ভবিতব্য

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

আমি তখন ইডেন কলেজে পড়ি। বলাকা সিনেমা হলে একটা ইংলিশ ছবি এসেছে। সোফিয়া লোরেনের। দেখতেই হবে। মামাতো বোন মনিকে বললাম, চল ছবিটা দেখে আসি।

সে থাকে বড় বোনের সঙ্গে। তার অনুমতি ছাড়া কোথাও যেতে ভয় পায়। আর আমি হলাম মহাবাঁদর। সারা দিন টইটই করে ঘুরে বেড়াই বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ছেলেদের সঙ্গে মিশি। ভালো মেয়ের সংজ্ঞায় যা যা আছে তার কিছুই আমার মধ্যে নেই।

মনির বোনের চেয়ে দুলাভাই এক কাঠি ওপরে। তিনি ফ্রিতে অনেকগুলো শালা–শালি পেয়েছেন। তাদের ওপর ছড়ি চালাতে দারুণ ভালোবাসেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে মজা করলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে ছাড়া প্ল্যান তিনি ভেস্তে দিতে ওস্তাদ। তার ওপরে যদি শোনেন আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তাহলে অনুমতিই নাকচ হয়ে যাবে।

কিন্তু কী করে যেন মনি ম্যানেজ করে এল। দুজন যার যা কিছু আছে মানে টাকাপয়সা যা আছে নিয়ে রিকশায় বলাকা হলের উদ্দেশে রওনা হলাম। কী আনন্দ, বিদেশি মুভি দেখব। হাফ টাইমে তেল চটচটা আলুর চিপস খাব। তৈলাক্ত হাত সিটের মধ্যে মুছে ফেলব। কাচের বোতলের দুইটা কোক কিনব। খেয়ে ‘গাত’ করে ঢেকুর তুলব। আরও কত–কী।

কিন্তু একী! হলের সামনে পৌঁছে দেখি সেখানে প্রচুর ভিড়। তার ওপরে একটা বড় বোর্ডে লেখা ‘হাউস ফুল’।

রিকশা থেকে নেমে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম দুজন। মনির মন আমার থেকে বেশি খারাপ। বেচারা কত কষ্ট করে দুলাভাই–বড় আপার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এল। রোজ রোজ তো বাহানা করে বের হতে পারবে না। তা–ও আবার আমার সঙ্গে।

এমন সময় পাশে একজন ফিসফিস করে বলল, ‘আপা কয়ডা লাগব?’ মানে? ‘টিকেট কয়ডা লাগব আপা?’

প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে বুঝলাম এরা ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করছে। রাগ হয়ে গেল এদের জন্যই দেশটার এই অবস্থা! কিন্তু সিনেমাটা তো দেখা দরকার। আমিও গলা নামিয়ে বললাম ‘কত’?

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

কত দাম ছিল সে কথা মনে নেই। কিন্তু মনে আছে কোক আর আলুর চপের টাকা সব দিয়ে দুটো টিকিট কিনেছিলাম অনেক দর-কষাকষি করে। কোক পরে খাওয়া যাবে, আলুর চিপসও। কিন্তু এই মুভি চলে গেলে জীবন শেষ। দুজন টিকিট হাতে নিয়ে সে কী খুশি।

হাসি ধরে না মুখ নিয়ে হলে ঢুকতে যাব এমন সময় বজ্রপাত। সদর দরজার সামনে দাঁড়ানো মিয়াভাই। মানে মনির বড় ভাই। মামা কী যে করেছেন না। এতই বংশবৃদ্ধি যে যেখানে যাই সেখানেই দু-একটা পাওয়া যায়! এখানে স্বয়ং মামার প্রথম স্যাম্পল মানে আমার বড় মামাতো ভাই। আমাদের কিছুই বলেন না। কিন্তু আমরা তাঁকে বাঘের মতো ভয় পাই। তিনি আমাদের দেখতে পাননি। দেখলে কী করতেন, সেসব ভাবার সুযোগ না দিয়েই সোজা রিকশায় বাসায়। টিকিট কেটেও ছবি দেখা হয়নি আমাদের।

সেই থেকে সবকিছু নিয়েই আমার সংশয় থাকে। আমি বড় কিছু প্ল্যান করি না সহজে। করলেও জানি, এটা না–ও হতে পারে।

এই গল্পটা বলার কারণ কী, তা এবার বলব।

আমেরিকায় সবকিছু চলে প্ল্যান করে। সরকারের পাঁচশালা পরিকল্পনার মতো। আমার কলিগেরা সব দুই–তিন বছর আগে থেকেই জানেন কবে কোন তারিখে তাঁরা মাচুপিচুর চূড়ায় উঠবেন এবং ওই দিন পূর্ণিমা থাকবে না অমাবস্যা। আর আমি সাধারণত গাড়ির মধ্যে জামাকাপড় আর কুলারে খাওয়া–দাওয়া নিয়ে একদিকে রওনা দিই। পথ যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকে যাই।

এবার আমারও আমেরিকান হওয়ার স্বাদ জাগল! এক বছর আগে থেকে ছুটি নিলাম। তিন সপ্তাহ বাংলাদেশে থাকব আর এক সপ্তাহ হাওয়াই। বাংলাদেশে একাই যাব। একটা টিকিট কোনো বিষয় নয়। নিজের বাড়ি গিয়ে থাকব হোটেল মোটেলের ঝামেলা নেই। কিন্তু হাওয়াই যাব টোনাকে নিয়ে। তাই টিকিট–হোটেল সব বুক করে ফেললাম। কবে কোন দ্বীপে যাব, কবে আনারসখেত মানে pineapple plantation দেখব সব ঠিক।

আমেরিকানরা আবার এক কাঠি ওপরে। যেই ভ্যাকেশনের আইডিয়া নেবে তো সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে ডায়েট, এক্সারসাইজ ইত্যাদি। বিচে গিয়ে বিকিনি পরে ছবি তুলবে পাঁচটা। তার মধ্যে একটা ইনস্টাগ্রাম বা স্নাপচ্যাটে আপলোড করবে। এর জন্য না খেয়ে শুকাবে বছরখানেক আগে থেকে।

আর আমরা চারজন একসঙ্গে একটা মুরগির রান খেলে ফেসবুক লাইভ দিয়ে রাখি। ডজনে ডজনে ছবি ত্যাড়াব্যাকা হয়ে তুলে ফেসবুক সয়লাব করে রাখি। তারপর নিজেরাই নিজেদের বলতে থাকি, you look beautiful, you look amazing, nice family picture, how cute ইত্যাদি। যাক ঘটনায় ফিরে আসি।

যখন বাংলাদেশের টিকিট কাটব কাটছি করছি, এমনি একদিন বাসায় এসে দেখি ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস থেকে রেজিস্টার্ড চিঠি এসেছে। কিন্তু আমাকে না পেয়ে স্লিপ রেখে গেছে।

আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। কবে কী করলাম! বেআইনি কী করলাম যে রেজিস্টার্ড চিঠি? আজ তো চিঠি পাব না, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

টোনাকে ফোন করলাম, এই শুনছ আমার নামে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস থেকে রেজিস্টার্ড চিঠি এসেছে। কেন, কী করলাম?

: মনে কইরা দেখো কবে কোন রোগী মাইরা ফেলছ, ফ্যামিলি হয়তো সু করছে!

: কী যা তা বল! রোগী মারতে যাব কেন?

: তাহলে ট্যাক্স ফাঁকি দিছ? কিছু তো একটা করছ।

এই লোকের সঙ্গে কথা বললে আমি তো হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাব। ফোন রেখে দিলাম।

কম্পিউটার খুলে বসলাম, গুগলের কাছে জানতে চাইলাম, হোয়াট টু ডু হোয়েন ইউ রিসিভ এ লেটার ফ্রম ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস।

দুনিয়ার উত্তর চলে এল। প্রথম কথা ‘বিচলিত হবেন না, সম্ভবত আপনি কোনো মামলার সাক্ষী হয়ে যাবেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

লেখিকা
লেখিকা

যাক গুগল সোনা আমার টোনার চেয়ে ভালো উত্তর দিয়েছে। কিন্তু বুক ধুর ধুর থামল না। ট্রাফিক আইন অমান্য করা থেকে রোগী মারা পর্যন্ত সব সম্ভাব্য কারণ ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে গেল। রেডি হয়ে সোজা পোস্ট অফিস। খুলবে নয়টায়। সাড়ে আটটায় গিয়ে দেখি, আমার মতো ভয় পাওয়া মানুষের অভাব নেই। লম্বা লাইন। সবার হাতে একটা করে আমার মতো স্লিপ। নিজেকে কেমন ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল লাগছে। মাগশট দেওয়ার কথা ভেবে ভয় লাগল। কোনো মেকআপ করা নেই।

আমার আইডি দেখিয়ে স্লিপ দিতেই মোটা একটা খাম ধরিয়ে দিল। খামটা হাতে নিয়ে তাড়াহুড়া করে খুলতে গিয়ে চিঠির খানিকটা ছিঁড়ে ফেললাম। দোয়াদরুদ যা মনে আসে পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম। বিপদে পড়লে সাংঘাতিক ধার্মিক আমি। কিন্তু শানেনজুলটা কোথায়!

ছোটবেলায় উপন্যাস পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই নায়ক নায়িকার মিল হলো কি না, দেখতে শেষ পাতাটা পড়ে ফেলতাম। সে ছিল অন্য রকম উত্তেজনা।

আর এখানে তো জীবনমরণ সমস্যা। যাক পড়ে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে আমি ক্রিমিনাল নই। জেনে খুশি হলাম। আমার কর্মস্থলে এক মামলায় আমার সাক্ষী হয়ে যেতে হবে। ঠিক আমার যখন বাংলাদেশে গিয়ে তিন শ ফুটের রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে পথশিশুদের সঙ্গে ফুটবল খেলার কথা!

পরদিন কলিগদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম আমার মতো আর ছয়জনকে যেতে হবে। সবাই রীতিমতো কেস স্টাডি করা শুরু করেছেন। পালানোর উপায় নেই। বাংলাদেশের পার্ট মাথা থেকে ঝেড়ে বাইবেলের ওপর হাত রেখে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না’ প্র্যাকটিস করা শুরু করে দিলাম। আর ভাবলাম, ভাগ্যিস এক সপ্তাহ হাওয়াইয়ে যাওয়াটা ঠিক আছে। পুরো সামারটা একদম মাঠে মারা যায়নি। আগস্টের ২২ ও ২৩ দুদিন কোর্টের কাজ শেষ করে ২৬ তারিখে হাওয়াই।

ছেলেমেয়ে দুজনেরই স্কুল খুলে যাচ্ছে। তাই আমাদের সঙ্গে যেতে পারছে না। এই প্রথম ছেলেমেয়ে ছাড়া আমরা টোনাটুনি বেড়াতে যাচ্ছি। মনটা কেমন খচখচ করছে। তারপর ভাবলাম, ওদের তো সারাটা জীবন পড়ে আছে। যাই একটু ঘুরে আসি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। পার্ল হারবারে কী করে জাপানিরা আক্রমণ করেছিল তা দেখব। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখব। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর মিলেমিশে থাকা দেখব। এলভিস প্রিসলির গান শুনতে শুনতে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে হারিয়ে যাব। প্রতিদিন সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখব।

এর মধ্যে আমার ছেলে কল করে বলল, মা টিভি খুলে দেখ হাওয়াইতে কী অবস্থা।

আমি মনে মনে বলি, বলে কী দুদিন বাদে ফ্লাই করব। এর মধ্যে কী হলো।

ছেলে বলল, ক্যাটাগরি ৫ মৌসুমি ঝড়। হ্যারিকেন ধেয়ে চলছে হাওয়াইয়ের এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে।

দুই-এক দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই থেমে যাবে বাবা, কিচ্ছু হবে না বলে ছেলেকে থামিয়ে টিভি ছাড়লাম। একটার পর একটা সে কী ভয়াবহ সংবাদ দেখতে লাগলাম টিভিতে। ১৯৯৪ সালের পর এটাই নাকি সবচেয়ে বড় হারিকেন হাওয়াইতে হচ্ছে। বৃষ্টি ক্রমশই বাড়ছে। ৫২ ইঞ্চি বৃষ্টিতে বন্যায় তলিয়ে গেছে দ্বীপগুলো। সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস আর ঘূর্ণিঝড়ে মাউইতে আগুন লেগে একাকার। বিভিন্ন স্টেট থেকে রেসকিউ টিম যাচ্ছে। বলছে সেখানে অধিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত শেলটার নেই।

পরের দুটো দিন গেল psycology–র 5 stages of grief এক এক করে denial, anger, bargaining, depression and acceptance–এর। এ কিছুতেই হতে পারে না থেকে ভাগ্যিস ওখানে যাওয়ার পরে হয়নি–তে এসে ঠেকেছে।

হোটেলে কল করলাম। কিছু বলার আগেই টাকা ফেরত দিয়ে রিজারভেশন বাতিল করে দিল। বাকি সব ট্যুর বাতিল করলাম। কিন্তু এয়ারলাইনের লোকগুলো কিছুতেই ফ্লাইট ওড়ার সময়ের আগমুহূর্ত পর্যন্ত ফ্লাইট বাতিল করবে না। আমার দিক থেকে বাতিল করায় এক হাজার ডলার গচ্চা।

কী আর করব। হতাশায় পড়লেই আব্বার সেই মহান বাণী কানে আসে—‘মা কিছুর জন্য মন খারাপ হলে নিচের দিকে তাকাবা, মন ভালো হয়ে যাবে। তুমি জুতার জন্য কাঁদলে যার পা নেই তার কথা মনে করবা। দেখবা জুতার কথা আর মনে থাকবে না।’ এ ক্ষেত্রে কী ভাবব বুঝতে পারছি না। তবে প্ল্যান করে আমার কিছু হবে না। এটা ভালো করে বোঝা হয়ে গেছে। তবে তাই হোক, one day at a time. প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচব।