বেড়ানো: বর্ণিল শহরে প্রকৃতিপ্রেমিক আমরা

সেন্ট্রাল পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
সেন্ট্রাল পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

নিউইয়র্ক শহরে থাকলেও সময়–সুযোগ মিলিয়ে প্রতিনিয়তই পরিকল্পনা করে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়। মাইলের পর মাইল ড্রাইভ করে সদলবলে ছুটে যাওয়া হয় পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গল, দূর পাহাড় কিংবা নদীর ধারে।

শরৎ আর হেমন্তের মিলিত এই সময়টাতে এখানে গাছে গাছে, পাতায় পাতায় রঙের উৎসব চলে। যেদিকে দুই চোখ যায়, কেবলই সবুজ, হলুদ, কমলা আর লালের ছড়াছড়ি; যেন ওপর থেকে স্রষ্টা মুঠোভর্তি রং ছুড়ে দিয়েছেন পৃথিবীর পানে। আর তা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছে প্রকৃতির গাছে গাছে।

উত্তর আমেরিকায় এই সময়টাকে বলে ‘ফল ঋতু’; যদিও সারা বিশ্বে বলে ‘অটাম’। এবার বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছিলাম সেন্ট্রাল পার্কে যাব ফল কালার (পাতার রং) দেখতে। পরিকল্পনা করেছি, সন্তানদের স্কুলে দিয়েই ছুটে যাব ট্রেনস্টেশনের উদ্দেশে।

যে কথা সেই কাজ। ছয় বন্ধু মিলে সকালের হালকা শীতল বাতাস গায়ে মেখে একত্র হই রুজভেল্ট অ্যাভিনিউ স্টেশনে। শহরের লোজজন তখন ছুটছে কর্মস্থলের উদ্দেশে।

সাত নম্বর ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা ছিল না, তবু লোকজন কী ভীষণ সচেতনতায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের ভেতরের হাতল ধরে। কেউ কারও বিরক্তির উদ্রেক করেন না। শাঁই শাঁই করে হেলেদুলে তীব্রগতিতে ছুটে চলছে ট্রেন।

সেন্ট্রাল পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
সেন্ট্রাল পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

টাইমস স্কয়ার স্টেশনে এলে নেমে যাই আমরা। অন্য ট্রেন ধরব বলে। ট্রেন বদল করে এবার এক নম্বর ট্রেনে চেপে বসি। ‘কলম্বাস সার্কেল’ স্টেশনের উদ্দেশে। যথাসময়ে ট্রেন এল। এবার একেবারেই ফাঁকা বগি। ভিড়ভাট্টা নেই। যেন আমরাই রাজা, বগিজুড়ে আমাদেরই রাজত্ব।

যাত্রাপথের স্মৃতি ধরে রাখা হবে না, এ তো হতে পারে না! শুরু হয় ক্লিক ক্লিক। বন্ধুরা কখনো এক লাইনে বসে, কখনোবা স্টিলের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত।

ট্রেন এক স্টেশন ছেড়ে অন্য স্টেশনের উদ্দেশে ছুটে চলছে। ছবি তুলছি একের পর এক। স্পিকারে ঘোষণা হচ্ছে, দিস ইজ কলম্বাস সার্কেল। নেক্সট স্টপ ইজ...। আচমকা লাফিয়ে উঠি আমরা। এখানেই তো নেমে যেতে হবে আমাদের।

হুড়মুড় করে উঠে যেতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হায়! ট্রেন ছুটে চলছে ঝড়ের গতিতে পরবর্তী স্টেশনের উদ্দেশে। ছবি তোলায় মনোযোগী হতে গিয়ে নির্দিষ্ট স্টেশন পেরিয়ে গিয়েছি বলে নিজেরাই নিজেদের তিরস্কার করলাম। পরবর্তী স্টেশন থেকে ফিরতি ট্রেনে ফিরে আসি কলম্বাস সার্কেলে। আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে।

সাবওয়ে থেকে বাইরে এলে তীব্র এক ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় মন, প্রাণ, শরীরে। সকালের হিমেল বাতাস। ঝকঝকে মিষ্টি রোদ। মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশ। কতকাল এমন করে সকালকে উপভোগ করা হয়নি। রোজ ভোরে ওঠা হয়, সূর্যোদয় দেখা হয়, রুদ্ধশ্বাসে সন্তানকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া হয়। এই যান্ত্রিক শহরে হাজারো ব্যস্ততাকে এড়িয়ে যাওয়া হয় না আমাদের। উপভোগ করা হয় না শরৎ, হেমন্তের এমন কোমল সকাল।

কলম্বাস সার্কেলের একপাশের দেয়ালের গা ঘেঁষে একঝাঁক কবুতর অলস বসে আছে। অন্য পাশে একজন ফটোগ্রাফার তাঁর মডেলের ছবি তোলায় ব্যস্ত। সেন্ট্রাল পার্কের সামনে কিছু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কাস্টমারের খোঁজে। নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে দর্শনার্থীদের গাড়িতে চড়িয়ে পুরো পার্ক ঘুরিয়ে দেখান তাঁরা।

সেন্ট্রাল পার্কে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
সেন্ট্রাল পার্কে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

আমরা হাঁটছি। সঙ্গে করে নিয়ে আসা গরম ভাপা পিঠা খাচ্ছি। ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির পাগল করা সৌন্দর্য উপভোগ করছি। চারদিকে কী অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! দিনের শুরুতে ব্যস্ত এই শহরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেউ হেঁটে চলছেন আপনমনে, একাকী। কেউ বা জগিংয়ে ব্যস্ত। পাশের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যসচেতন একদল মানুষ।

আমরা পার্কের ভেতরে প্রকাণ্ড সব গাছের নিচে ছায়াঘেরা পথ ধরে হেঁটে চলছি। সবুজ গাছের পাতা ধীরে ধীরে হলুদ, কমলা আর লাল হয়ে ওঠা বিষয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে পড়েছিলাম, পাতায় সবুজ রঞ্জক পদার্থ ক্লোরোফিল থাকে। বছরের এ সময়ে পাতারা ক্লোরোফিল উৎপাদন ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয় বলে পাতার এসব রং প্রকট হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে রংগুলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ক্লোরোফিল উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে পাতার রং তীব্র হয়ে ওঠে। এই তীব্র রঙের কারণে চারপাশের প্রকৃতি অসাধারণ বর্ণিল হয়ে ওঠে। এই অপরূপ প্রকৃতিকে চাইলেও কেউ উপেক্ষা করতে পারেন না।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা লেকের ধারে এসে বসি। একদল চিত্রশিল্পী আগুনরঙা প্রকৃতিকে সামনে রেখে আপন মনে এঁকে চলেছেন মনোরম সেই দৃশ্য। একপাশে এক মধ্যবয়সী পুরুষ পিয়ানোয় গেয়ে চলেছেন আপন মনে সুমধুর এক সুরের গান। চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসা প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ কী ভীষণ মনোযোগে শুনছেন সেই সুর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঝকঝকে নীল আকাশের নিচে বসে শুনছিলাম আমিও।

আকাশ, গাছ, মানুষ, সুর—সবকিছুর সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার কী অদ্ভুত যোগসূত্র! আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এই সুন্দর পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকার সময়টা এত কম নির্ধারণ করা হলো কেন? আমরা কেন আরও বহু বহু বছর ধরণির এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে যেতে পারব না?

এই যে কদিন বাদে পাতাগুলো ঝরে যাবে। এই ঝরাপাতার সঙ্গেও আমাদের জীবনের কত মিল! যাক, এসব বিষণ্ন বিদায়ী কথা না-ই বলি। আমাদের সন্তানদের স্কুল ছুটির সময় নিকটবর্তী হয়ে এল বলে আমাদেরও ফেরার তাড়া। আমরা সঙ্গে থাকা চানাচুর ও চিপস খেতে খেতে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ের দিকে হাঁটছি ট্রেন ধরব বলে। আমাদের সবার গন্তব্য ভিন্ন হওয়ায় বিদায় নিয়ে ছয় নম্বর ট্রেনে চেপে বসি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্তানের স্কুলে পৌঁছাতে হবে। প্রশস্ত প্ল্যাটফর্মে হাঁটছি দ্রুত পায়ে। একপাশে গিটারে দুই চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছেন এক তরুণী...।