ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি: কমলা রোদের মাল্টা-৩

ব্লু লেগুন। ছবি: আহমেদ রুমি
ব্লু লেগুন। ছবি: আহমেদ রুমি

আদিবা আর আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ছড়িয়ে পড়া মার্বেলের মতো বাচ্চা দুটো খেলার ছলে ছুটে পালিয়ে গেছে। করিডর পেরোলেই লবি। সামনেই হুঁশহাশ গাড়ি আসে-যায়।

রিসোর্টের স্যুভেনির শপের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা দুজন আমাদের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় দেখে হতভম্ব-‘গুডনেস গ্রেশাস! হোয়াই দ্য লেডিজ রানিং লাইক ক্রেজি?’

ওসব গ্রেশাস-ফেশাসের ধার না ধারা রানিং লেডিরা ঠিক শেষ মুহূর্তে তাদের ছানাদের বজ্রআঁটুনিতে আটকে ফেলে হাঁপাতে লাগল। ডারউইন সাহেবের বাঁদরতত্ত্ব প্রমাণের জন্য এ দুটো বাচ্চাই এক শ।

খানিক বাদে ফেরিতে বসে আছি। হঠাৎ দৌড়ের কবলে পড়ে শরীরের মরচে ধরা কলকবজা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে বিচিত্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

ভেবেছিলাম, ফেরি বোটে উঠে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাবে। উল্টো পোড়া তেলের ভক ভকে গন্ধে জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়।

জায়গা বদলে নেব, তার উপায় নেই। লোকে একেবারে টইটুম্বুর। নিরুপায় হয়ে ফুসফুসে যথেচ্ছ কালো ধোঁয়া ঢুকতে দিয়ে চারপাশটা দেখছি। ব্লু লেগুন নাম শুনে আগ্রহ জাগছে। জনমানবহীন কোমিনো দ্বীপের বালি সৈকতটা নিশ্চয় অদ্ভুত সুন্দর হবে।

ব্লু লেগুনে নোঙর করা ফেরি। ছবি: আহমেদ রুমি
ব্লু লেগুনে নোঙর করা ফেরি। ছবি: আহমেদ রুমি

কিন্তু না। যাত্রা আনন্দ মাটি করা কালো ধোঁয়ার সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে কথার তুবড়ি। পাশের আসনে তিন বিশাল বপু ভদ্রমহিলা টেবিল চাপড়ে তুফান মেল ছুটিয়ে দিয়েছেন। প্রায় একই রকম চেহারা আর গলা চড়ানো বাতচিত বলে দেয়, তারা খুব সম্ভবত সম্পর্কে মেয়ে, মা আর নানি। তাদের সঙ্গে যথাক্রমে কোমর, হাঁটু আর গোড়ালিসম বয়সের এক বেচারা ছোকরা। খানিক পরপরই যে কিনা বগল বদল হয়ে তিনজনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

কান তো বাঁচাতে পারছি না। কিন্তু চোখের ওপর এই মর্মান্তিক দৃশ্য এড়াতে আবার সাগরে দৃষ্টি ছুড়লাম।

আর তখনই দুর্দান্ত ঘটনাটা চোখে পড়ল। নৌকার গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কণায় ক্ষণিকের রংধনু উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যত বড় ঢেউ, তত বড় রঙের ধনুক। ঠিক যেন মরীচিকা দেখছি।

এদিকে পানির রঙেও আরেক খেলা চলছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তার রং পাল্টে যাচ্ছে। গাড় নীল ফিকে হয়ে আকাশ নীল। সেখান থেকে মত বদলে আচমকাই শেওলা সবুজ। সব শেষে আশ্চর্য শীতল ফিরোজা নীলে এসে ঠেকেছে।

চেনা জগৎ পেছনে ফেলে আমরা হুট করে স্বপ্নিল রূপকথার পাতায় ঢুকে গেছি। এই বুঝি জল থেকে রুপালি ঝিলিক তুলে হ্যান্স অ্যান্ডারসনের মৎস্যকন্যা উঠে আসবে সেই রাজকুমারের খোঁজে। তারপর রাজপুত্রের বদলে ট্যুরিস্ট নামের কতগুলো চক্করবক্কর হাওয়াই শার্ট চাপানো কিম্ভূত প্রাণী দেখে ভয় পেয়ে আবার টুপ করে ডুবে অতলে হারিয়ে যাবে।

কল্পনার মৎস্যকুমারীর দুঃখে বড় বড় হাই তুলছি। সংবিৎ ফিরে পেলাম ফেরির অল্পবয়সী নাবিকদের তোড়জোড়ে। কচি মুখগুলো ইন্দোনেশীয়দের সঙ্গে খুব মেলে। শিশুশ্রম আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের বয়স পনেরো-ষোলো। তবে চোখেমুখে শিশুতোষ ভাব নেই এক্কেবারেই। বরং জল ঘেঁটে ঘেঁটে পোড় খাওয়া নাবিকের মতো চৌকস তামাটে চেহারা। এরা নোঙর না ফেলেই অভিজ্ঞ হাতে অবলীলায় একেকজনকে প্রায় শূন্যে তুলে পাড়ে নামিয়ে দিচ্ছে।

সাগরের গায়ে পাথুরে গুহা। ছবি: আদিবা আমাত
সাগরের গায়ে পাথুরে গুহা। ছবি: আদিবা আমাত

সেদিকটা নিরিবিলি। পানি গভীর। স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য লা জবাব জায়গাটা। কিন্তু স্বভাবে কাছিম ভাব প্রবল থাকায় আমরা এমন রোমাঞ্চের পরোয়া না করে সৈকতে নামার অপেক্ষায় ফেরিতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলাম।

ফেরি ভিড়লে আমরা হেলেদুলে গড়িয়ে নেমে ঠিক দুই মিনিটের মাথায় একটা ছাতা লাগানো রোদ চেয়ার ভাড়া করে সেখানে কাঁধের বোঁচকা ফেলে ফেলে টিলা বানিয়ে ফেললাম।

এই ফাঁকে ছেলেপুলের বাবা দুজন ইয়া লম্বা এক তোয়ালে পেঁচিয়ে ঝটকা মেরে চোখের নিমেষে সাঁতারের শর্টস পরে নিল। তাদের ঝটকা বিদ্যার কাছে পিসি সিংয়ের ম্যাজিকও ফেল। আদিবাও গোড়ালি মুড়ে নিয়ে পা ভেজাতে তৈরি। ব্যস, একজনকে পাহারায় বসিয়ে দিয়ে বাকিরা পানির দিকে রওনা দিল।

সেই একজনটা আমি। চুপচাপ কোমিনো দ্বীপটা দেখছি। কোমিনো নামটা শুনতে জাপানি পোশাক কিমোনোর মতো শোনায়। আসলে নামটা এসেছে Cumin থেকে। বাংলায় যার মানে জিরা। এককালে মাল্টায় প্রচুর জিরা ফলতো দেখে এই কোমিনো নাম।

গল্পে-উপন্যাসে দারুচিনি দ্বীপ থাকে। বাস্তবে থাকে জিরা দ্বীপ। ভাগ্যিস ছাতা ভাড়া করা হয়েছিল। নইলে মাঝদুপুরের কড়া রোদে জিরা টালা হয়ে যেতাম।

হাঁটুপানিতে দাপাদাপি করে বাকিরা ফিরে এলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমারও দৌড় ওই হাঁটু পানিই। জগিং ট্রাউজারটা সামান্য গুটিয়ে নেমে পড়লাম। ঝুঁকে পড়ে কতগুলো রঙিন পাথর কুড়াতে চাইলাম। অবাক করে দিয়ে যা উঠে এল তার তালিকায় আছে হ্যানিকেন ব্যান্ডের বিয়ারের ছিপি, চশমার ডাঁট, আর কারও হাফ প্যান্টের অংশবিশেষ। মনের দুঃখে মাতাল হয়ে কেউ বোধ হয় চশমা ভেঙে বস্ত্র বিসর্জন দিয়ে গেছে।

আসলে গ্রেটা থুনবার্গ মেয়েটা এমনি খঁচে থাকে না। আবর্জনা দিয়ে সাগর ভরাট করা কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকের সংখ্যা বিচ্ছিরিভাবে বাড়ছে। কী বঙ্গোপসাগর, কী ভূমধ্যসাগরের মাল্টা। দূষণে পরিবেশ সবখানেই উল্টাপাল্টা।

ছবি: লেখিকা
ছবি: লেখিকা

দ্বীপটা সবাই মিলে এক পাক ঘুরে কতগুলো ডোরাকাটা টিকটিকি আর একটা ভিতু চেহারা আণুবীক্ষণিক বৃশ্চিক আর কোনো প্রাণীর দেখা পেলাম না। পাবই বা কী করে। ছোট্ট দ্বীপের একপাশে স্যান্ডউইচ-বার্গারের দোকান দিয়ে সয়লাব। আরেক পাশে মালা-পুতি-পোস্টকার্ডের দোকান। তার মাঝে এক লোক রোদচশমা বেচতে বসেছে। একটার দামে দুইটা দেবে। এসব হট্টগোলের ভেতরে টিকটিকিগুলো যে কানে তুলা গুঁজে পড়ে আছে, এই তো বিরাট আশ্চর্য।

ফেরিতে চড়ে বসলাম একটু বাদেই। আবার সেই ফিরোজা নীল সাগর। আবার শান্তি। গতকাল গুহায় যেতে না পারার আফসোস ঘুচল আজকে। গোটা তিনেক গুহার খুব কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনা হলো আমাদের। তারপর মাঝদরিয়ায় জাহাজ বন্ধ করে দেওয়া হলো। এখন যত খুশি সাগরে দাপাও।

জনা কয়েক তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় এদিক–সেদিক ফেলে সাঁতারের পোশাকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এদের কাউকে আবার কিলার শার্ক এসে টেনে নিয়ে না গেলে হয়। সে রকম কিছু ঘটল না। বরং তাদের এক আধজন আবার সাঁতরে পাশের ভীষণ উঁচু খাড়ি বেয়ে উঠে টপাৎ টপাৎ ক্লিফ ডাইভিংয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কাছেই একটা ছোট জাহাজ ভাসছে। তাতে একদল তরুণ-তরুণী বেজায় হুল্লোড় জুড়েছে। হাতে হাতে কাচের গ্লাসে লাল শরাব। প্রচুর পাগলা পানি পেটে পড়ায় তারা বেশ তরল মেজাজে আছে। গলা ছেড়ে গান গাওয়া থেকে শুরু করে অতি আবেগে আমাদের দিকে হাত নাড়ানো, কী এক পাক নেচে দেখানো-সবই চলছে। তাদের দ্রবীভূত অবস্থায় রেখে আমরা বোট ঘুরিয়ে ফিরে চললাম।

শেষের দিনটায় আজকে আকাশ কালো। ঝড়ের পূর্বাভাস আছে। বেড়ানোর সুযোগ নেই। কী আর করা, ঘাপটি মেরে অলস কাটিয়ে দেব। ঘড়ি ধরে ঠিক বেলা একটায় সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল। শহুরে দালানের আড়ালে লুকিয়ে ঝড় দেখা এক জিনিস। আর সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে তাণ্ডব দেখা আরেক বস্তু।

ছাই কালো মেঘ চিরে চিলিক দিয়ে শাঁই করে নেমে আসা বাজ পড়া দেখে পিলে চমকে গিয়ে চরম একটা বাংলা গালি বেখাপ্পা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই জিব কাটলাম। পাশে দাঁড়ানো হতভম্ব ছেলের বাবার কাছে ভদ্র-শান্ত ঘরের বউ ইমেজটা আজকে কেঁচে গেল বোধ হয়।

আমাদের নিয়ে গাড়িটা রাত ফুঁড়ে চলছে। ভোরের আলো ফোটেনি এখনো। একটা-দুটি অফিস-আদালত আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। ঠান্ডা আলোর হলদে সোডিয়ামে পথঘাট অনেক দূরের আরেক চেনা শহর বলে ভ্রম হয়। ভিনদেশটার জন্য সোডিয়াম বাতির মতোই কোমল উষ্ণতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আপন ডেরায়। কমলা রোদের দেশ মাল্টার মিষ্টি স্বাদটা মনে থেকে যাবে বহু দিন। (সমাপ্ত)
---
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন