ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: কমলা রোদের মাল্টা-২

মাল্টার কেল্লা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে
মাল্টার কেল্লা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে

স্লিমা বন্দর নগরী। ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, গির্জা, অভিজাত দোকানপাটের পসরা, কী নেই। বাস থেকে নেমেই হাঁটা দিলাম নোঙর ফেলা ঝাঁচকচকে বিশাল ফেরিটার দিকে।

ওমা, লোকগুলো আমাদের হাতের টিকিট দেখে হতচ্ছাড়া চেহারার আরেকটা ফেরি দেখিয়ে দিল। তার কাঠের গলুইয়ের ছাল উঠে গিয়ে বাকল উঁকি মারছে— জলদস্যুদের চোরাই জাহাজ যেমন দেখায়। কী আর করা। ছাও পাও গলা ঝুলিয়ে তাতেই লাফিয়ে উঠে পড়লাম।

কাঁধে ঝোলা নামিয়ে দম ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে বসেছি মাত্র। মা-বাবা অন্যমনস্ক। এই মওকায় আমাদের তাফসু মিয়া মাঝদরিয়ায় ঝাঁপ দেওয়ার ফন্দি এঁটে ফেলল। রেলিংয়ের ওপর একদম ঝুঁকে পড়ে পারলে।

কিন্তু না, তার মা মতলব বুঝে নিয়ে খপ করে ধরে জব্বর এক বকুনি দিয়ে বসিয়ে দিল। মাইকেল ফেলপ্স হয়ে দুর্দান্ত ডাইভটা আর দেওয়া হলো না বেচারার। এই দুঃখে সে ভূমধ্যসাগরের তিমি আর ডলফিনদের কানের পর্দা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল।

উল্টো দিকে বসা ছোট্ট আমালিয়া তখন মায়ের কোলে গভীর ঘুমে মগ্ন। ছেলেমানুষের ভ্যাক কান্না দেখার মতো ফালতু সময় তার নেই।

স্পিকারে রেকর্ড করা অস্পষ্ট কণ্ঠ কানে ভাঙা ক্যানেস্তারার মতো বাজছে। আমরা নাকি এখন মাল্টার জীবন্ত অতীত দেখতে পাব। অতীত মানে তো ভূত। তা, দেখা যাক এই ভূত কেমন ভূত।

মাল্টার কেল্লা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে
মাল্টার কেল্লা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে

এরপর যা দেখলাম, তা ভূতের চেয়ে কিছু কম নয়। ষোলো শ শতকের গড়া উঁচু পাঁচিলের যে পেল্লায় কেল্লার দেখা মিলল, তার জেল্লার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ভার। সেটা মারাত্মক দক্ষ ভুতুড়ে প্রকৌশলী-কারিগর ছাড়া আর কারও বানাতে পারার কথা না। এই কেল্লাতেই এখন মাল্টার কেল্লাফতে। কত যে পর্যটক আসছে আর পয়সা ফেলে দেখে যাচ্ছে।

আরও চোখে পড়ল সুবিশাল সুরক্ষিত হাসপাতাল। সেই ১৬৪৩ সালে গড়া। কিন্তু সবকিছুতেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। কারণ আর কিছু নয়। মাল্টার চারপাশে লোকজন খালি ছোঁক ছোঁক করত সেকালে। বন্দরটা একবার হাতিয়ে নিতে পারলে অনায়াসে ইতালি, লিবিয়া কী তিউনেসিয়ায় ঢুকে পড়া যায়।

একে একে গ্রিক, রোমান, আরব, ফরাসি, ইংরেজ—বহু শাসকই এসেছেন। এসেই আবার পরেরজনের থাবা থেকে বাঁচতে মাল্টা দেয়াল আরও দুর্জ্ঞেয় করে গড়ে তুলেছে। এই হলো প্রাচীন মাল্টার প্রাচীর কাহিনি!

একটু পরই দৃশ্যপট পাল্টে গেল। একটা খাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। নাম পিয়েতা। সেখান ভিড় করে দাঁড়ানো চোখ ঝলসানো দারুণ সব বিলাসবহুল ইয়ট। মনে একটা চিন্তা খেলে গেল। লোকে বাড়িঘর করে কী করতে? তার চেয়ে এমন একটা বাহারি বজরা কিনে ফেললেই তো পারে। সাতসাগর তেরো নদীতে না–ও ভাসিয়ে দিনদুনিয়া ঘুরে বেড়ানো যেত। আহা!

হঠাৎ টের পেলাম, সাগরের তাজা বাতাসে খিদেটা কেমন চাগিয়ে উঠছে। অনেক হয়েছে নীল সাগর। এখন নীল সাগরের জলে যারা থাকে, তাদের খেতে ইচ্ছে করছে। ইশ্, মাছের গ্রিল লাঞ্চ হিসেবে খুব জমত। কী আছে জীবনে! খেয়ে মরে যেতে চাই। সুতরাং ছোট্ট ফেরিটা পাড়ে ভিড়তেই আমরা খেয়ে মরার উদ্দেশ্যে ছুটলাম।

মার্সাশ্লকের রঙিন দরজা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে
মার্সাশ্লকের রঙিন দরজা। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে

আবার সেই দোতলা বাস। যাচ্ছি মার্সাশ্লক (Marsaxlokk) নামের এক মেছোপল্লিতে। সকালের দিকে সেখানে জাল ফেলে ধরা তাজা মাছের বাজার বসে। এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তবুও মাছ তো রেস্তোরাঁয় মিলবেই।

মার্সাশ্লক জায়গাটার বাড়িঘর ম্যাটমেটে সাদাটে। বেশির ভাগই দোতলা। কিন্তু এত সাদামাটার ভেতরেও একটা চমক আছে। দুপাশের সব বাড়ির ফটকগুলো লাল, সবুজ, নীল কিংবা হলুদ। চোখ ধাঁধিয়ে একাকার। দাঁড়িয়ে পড়ে ক্লিক ক্লিক ঝটপট কিছু ছবি তোলা হলো।

দলের ভেতর ছবির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস আদিবার। তাঁর বয়স কম। এতই কম যে যখন সে জন্মেছে, তত দিনে আমি বেজার মুখে ক্লাস ফাইভের বৃত্তির পড়া পড়ছি। তো, আদিবার কবলে পড়ে তার কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম।

সেটা দেখে পেটের খিদে-রাক্ষসটা ‘গ্রাউল গ্রাউল’ শব্দে খুব একচোট রাগ দেখাল। এরপর আর দেরি না করে ভাজা মাছের ঘ্রাণ বরাবর প্রায় উড়ে যেতে থাকলাম।

খেয়ে দেয়ে অবিশ্বাস্য একটা বিল চুকিয়ে যখন বেরোলাম, তখন সবার চোয়াল ঝুলে গেছে। ব্যাটারা গলা কেটে রেখে দিয়েছে। আর ভাজা মাছটাও কেমন ঠান্ডা ছিল।

সবার আশাভঙ্গ চেহারা দেখে দুষ্টুমি করে বললাম, ‘মাছ তো ডাঙায় তুলেই পাতে দিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে তাজা মাছ আর হয় নাকি? তোমাদের খালি অভিযোগ আর অভিযোগ!’

হতাশা তাতে ঘুচল না। পাত্তা না পেয়ে মাথা চুলকে অফ মেরে গেলাম।

আবার বাস। আবার ছুট। এবার গন্তব্য ব্লু গ্রোটো। নীল গুহা। ঝিকিমিকি বালুতে রোদ পড়ে গুহার দেয়ালে ঠিকরায় রংধনুর নানা রঙে। দেখার মতো দৃশ্য নাকি। জায়গায়টা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল। দুপুরের বাঘ রোদটা তেজ হারিয়ে মিউ মিউ বিড়াল হয়ে এসেছে। নরম রোদের ওম পিঠ নিয়ে এলোপাতাড়ি হাঁটছি।

খাঁড়ি থেকে গুহাগুলো চোখে পড়ে। খাঁড়িটা ভীষণ উঁচু। পাঁচতলার সমান তো হবেই। পাথুরে আর পিচ্ছিল বলে একটু পরপর ‘বিপজ্জনক’ লেখা খুঁটি গাড়া। ছানাপোনারা দৌড়ে গিয়ে খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলার জোগাড় করছে। তাদের সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম সবাই মিলে।

ঠুস! গুলির শব্দের মতো লাগল যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আগের দিনের জোব্বা-জাব্বা কাপড় পরে জনা কয়েক খাড়ির কিনারা দাঁড়িয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। কাছেই তাদের বিবিরা মধ্যযুগীয় ঘেরওয়ালা গাউন পরে কতগুলো ঘটিবাটি আগলে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। গাউনে তাপ্পিও আছে দেখছি।

সাগর ঘেঁষে খাঁড়ি। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে
সাগর ঘেঁষে খাঁড়ি। ছবি: আদিবা আমাতের সৌজন্যে

আমাদের চোখে কৌতূহল খেলে গেল। এই সাজপোশাক ভাড়ায় মেলে। আপনি পয়সা দিয়ে জোব্বা কিনে গায়ে চাপিয়ে কায়দা করে বন্দুকে ঠুস করবেন আর পেশাদার ছবিয়াল দারুণ একটা ছবি খিঁচে দেবে। ছবির এক কোনায় আপনার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় হাঁ করে বসে থাকা বউকে ঝাপসা মতো একটু দেখা যাবে। ছবি, জামা, আনুষঙ্গিক মিলে ফুল প্যাকেজ। বউটা অবশ্য নিজের থেকে জোগাড় করতে হবে।

কারবার দেখে মুগ্ধ হয়ে ছানাদের উৎসাহী বাবারা আমাদের ছবি তোলার প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলল। আদিবা আর আমি ব্যাপক মাথা নেড়ে প্রস্তাব নাকচ করে দিলাম। আলুথালু বেশে ঘটিবাটি আগলে বসে থাকার মধ্যে আমরা কোনো থ্রিল খুঁজে পেলাম না। ছেলেপুলের বাবারা আশাহত ভঙ্গিতে গুহার দিকে এগুলো।

গুহায় ঘুরে আসতে হলে ডিঙি নৌকায় চাপতে হয়। ডিঙিগুলো দেখতে অবিকল শরণার্থীদের অথই জলে ভাসিয়ে দেওয়া কমলা রঙের রাবার বোটগুলোর মতো। তার ওপর লাইফ জ্যাকেটের কোনো নাম গন্ধ দেখলাম না। মাথা ঘুরিয়ে কোনো ওয়াচ টাওয়ারও চোখে পড়ল না।

খুব বোঝা গেল এদের কাজকর্মের ধারা। আমরাও আছি। কেউ পাঁচ ফিট পানিতে সাঁতারে ওস্তাদ কিন্তু বিশ ফিটে গেলেই চালের বস্তার মতো ডুবে যাব। সমুদ্দুর তো বহুত দূর। আবার কেউ সাঁতার না জানলে কী হবে, প্রচুর ইউটিউব ভিডিও দেখে সাঁতারের থিওরি জানা কাবিল লোক। অতএব, গুহার দেয়ালে আলোর ঝলকানি দেখা আর হলো না।

পাথুরে খাঁড়ির বড় চাঁইয়ের ওপর বসে আরও খানিকটা অলস সময় গড়িয়ে যেতে দিলাম। লোকজন ঝপাৎ ঝপাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেউ সাঁতরেই গুহার দিকে রওনা দিয়েছে। কেউ কেউ আবার খাঁড়ি বেয়ে উঠে এসে একটু জিরিয়ে ফের ঝাঁপাচ্ছে। তাদের সঙ্গে লাল সূর্যটাও হাই তুলে ডুবে যাওয়া শুরু করেছে।

কখন যে শেষ ফিরতি বাসটা এসে চলে গেছে, খেয়ালই নেই। এখন ট্যাক্সি ডাকা ছাড়া উপায় নেই। নইলে রাতের বুফে ডিনার ছুটে যাবে। ইচ্ছা ছিল, কোপাকুপি রকমের খেয়ে দুপুরের ঠান্ডা মাছের বদলা নেব। ভাগ্য ভালো, ট্যাক্সি জুটল সময়ের ভেতরেই। সিনেমায় কিডন্যাপ দৃশ্যে যে রকম বিশাল কালো গাড়ি দেখানো হয়, ঠিক তেমন একটা এসইউভি এসে আমাদের তুলে নিয়ে ভোঁ দৌড় দিল।

ড্রাইভার লোকটা ব্রিটিশ। লন্ডনে বাড়ি। নাম ডেভিড। কথাবার্তায় বেশ মিশুক। খুঁটিয়ে জেনে নিল আমরা কোন দেশের লোক, এখন কই থাকি। আবার যেচে পড়ে বলল, লন্ডনের অলিগলি তো দারুণ সব বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় সয়লাব। দুই কথার পর আমরা আর কথা খুঁজে পাচ্ছি না দেখে সে ব্রেক্সিট নিয়ে আলাপ পাড়ল।

রাজনীতির ঘ্রাণ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছি। রাজা উজির মারার সুযোগ কোন বাঙালি কবে ছেড়েছে? চওড়া হাসির ডেভিড আপন মনে বলে যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফাঁদে পড়ে তাদের জাত পাত গিয়েছে। এখন ‘ব্রেক্সিট’ নামের খিড়কির দোর দিয়ে পালিয়ে হারানো ইজ্জত উদ্ধার হবে। অস্ত যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আবার স্বমহিমায় কান চুলকে, চোখ কচলে জেগে উঠবে। সুতরাং, জয় মাতা ব্রেক্সিট! বেচারার ঘোরটা আমরা কেউ ভাঙালাম না। (চলবে)
---
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: