ভালোবাসার মুগ্ধতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কতশত মনছোঁয়া কাহিনি শুনি রোজ। লিখে ফেলছি যখন-তখন মন খারাপের দেশ থেকে এক নিমেষে ভালো লাগার আবেশে ফিরে আসতে। সুলেখিকা কাজী ফাল্গুনী ঈশিতা, ঘটনাগুলো সত্যি কিন্তু।

আজকে সকালে কাজে গিয়ে দেখি সহকর্মী নোভা মুগ্ধ চোখে থার্মোফ্লাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের ডেস্কের দিকে যেতে যেতে বললাম, নোভা নতুন কিনেছ নাকি ফ্লাস্ক?

নোভা তাকিয়ে বলল, জানো ফারহানা, আজকে সকালে কফি বানিয়েও হুড়োহুড়ি করে ফ্লাস্কে ঢেলে আনতে পারিনি। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। স্টপ লাইটে বসে হঠাৎ ডান দিকের রিয়ার ভিউ মিররে দেখি আমার হাবি খালি পায়ে ফ্লাস্ক খুব সাবধানে ডান হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে। গাড়ির কাছে পৌঁছে বলল, এত কষ্ট করে কাজ কর, কফি ছাড়া চলে গেলে হবে?

গত বছর এক কনফারেন্সে সবুজ স্যারের সঙ্গে দেখা। জটিল সব বিষয়ে লেকচার শোনার পাশাপাশি খুব কৌতূহল নিয়ে তাঁর কাছাকাছি ঘুরঘুর করছিলাম। লাঞ্চের সময় তাঁর পাশে বসার সুযোগ হলো। আমি বাংলাদেশি শুনে খুশি হয়ে জানতে চাইলেন অনেক কিছু।

আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার একটা পার্সোনাল কথা জানতে চাইলে উত্তর দেবেন?

স্যার বললেন, অবশ্যই।

বললাম, শুনেছি আপনি বিয়ে করেননি অনেক অপশন থাকা সত্ত্বেও। কেন স্যার?

স্যার হাসলেন, তারপর বললেন, বিয়ে তো হয়েছিল আমার। ছবি দেখে এক অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। বিয়ের রাতে সেই মেয়ে বলেছিল সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তারপর তিনি নিজে ওই ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাকে। যে ভালোবাসা তিনি নিজের কয়েক ঘণ্টার বউকে দিয়েছিলেন, সেটা আর কাউকে দিতে পারেননি স্যার। তাই কখনো তাঁর আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি।

একজন পারিবারিক বন্ধু বেড়াতে এলেন বাসায়।

প্রথম দেখেছি তাঁকে। বললাম, ভাবিকে নিয়ে এলেন না কেন ভাই?

তিনি বললেন, উনি ব্যস্ত তো, আমি এসেছি ব্যবসায়িক কাজে।

কথায় কথায় জানালেন তাঁর দুই বাচ্চা। কলেজে যাবে আগামী বছর। তারপর পারিবারিক ছবি দেখালেন। দেখলাম ছোট্ট একটা শিশু।

বললাম, ভাই ও কে?

একটু চুপ করে থেকে বললেন, শিশুটির বাবা ওকে আর ওর মাকে এক প্রচণ্ড শীতের রাতে এক কাপড়ে বাইরে বের করে দিয়েছিল মেয়েটা তার স্বামীর মতো স্মার্ট না বলে। মেয়েটার কাছে শুধু ভাবির নম্বর ছিল। ভাবি শুনে সেই রাতে ওই মেয়েকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। বাচ্চাটা এ বাসায় বড় হচ্ছে আর তার মা পড়াশোনা করছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এই শিশুটির জন্য ভাই–ভাবি অনেক ব্যস্ত থাকেন।

বললাম, বেবির মা আপনাদের আত্মীয় তো না?

ভাই বললেন, তার চেয়েও বেশি ভাবি।

লেখিকা
লেখিকা

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একজন ইমাম সাহেবের কথা জানি। সৎ মানুষ তিনি। মানুষের অনুদানের টাকা তিনি সংগ্রহ করেন। কোনো এক ঝড়ে পিঠে গাছের ডাল পড়ে তাঁর স্ত্রী শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। রাতদিন ব্যথা। খুব সীমিত সামর্থ্যে বউয়ের পিঠে অপারেশন তিনি করালেন। তারপর ইনফেকশন হয়ে গেল। দেশের বাড়িতে গিয়ে শেষ সম্বল ছোট্ট জমিটুকু বিক্রি করে এসে চিকিৎসা চালিয়ে গেলেন। কতজন কত কিছু বলল। কান দিলেন না। রাতদিন সেবা করে গেলেন অনেক ব্যস্ত কাজের ফাঁকে। বছরখানেক পরে শুনেছি তাঁর স্ত্রী সুস্থ হয়েছেন। ইমাম সাহেব পেরেছেন ভালোবাসা দিয়ে প্রতিকূলতা পার হতে।

হাসপাতালে সেদিন অনেক রোগী এসেছেন। একজন রোগী পেলাম বহু বছর বিছানায় পড়া। সবকিছু করে দিতে হয়। গত দুই বছর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁকে দেখাশোনা করেন তাঁর স্বামী। এ ধরনের রোগীর বেডসোর থেকে শুরু করে কত জটিলতা হয়। তাঁর কিছু হয়নি। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে পারলেন? একটু হেসে তিনি জানালেন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তাঁরা। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। তারপর বিয়ে। তার কয়েক বছর পর এই জটিল রোগের সূচনা। কিন্তু তাঁর কাছে তাঁর বউ সেই প্রথম দিনের মতোই রয়ে গেছেন।

পুলিশ অফিসার বিয়ে করলেন পরিচিত এক ডাক্তার বান্ধবীকে। বুকে ব্যথা নিয়ে পুলিশ সাহেব এলেন হাসপাতালে। তাঁর বউ আমাদের মতোই শিক্ষানবিশ ডাক্তার তখন। পুলিশ অফিসারকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হবে। তিনি বললেন, না, আগে আমার বউ আসুক। সে বুঝবে, দেখবে তারপর। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তাঁর বুকের ব্যথাকে ম্লান করে দিয়েছে। অনেক বছর পর বান্ধবীর চোখে জটিলতার কারণে সার্জারি লাগল। ডাকসাইটে সৎ পুলিশ সাহেবের বউয়ের হাত ধরে কান্না হাসপাতালের বাকি সব ডাক্তারকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। আমি কিন্তু অনেক দূর থেকে খুব পবিত্র ভালোবাসার সাতরং দেখেছি। পাঠক, তাঁরা এখন ভালো আছেন।

শেষ করছি শ্রদ্ধেয় স্যারের কিছু কথা দিয়ে। দেওয়ালি বা ফেস্টিভ্যাল অব লাইটে তাঁদের আলোকোজ্জ্বল ছবি দেখলাম। বিখ্যাত শিক্ষিত পরিবার। যাঁর মা ছিলেন বিদুষী লেখিকা। প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশে জ্বলজ্বল করছেন ধ্রুবতারা হয়ে। স্যার খ্যাতিমান ডাক্তার শুধু নন, স্বাস্থ্যসেবার বই লিখে কিংবদন্তির কাছাকাছি। আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর বন্ধু হওয়ার ফেসবুকে। ম্যাডামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে।