ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের এ্যারমিতাজ

মূল্যবান চোখজুড়ানো এসব জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ। যা মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে ছিল। ছবি: লেখিকা
মূল্যবান চোখজুড়ানো এসব জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ। যা মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে ছিল। ছবি: লেখিকা

মেলবোর্নকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর। তাই এ শহরে বিভিন্ন সময়ে নানা চিত্তাকর্ষক শিল্পময় কর্মকাণ্ড আয়োজিত হতে দেখা যায়। এই শহর মাদাম তুসো মিউজিয়াম, শিল্পী মনেতের মনেত গার্ডেন প্রদর্শনী করেছিল। ফলে লন্ডন ও ফ্রান্সে না গিয়েও বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো দেখার সুযোগ মানুষ পেয়েছিল।

একবার শীতে শুরু হয়ে বসন্ত পর্যন্ত মেলবোর্নে ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে রাশিয়ার এ্যারমিতাজ থেকে আনা অপূর্ব সব শিল্পকর্ম এবং রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের (ইয়েকাতেরিনার) কিছু ব্যক্তিগত মূল্যবান ধনদৌলতের প্রদর্শনী হয়েছিল। আগ্রহী দর্শকের অভাব হয়নি। ইংরেজিতে লেখা হয় ‘Hermitage’ তবে মূল ভাষা রুশে বলা হয় এ্যারমিতাজ।

ক্যাথরিন ছিলেন শিল্পপ্রেমী মানুষ। সম্রাজ্ঞীর সম্পদ তো ছিলই আর ছিল শিল্পের জন্য তাঁর আগ্রাসী ক্ষুধা। সম্রাজ্ঞীর এই শিল্পমগ্নতা ও বহুমূল্যে শিল্পকর্ম সংগ্রহের ব্যাকুলতাকে ক্যাথরিন নিজেই ‘রয়্যাল অ্যাফেয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন।

রাশিয়া থেকে আনা খ্যাতিমান শিল্পী দা ভিঞ্চি, রিউবেন, র‌্যামব্রান্ট ও আরও অনেকের শিল্পকর্ম মেলবোর্ন প্রদর্শনীতে রাখা হয়।

প্রথম চিত্রকর্মটি (তৃতীয় ছবি) ১৭৭৯ সালে বিলাত থেকে এ্যারমিতাজের জন্য সংগৃহীত অন্যতম উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম। এই চিত্রকর্মের পাশে লিখিত ছিল লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (স্কুল অব)। এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে এটি স্বয়ং দা ভিঞ্চির বা তাঁর কোনো সতীর্থ শিক্ষার্থীর অঙ্কিতও হতে পারে। চার শ বছর আগে শিল্পীর মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা মিশিয়ে ক্যানভাসে আঁকা তৈলচিত্র তার অপূর্ব সৌন্দর্যে দর্শকদের মুগ্ধ করে যাচ্ছে আজও।

চার চার শ বছর আগে শিল্পীর সৃষ্ট কাজ দেখতে দেখতে কেমন এক রোমাঞ্চ জাগে মনে। এই শিল্প সৃষ্টির জন্য অক্লান্ত শিল্পীর নিবেদিত দিনরাত্রির পরিশ্রমের ইতিহাস ও একই সঙ্গে সৃজনের ক্লান্তিবিহীন উচ্ছ্বাস ভেবে দর্শকেরাও আলোড়িত হন অবধারিতভাবে।

মূল্যবান চোখজুড়ানো এসব জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ। যা মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে ছিল। ছবি: লেখিকা
মূল্যবান চোখজুড়ানো এসব জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ। যা মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে ছিল। ছবি: লেখিকা

মেলবোর্ন আর্ট গ্যালারিতে আয়োজন বিরাট বিশাল। তবে এ্যারমিতাজের তুলনায় নিতান্ত ছোট্ট এই প্রদর্শনী। ছোট্ট বলার পেছনে কারণ আছে।

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গ (একসময়ের লেনিনগ্রাদ) শহরে জাদুঘর এ্যারমিতাজে পৃথিবীর সর্বাধিক সংগ্রহ রয়েছে। বলা হয় কেউ যদি এ্যারমিতাজ জাদুঘরের প্রতিটি শিল্পকর্ম বা দর্শনীয় বস্তু মাত্র এক মিনিট করেও দেখে তবু তার জন্য সময় লাগবে ১১ বছর।

একবার ছাত্রজীবনে এ্যারমিতাজে এক্সারসনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন দল বেঁধে একজন শিক্ষকের নেতৃত্বে এক দিনে যতটুকু দেখা সম্ভব, ততটুকু দেখতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা, দেখতে দেখতে চোখব্যথা এবং মাথা তুলে ক্ষণে ক্ষণে ছাদে অঙ্কিত শিল্পকর্ম ফ্রেসকো দেখতে গিয়ে হয়েছিল ঘাড়ে ব্যথা। ক্যামেরা ও সময়ের অভাবে ছবি তোলা ও লিখনগুলো পড়ার সুযোগ কোনোটাই হয়নি।

এ্যারমিতাজের জন্য বিলাত থেকে সংগৃহীত চিত্রকর্ম। ছবি: লেখিকা
এ্যারমিতাজের জন্য বিলাত থেকে সংগৃহীত চিত্রকর্ম। ছবি: লেখিকা

তবে রাজবাড়িতে সম্রাজ্ঞীর স্বর্ণনির্মিত ডিনার সেট দেখে রাজন্যদের রুচিহীন বৈভব উপভোগের ওপর বিতৃষ্ণা জেগেছিল। যখন মেলবোর্নে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের এ্যারমিতাজের প্রদর্শনীর খবর টিভি নিউজে পরিবেশিত হচ্ছিল, বলা হলো এই প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মের পাশাপাশি দর্শকদের জন্য রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট বা রুশ ভাষায় বলা যায় ভিলিকাইয়া ইয়েকাতেরিনার ব্যক্তিগত কিছু জিনিসও থাকবে। তখন টিভি পর্দায় ভেসে উঠল সম্রাজ্ঞীর সেই কনকনির্মিত ডিনার সেট।

মানুষের সৃষ্ট অথবা সংগৃহীত সব দর্শনীয় সুন্দর বস্তুর পেছনে কিছু না কিছু কাহিনি থাকে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দুবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সব দেখা হয়নি বা সবকিছুতে আগ্রহ ছিল না। আমি শিল্পরসিক বা শিল্প সমঝদার নই। তবে ওই সব বহু বহু মূল্যবান সংগ্রহের পেছনের তথ্য অর্থাৎ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত জানতে খুব আগ্রহী। মিউজিয়াম ঘুরে শুধু মনোলোভা অপূর্ব সব বস্তু দর্শন নয় আমার জানতে ইচ্ছে করে এর পেছনে জড়িয়ে থাকা মানুষের আগ্রাসনের ও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ অর্জনের বিচিত্র সব আখ্যান। ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে উজ্জ্বল করে রেখেছে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে লুটতরাজ করে আনা অসাধারণ সব বস্তু। মোগল দরবার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অনেক রত্নরাজি ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে আলোকিত করে আছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় ছবির মূল্যবান চোখজুড়ানো জিনিসগুলো ক্যাথরিনের নিজস্ব সম্পদ যা মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে ছিল। উল্লেখ্য, ১৮৮২ সাল থেকে রাশিয়ায় এ্যারমিতাজ মিউজিয়াম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এ্যারমিতাজ মিউজিয়ামে অনেক চিত্রকর্ম কবে, কোথা থেকে এবং কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে, তার তথ্য উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো প্রথম ও সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পৌত্র জর্জ ওয়ালপোলের (থার্ড আর্ল অব অক্সফোর্ড) কাছ থেকে ক্যাথরিনের সময়ে (শাসনকাল ১৭৬৩-১৭৯৬) ১৭৭৯ সালে ৪০ হাজার পাউন্ডেরও বেশি মূল্য দিয়ে ১৯৮টি শিল্পকর্ম কেনা হয়।

উল্লেখ করা দরকার, এই সব অসাধারণ চিত্রকর্ম বা পেইন্টিংগুলো বিলাতের বাইরে অন্য দেশে চলে যাক বা অন্য কারও কুক্ষিগত হোক ইংল্যান্ডবাসী অভিজাতরা চাননি। কিন্তু শিল্পবিপ্লব–উত্তরসমৃদ্ধ বিলাতের চেয়ে আধা সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়ার সম্রাজ্ঞীর অর্থনৈতিক পেশির শক্তি ছিল প্রচণ্ড বেশি। যখন রুশ রাজা–রানিরা জগৎ ঢুঁড়ে বহু ব্যয় করে শৌখিন শিল্প ও সম্পদ সংগ্রহে নিবেদিত তখন পলুফিউডাল বা আধা সামন্ততান্ত্রিক ওই দেশে সাধারণ রুশ জনগণের জীবন ছিল দাসানুদাসেরও অধম। রাজন্যরা প্রজাদের মঙ্গল বিধানে উৎসাহী ছিলেন না বরং ছিলেন প্রজা নির্যাতনে পারঙ্গম। ব্রিটিশরাও যখন কলোনি লুণ্ঠন করে দর্শনীয় মূল্যবান সব সম্পদ এনে মিউজিয়াম সাজাচ্ছে, তখন কলোনির আপামর মানুষেরা নির্যাতিত ও শোষিত হয়েছে ব্রিটিশেরই হাতে।

মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে একটি চিত্রকর্মের সামনে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
মেলবোর্নের প্রদর্শনীতে একটি চিত্রকর্মের সামনে লেখিকা। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

সবার কল্যাণ বা বিশেষ করে সাধারণ মানুষের উপকার হয় এমন অনেক কাজ জমিদার-রাজা-সম্রাটেরা করেছেন। পুকুর বা দিঘি খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, এ ধরনের কাজের ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের উপমহাদেশে আছে। ভারত সম্রাট শেরশাহ্ দিল্লি থেকে ঢাকার সোনারগাঁ পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নির্মাণ করেছিলেন সর্বসাধারণের জন্য। শুধু নিজের বাপ-ভাই ও বংশধরদের জন্য নয় নিশ্চয়ই।

মেলবোর্নের এক্সিবিশনে এ্যারমিতাজের সংগ্রহ থেকে পৃথিবীবিখ্যাত সব শিল্পীদের আঁকা চোখজুড়ানো ও মনভোলানো চিত্রকর্ম বা পেইন্টিংগুলো তো ছিলই, আর ছিল বুলেটপ্রুফ কাচের বেষ্টনীতে সম্রাজ্ঞীর নানা সম্পদ। কত বিচিত্র উপায়ে যে সেকালের ধনাঢ্যরা সম্পদ উপভোগ করতেন, তার উজ্জ্বল উদাহরণ রুশ রাজ্ঞীর সোনার তৈরি কারুকাজখচিত থালায় সোনার চামচে খাবার খাওয়া বা খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস।

নাহ, মনে হয় কথাটা সঠিক নয়। সুনিশ্চিত জানি যে ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমাদের মতো দর্শকেরা কোনো এক জাদুঘরে গিয়ে দেখতে পাবেন সৌদি বাদশাহের কোনো এক মেয়ের বিয়ের সময়ে উপহার হিসেবে পাওয়া সোনার কমোড। একশ্রেণির মানুষের সম্পদ আস্বাদনের পদ্ধতি বড়ই বিচিত্র। ১৮০০ সালে পাশ্চাত্যের রুশ মহারানি খাবার টেবিলে সোনার নকশাদার থালায় সোনার চামচ দিয়ে খাবার তুলে খেয়েছেন। ২০০০ সালে প্রাচ্যের সৌদি বাদশাজাদি টয়লেটে সোনার তৈরি কমোড ব্যবহার করছেন!