ফল কুড়ানি

আপেল বাগান। ছবি: লেখক
আপেল বাগান। ছবি: লেখক

কিছু কিছু স্বভাব মানুষের জন্মগত। যেমন আমার মেয়ে যখন হাঁটতে শিখল, তখন কোথাও কোনো মিউজিক হলে সে মিউজিকের তালে তালে নাচত। যদিও আমরা কখনো তাকে নাচতে শেখাইনি। সে রকম একটা অভ্যাস হলো ফল কুড়ানো বা গাছে পাকা ফল দেখলে তা পাড়তে চাওয়া।

মানুষের এ রকম অদম্য ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য সারা পৃথিবীতে নানা ব্যবস্থা আছে। তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সুনিয়ন্ত্রিতভাবে বাগানে ফল কুড়ানো উল্লেখযোগ্য।

সিডনি থেকে একটু বের হলেই নানা ফলের বাগান। যত দূর চোখ যায় কোথাও মাঠে গরু, ভেড়া বা ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে, অথবা দিগন্তবিস্তীর্ণ ফলের বাগান পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন রকম ফলের বাহার।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ফলের মধ্যে রয়েছে প্লাম, নেক্তারিন, পিচ, স্ট্রবেরি, চেরি, ম্যান্ডারিন, বেরি, আম ইত্যাদি। শীতকাল আর হেমন্তে পাওয়া যায় চেস্টনাট, ওয়ালনাট, আপেল, পিচ, টমেটো, পারসিমন ইত্যাদি।

আপেল বাগান। ছবি: লেখক
আপেল বাগান। ছবি: লেখক

এর বাইরেও অনেক ফল আছে; যা কুড়ানোর জন্য উপযুক্ত নয় বা অস্ট্রেলিয়ার অন্য শহরে পাওয়া যায়। যেমন তাসমানিয়ায় আপ্রিকট কিংবা মেলবোর্নের অরেঞ্জ। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় কুইন্সল্যান্ড আর ডারউইনে।

মজার ব্যাপার হলো, এই দুই জায়গার আবহাওয়া অনেকটা আমাদের দেশের মতো। ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার জন্য আমাদের দেশে জন্মায় এ রকম ফল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এই দুই জায়গায়। যেমন—আম, লিচু, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল ইত্যাদি।

আমাদের জন্য আপেল কুড়ানো বেশ উত্তেজনাকর। কারণ, এই ফলের গাছ আমাদের দেশে দেখা যায় না। আর ছোটবেলা থেকেই আপেলগাছের অনেক ছবি দেখলেও গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়ার সৌভাগ্য অনেকের হয় না।

আমাদের সকালবেলা যাওয়ার কথায় সবাই আগের রাত থেকে বেশ উত্তেজিত। এর মধ্যে শুনলাম, আপেল বাগানে নাকি সাপ থাকে। সবাই সাপে ভয় পায়। কিন্তু আপেল কুড়ানোর উত্তেজনার কাছে এ ভয় কিছুই নয়।

সকাল সকাল বেরিয়ে যখন বিলিপিন নামের জায়গার আপেল বাগানে পৌঁছালাম, তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে। কাছ থেকে বাগান দেখা আর ছবিতে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই প্রথম বুঝতে পারলাম। আপেল বাগানে সাপের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য গামবুট দেওয়া হয়। কেউ চাইলে এই গামবুট ছাড়াও ঢুকতে পারে। বড়দের জন্য কিছু এন্ট্রি ফি আর ছোটদের জন্য বিনা মূল্যে প্রবেশের ব্যবস্থা।

আপেল বাগান। ছবি: লেখক
আপেল বাগান। ছবি: লেখক

বাগানে ঢোকার পর সৌন্দর্য দেখব, না আপেল পাড়ব, তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় মাটি বেশ ভেজা কিন্তু কাদা নেই কোথাও। হাঁটা পথের দুই পাশে সারি সারি আপেলগাছ। লাল আপেলে প্রায় সব গাছ নুয়ে পড়েছে। চারপাশে আপেল মাটিতে পড়ে আছে। যদিও এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়।

গাছ থেকে যে যার ইচ্ছেমতো আপেল পাড়তে পারে। বের হওয়ার সময় ওজন করে দাম দিয়ে দিতে হয়। আপেল খাওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যার যত ইচ্ছা খেতে পারে। গাছের আপেলগুলো এত নয়নাভিরাম যে সেগুলো ছিঁড়তে গেলে নিজের কাছেই খারাপ লাগে।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আপেল বাগান দেখা। কিন্তু এই সৌন্দর্য যেন দেখে শেষ করা যায় না। আর খাওয়ার কথা, হাতের কাছে যখন এ রকম হাজার হাজার আপেল দেখা যায়, তখন খাওয়ার ইচ্ছাটা মনে হয় নিজে থেকে কমে যায়। তারপরও হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকটি আপেল খাওয়া হয়ে গেল।

কোথাও সাপখোপের চিহ্ন নেই। হয়তো গাছের গভীরে এদের বাস। বলার অপেক্ষা রাখে না, অস্ট্রেলিয়ায় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিষধর সাপের আস্তানা। যদিও হুটহাট এদের দেখা যায় না।

বাস্কেটে বেশ কিছু আপেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে এসে দাম মিটিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বসলাম, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। দূরদিগন্তে পাহাড়ের ওপর সোনালি সূর্য তার শেষ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একবার পাতাগুলোর দিকে, আরেকবার আপেল বাগানের দিকে তাকালাম। সৌন্দর্যের কোনো সংজ্ঞা হলে তা বোধ হয় এ রকম হতো।