স্মৃতিতে অম্লান প্রিয় ধীরেশ স্যার

স্কটল্যান্ডে ছেলে ধীমান ও সহধর্মিণীর সঙ্গে ধীরেশ চন্দ্র সরকার। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত
স্কটল্যান্ডে ছেলে ধীমান ও সহধর্মিণীর সঙ্গে ধীরেশ চন্দ্র সরকার। ছবি: লেখিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত

স্যারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আর শুধু স্যারের ক্লাস করা দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছে।

সিলেটের ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্যারকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। স্যারকে সবাই একনামে চেনেন। আমাদের অতি প্রিয় ধীরেশ (ধীরেশ চন্দ্র সরকার) স্যার। যিনি সিলেট এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। আর সবার কাছে ছিলেন একাধারে শিক্ষক ও অভিভাবক।

অঙ্কের মতো একটি জটিল ও কঠিন বিষয়কে স্যার আমাদের এমন সহজভাবে পড়াতেন যে আমরা অঙ্কে মজা পেয়ে যাই। স্যারের পড়ানোতে কী যে এক জাদুকরী শক্তি ছিল, তা লেখার মতো ভাষা আমার জানা নেই। স্যারের পড়ানোর ধরনটা ছিল এককথায় অসাধারণ। অগণিত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কে কতটুকু পারবে, কে কোনটাতে ভালো, কার কোনটাতে দুর্বলতা—এই সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে।

আমরা আরও অবাক হতাম, যখন দেখতাম শত শত ছাত্রছাত্রীর (অতীতের ও বর্তমানের) নাম ও যাবতীয় তথ্য (কে কার বোন, ভাই, কাজিন, মামা, খালা), কে বর্তমানে কোথায় আছে—সব স্যার সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতেন! তখন মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়া কিছুই ছিল না।

সবাইকে আপন করে নেওয়ার এই দুর্লভ গুণ সবার থাকে না। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে এই বিশেষ গুণটা স্যারকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। কলেজের অন্য শিক্ষকেরা যেখানে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একধরনের দূরত্ব রেখে চলতেন, স্যার ছিলেন একেবারে ঘরের গুরুজনের মতো।

মনে পড়ে, আমাদের ক্লাস চলার সময় মাঝেমধ্যে স্যারের অনেক পুরোনো ছাত্রছাত্রী স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন আর স্যার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নাম, কোন ব্যাচের—সব বলে দিতেন। আমরা খুব বিস্মিত হতাম! আমাদের আরও বেশি অবাক করে দিয়ে স্যার তাঁদের কাছ থেকে তাদের ভাইবোন বা কাজিন, যারা কিনা স্যারের কাছে পড়ত, তাদের নাম জিজ্ঞেস করে তাদের খবর নিতেন।

আমি আজও এই অঙ্ক মেলাতে পারিনি, কীভাবে পারতেন তিনি এত ছাত্রছাত্রীর সব কথা মনে রাখতে।

এসএসসির পর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের করিডরে পা রেখে নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন বিষয় আর বিশাল সিলেবাসে আমাদের যখন দিশেহারা অবস্থা, তখন ওই কঠিন সময়ে আমাদের কাছে গণিতের মতো বিষয়কে সহজ করে আমাদের শিক্ষাজীবনে স্বস্তি প্রদানে স্যারের ভূমিকা ভোলার নয়।

আমরা সব বন্ধু লীনা, দিবা, মাহফি, ঊর্মি, লিমি, পপি, মমপি, আইরিন, তামান্না, আলো, হ্যাপি, সেজি, মুন্নীসহ অনেকে (দুঃখিত কারও নাম ভুলে গেলে) একসঙ্গে একটি ব্যাচে স্যারের কাছে পড়া শুরু করি। আমরা আনন্দের সঙ্গে গণিত শিখতাম। কত যে দুষ্টুমি করতাম আমরা। বকাও খেতাম অনেক। ক্লাস চলার মাঝখানে কথা বলার জন্য আমি আর লীনা কত যে মার খেয়েছি। কিন্তু আমরা ঠিকই বুঝতাম, এসব বকাঝকা, শাসন যতই করুন, স্যার আমাদের অত্যধিক স্নেহ করতেন। আমাদের এই শিক্ষা, স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই আপনি বড় অকালে চলে গেলেন স্যার। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটা অপূরণীয় শূন্যতা।

স্যার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সময় পেলেই স্যার তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনের কথা বলতেন। কার্জন হলের গল্প শোনাতেন। সিলেট থেকে ইন্টার শেষ করে আমরা খুব কমই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতাম। স্যার সব সময় এসব গল্প শুনিয়ে আমাদের মোটিভেট করতেন ভালো জায়গায় পড়ার জন্য। সব সময় বলতেন, জীবনে কিছু করতে হলে সুরমা নদী পার হতে হবে। স্যার চাইতেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সারা বিশ্বে আলো ছড়াবে।

আমি আর আমার বর দুজনই স্যারের ছাত্র ছিলাম দুই বছর আগে পরে। সবার মতো দুজনই স্যারের স্নেহ–আশীর্বাদ পেতাম সব সময়। এমনকি আমাদের বিয়ের আগে আমার বরের বাসা থেকে স্যারকে জিজ্ঞেস করলে স্যার নাকি আমার খুবই প্রশংসা করেন। যার যোগ্য আমি কি না, তা জানি না।

২০১৫ সালে স্যারের ছেলে ধীমান স্কটল্যান্ডে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। ধীমান গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে স্যার বৌদিকে নিয়ে এসেছিলেন। প্রবাসী সব ছাত্রছাত্রী মিলে স্যারকে নিয়ে লন্ডনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। আমরা তখন লিডসে থাকতাম। ফোনে কথা বলেছিলাম স্যারের সঙ্গে। কিন্তু আমি প্রেগন্যান্ট থাকায় যেতে পারিনি। স্যারকে বলতেই স্যারই বারণ করেন, এ অবস্থায় ২০০ মাইল জার্নি না করতে। এখন খুবই খারাপ লাগছে। গেলে স্যারের সঙ্গে অন্তত একটি সন্ধ্যা কাটানো যেত।

স্যার হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে, তাদের সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ হয়ে তাদের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। আপনার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আপনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। ওপারে ভালো থাকুন, স্যার।
---
খালেদা সুলতানা: চিকিৎসক।