স্বরবর্ণের সঠিক উচ্চারণ পদ্ধতি। এটি ঠিকঠাকমতো করতে পারলে গানের চেহারাই পাল্টে যায়। এরপর শেখেন পাতিয়ালা ঘরানার বিখ্যাত ওস্তাদ আবদুল রহমান খাঁর কাছে। আবদুল রহমান খাঁ তাঁকে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি অন্যান্য গান গাইতেও উৎসাহ দিতেন। তিনি আরও তালিম নেন ওস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খাঁর কাছে। গোলাম মুস্তাফা খাঁর কাছে শেখেন গানের সময় কণ্ঠস্বরের পরিধি বাড়ানোর পদ্ধতি।

আলোচনায় জানা যায়, ১৯৪৭ সালে কাকার অসুস্থতার জন্য তাঁকে নিয়ে কলকাতায় ফিরতে হয় মান্না দে-কে। পরিবার তাঁকে আর একা মুম্বাই যেতে অনুমতি দিতে চাইছিল না। এ সময় মায়ের দ্বারস্থ হন তিনি। চিত্র পরিচালক ফণী মজুমদারের ফোন পেয়ে সংগীত পরিচালক ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের সহকারী হয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে আবার পাড়ি জমান মুম্বাইতে।

প্রথমবার মুম্বাই আসার পর থেকে কাকার সহকারী হয়ে কাজ করার পাশাপাশি তালিম নেওয়াও চলছিল। পরে একটানা সাত বছর সংগীত পরিচালক হরিপ্রসন্ন দাস, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ, শ্যামসুন্দর, অনিল বিশ্বাস, শচীন দেববর্মনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে সহকারী সংগীত পরিচালক হয়ে কাজ করেন মান্না দে।

অল্প বাজেটের বেশ কয়েকটি ছবিতে সংগীত পরিচালনাও করেন মান্না দে। কিন্তু সেসব ছবি চলেনি। অনিশ্চিত এ সময়টায় গায়ক হয়ে সুযোগের জন্য, পায়ের নিচের মাটি পাওয়ার জন্য অক্লান্ত লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। এ সময় অনেক রকম অসম্মানজনক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হয় তাঁকে।

ইতিমধ্যে মান্না দে মুম্বাই রেডিওর লাইট ক্ল্যাসিক্যালের শিল্পী হয়ে তালিকাভুক্ত হন।

এ পর্যায়ে আলোচক প্রবোধ চন্দ্র দে থেকে মান্না দে হয়ে ওঠার গল্পটা বলেন। মান্না দের পোশাকি নাম প্রবোধ চন্দ্র দে। এই নামটা তাঁর মোটেও ভালো লাগত না। আর ডাকনাম ছিল মানা, মান্না না। মুম্বাইতে মানাকে অবাঙালি উচ্চারণে মান্না ডাকত সবাই। মান্না দে নিজেও চাইছিলেন প্রবোধ চন্দ্র থেকে মুক্তি। তাই মান্না দে নামটাই চালু হয়ে যায়।

ইখতিয়ার ওমর এ পর্যায়ে মান্না দে শাস্ত্রীয় সংগীতকার না হয়ে আধুনিক গানের দিকে চলে গেলেন কেন, সে ব্যাপারে আলোকপাত করেন। মান্না দে শাস্ত্রীয় সংগীতে দীর্ঘ বছর ধরে তালিম নিলেও তিনি আসলে শুরু থেকেই কখনো শাস্ত্রীয় সংগীতকার হতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে ভার্সাটাইল শিল্পী হতে, আধুনিক ও লঘু সংগীত গাইতে, গানকে ছড়িয়ে দিতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

কেরালার মেয়ে সুলোচনার কুমারনের সঙ্গে মান্না দের পরিচয়, প্রণয়, বিয়ে, সংসার, সংগীতজীবনে সুলোচনার প্রভাব ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচক বলেন, সুলোচনার সঙ্গে পরিচয় রবীন্দ্রসংগীতের সূত্র ধরেই। ১৯৪৮ সালের মে মাসে। মুম্বাইয়ের এক সাংস্কৃতিক আয়োজনে মান্না দে ও সুলোচনা দ্বৈতকণ্ঠে গান: ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে’। সেই পরিচয় গড়ায় প্রণয়ে, প্রণয় থেকে বিয়েতে। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে। এই বিয়েতে মান্না দের পরিবারের ঘোর আপত্তি ছিল। মাকে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে, পরিবারের বাকিদের অসম্মতিতেই সুলোচনাকে বিয়ে করেন মান্না দে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক সুলোচনা মান্না দের জীবনে অনিবার্য ভূমিকা পালন করেন। মান্না দের সংগীতজগতে উত্তরণের অন্যতম নিয়ামক ছিলেন সুলোচনা।

মান্না দে শচীন দেববর্মনের আক্ষরিক অর্থেই সহকারী ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন সব সময়৷ শচীন দেববর্মন ছিলেন খুব রসিক মানুষ। বইতে সে রকম কয়েকটি মজার স্মৃতিও আছে মান্না দের। শচীন দেববর্মন ও অন্যদের সহকারী হয়ে কাজ করলেও মান্না দের কাজ মূলত ছিল গানের নোটেশন করা, সুর তোলা ও শিল্পীকে তুলে দেওয়া। অনেক অভিমান ছিল তাঁর এটা নিয়ে। বিশেষ করে তাঁর শচীনদার ওপর। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এমনি গড়ায়। অবশেষে সাত বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শচীন দেববর্মনের সুরে ‘ওপর গগন বিশাল’ গানটি গাওয়ার মাধ্যমে একটা বড় ব্রেক পান। এই গান দিয়েই মান্না দের জয়যাত্রার সূচনা। শচীন দেববর্মনের কাছে মান্না দের সংগীতজীবনের ঋণ অসীম। শচীন দেববর্মনের সুরে, পরিচালনায় পরবর্তী সময়ে অনেক জনপ্রিয় প্লেব্যাক করেন মান্না দে। এর মধ্যে আহীর ভৈরব রাগে, মেরি সুরত তেরি আঁখে ফিল্মের ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে’ গানটির কিছু অংশের ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয় পাঠশালার শ্রোতাদের।


মান্না দের প্লেব্যাক ক্যারিয়ারে প্রবাদপ্রতিম সুরকার জুটি শংকর-জয়কিষাণের কথা বলেন ইখতিয়ার। এই জুটির সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই মান্না দে অন্য পরিচালকদের নজরে আসেন। তাঁদের হাত ধরেই মান্না দের শিল্পীসত্তার পুরোপুরি বিকাশ ঘটে। সে সময়টা ছিল মান্না দের স্বর্ণযুগ। এ পর্যায়ে শংকর-জয়কিষাণের সুরে ‘শ্রী ৪২০’ ফিল্মের অতি জনপ্রিয় গান ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’ গানটির ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। গানটি মান্না দে লতার সঙ্গে ডুয়েট করেছিলেন। উল্লেখ্য, লতার সঙ্গে মান্না দের ডুয়েট গানের সংখ্যা ১৭০টির মতো।

১৯৭১ সালে সুরকার শংকর-জয়কিষাণের সংগীত পরিচালনায় ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমায় রাজ কাপুরের লিপে ‘এ ভাই জারা দেখকে চলো’ গানটি গেয়ে মান্না দে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়কের জাতীয় পুরস্কার ও পদ্মশ্রী খেতাব পান।

শচীন, শংকর-জয়কিষাণ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন নামী সুরকার-সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেন মান্না দে। তাঁদের মধ্যে সলিল চৌধুরী, অনিল বিশ্বাস, নওশাদ, মদন-মোহন, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, রবীন্দ্র জৈন উল্লেখযোগ্য। কল্যাণজি-আনন্দজির ‘জঞ্জির’ ফিল্মের ‘ইয়ারি হ্যায়’ গানটি আগের সব রেকর্ড ভেঙেছিল। এসব সুরকার-সংগীত পরিচালকের পাশাপাশি মান্না দে উল্লেখ করেছেন গীতিকার মজরু সুলতানপুরী, শৈলেন্দ্রজি, শাহির লুধিয়ানভি, হসরত জয়পুরী, ভরত ব্যাসজির কথা।

আসরে উপস্থিতির একাংশ। ছবি: পাঠশালা
আসরে উপস্থিতির একাংশ। ছবি: পাঠশালা

ইখতিয়ার ওমর বলেন, সলিল চৌধুরী প্রসঙ্গ খুব গুরুত্বের সঙ্গে, উচ্ছ্বসিতভাবে এসেছেন বইটিতে। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে মান্না দের পরিচয় ১৯৫৩ সালে। সলিল চৌধুরী বোম্বে ইয়ুথ কয়ার তৈরি করলে মান্না দে সেখানেও যুক্ত হন। সলিলের সুরে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সিনেমায় গান গেয়েছেন মান্না দে।

আলোচক বলেন, ফিউশনের ব্যাপারে মান্না দের ছিল ঘোর আপত্তি। তিনি ফিউশনের নামে গানের আদি রূপ বদলে দেওয়ার মোটেও পক্ষপাতী ছিলেন না এবং এ ব্যাপারে অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করতেন। মান্না দের গান সাধারণের গান না। তিনি যে ধরনের গান গেয়েছেন, তাতে শাস্ত্রীয় সংগীতে চর্চিত কণ্ঠের প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় বড় রেঞ্জের, নমনীয় গলার। তাই তাঁর গান অসম্ভব লোকপ্রিয় হলেও ওই অর্থে তাঁর গান সাধারণের গান না।

১৯৫৩ সালে মান্না দের প্রথম বাংলা রেকর্ড বের হয়। তাঁর নিজের সুরে ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ এবং ‘হায় হায় গো’ গান দুটি লতার গাওয়ার কথা থাকলেও ঘটনাচক্রে তিনি নিজেই গেয়েছেন।

মান্না দের কলকাতার সংগীতজীবনে অসম্ভব প্রতিভাবান সংগীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তের প্রভাব প্রসঙ্গে ইখতিয়ার বলেন, ১৯৫৮ সালে মুম্বাইতে পরিচয় হয় সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে মান্না দের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের চিত্ররূপ ‘ডাক হরকরা’ সিনেমায়, সুধীন মান্না দে-কে দিয়ে প্লেব্যাক করান। গীতিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। চারটি গান করেন তিনি। এর মধ্যে শান্তি দেব ঘোষের লিপে ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ গানটি সর্বকালের সংবেদনশীল গানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।

আলোচনায় মান্না দে-কে যথেষ্ট আন্তরিকভাবে উপস্থাপন করেন আলোচক ইখতিয়ার ওমর। আর এই বিস্তৃত আলোচনা মাত্রিক হয়ে ওঠে পাঠশালায় আসা গ্রন্থ ও সংগীতপ্রেমীদের সাগ্রহ উপস্থিতিতে।