সিঙ্গাপুরের দিনরাত্রি

সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে। ছবি: লেখিকা
সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে। ছবি: লেখিকা

সিঙ্গাপুরে আসার পর স্থানীয় লোকজনকে যত দেখছি, ততই মনে হচ্ছে এরা একদল সংঘবদ্ধ মৌমাছি। দলের রানি (এ ক্ষেত্রে রাজা) কাজের নকশা ঠিক করে দিয়েছেন। আর সবাই মিলে দিনরাত তা পালন করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরা এত বেশি এগিয়ে গেছে যে আমার কাছে এদের জীবনযাত্রা মাঝেমধ্যে বিচিত্র, আবার মাঝেমধ্যে বিস্ময়কর মনে হয়।

মৌমাছির মতো বাসা
এরা থাকেও মৌমাছির মতো করে। এদের ঘরবাড়িকে কেবল চাক না বলে এরা এইচডিবি অথবা কন্ডোমিনিয়াম বলে। প্রতিটি এইচডিবিতে হাজার হাজার ফ্ল্যাট। আর এ রকম অসংখ্য এইচডিবি একসঙ্গে দূর থেকে দেখলে মৌমাছির চাকের কথা মনে পড়ে। এ রকম ১০-২০টি এইচডিবি মিলে একটা এলাকার মাঝে খেলার মাঠ, শুধু শিশুদের খেলার মাঠ, ফিটনেস কর্নার, বিউটি পারলার, ক্লিনিক, স্কুল, লাইব্রেরি, বাজার ইত্যাদি হাজারটা প্রয়োজনের সবকিছুই থাকে। আর থাকে খাবারদাবারের জন্য বিশাল ক্যানটিন। কেউ যদি জীবনে নিজের বাড়ির দশ কদম ছাড়া আর কোথাও যাবে না বলে ঠিক করে, তার নিশ্চয়তা গ্যারান্টিসহ দেওয়া সম্ভব।

সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে। ছবি: লেখিকা
সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে। ছবি: লেখিকা

স্মার্ট ডাইনিং
এটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং অংশ মৌচাকের। মালয়, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও অল্প কিছু ওয়েস্টার্ন খাবারও নির্দ্বিধায় পাওয়া যাবে এসব ডাইনিংয়ে। ঘিবলি স্টুডিওর ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ মুভিতে দেখা হাটের মতো সারি সারি দোকানভর্তি শুধু রংবেরঙের খাবার রান্না করা হচ্ছে। ট্রেতে প্রিয় খাবার নিয়ে নিজেদের এইচডিবির বাগানের পাশে গড়ে ওঠা বিশাল ক্যানটিনে বসে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে তিনবেলার খাবারটা সেরে নিচ্ছে।

এদের ডাইনিংগুলো দেখি আর ভাবি, দৈনন্দিন জীবন কি সুপরিকল্পিতভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং করা! নারী-পুরুষ সবার কর্মব্যস্ততার কথা মাথায় রেখে, বয়স্কদের কথা বিবেচনা করে কী স্মার্ট একটা সিস্টেম তারা তৈরি করেছে। খাবারের গুণাগুণ নিয়ে কিছু বলাটা অপ্রয়োজনীয়। কারণ, এ দেশের কালচারের মূলভিত্তি হলো সবচেয়ে আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

মৌমাছির মতো বাসা। ছবি: লেখিকা
মৌমাছির মতো বাসা। ছবি: লেখিকা

স্মার্টবাইক: পিএমডি (পার্সোনাল মোবিলিটি ডিভাইস)

হলিউডের ‘ওয়ালি’ মুভির কথা মনে আছে? যারা হাঁটাচলা করত না এবং না হেঁটে বরং একধরনের স্মার্ট ভেহিকল ব্যবহার করত চলাচলের জন্য? সিঙ্গাপুরিরা এই মুভি দেখে অনুপ্রাণিত কি না, জানি না। তবে যখনই দেখি লিফটের মধ্যে থেকে স্মার্টবাইক থেকে না নেমে বরং ওটা চালিয়েই বাসায় ঢুকে গেল, তখন আমি ভাবি, এরা এই ভেহিকলের সঙ্গে কোনোভাবে আটকানো কিনা!

স্মার্ট বাজার–সদাই আর আই-জুস
এখানে ব্র্যান্ডের হীরা-মানিক বা সোনা–রুপা–প্লাটিনাম—সবই ভেন্ডিং মেশিন থেকেই কেনা যাচ্ছে। দামাদামির বালাই নেই। সেলসম্যানের গালভরা কথা নেই। মনিটরে যাবতীয় ইনফো ছবিসমেত দেওয়া নামীদামি সব ডিজাইনার হাউসের জুয়েলারি। বলা বাহুল্য, শোরুমগুলো থেকে হাজার গুণ কম মূল্যে। কার্ড পাঞ্চ করে পছন্দসই গয়নার আইকন ক্লিক করলেই প্যাকেটে মোড়ানো ঝকঝকে বক্স হাজির।

স্মার্ট ডাইনিং। ছবি: লেখিকা
স্মার্ট ডাইনিং। ছবি: লেখিকা

মাছ
আবার সেই ভেন্ডিং মেশিন। কার্ড পাঞ্চ করে কয় টুকরো মাছ চাই তা সিলেক্ট করা। প্যাকেট করা নরওয়ের তাজা স্যালমন মাছ হাজির। এদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বিক্রেতা বলে কিছু আর থাকবে না।

আই–জুস
এটা অ্যাপল বা গ্রামীণফোনের নতুন প্রোডাক্ট না। এটা একটা রোবট, যার পেটের ভেতর তরতাজা কমলা থাকে। আপনি কয়েন ঢুকিয়ে কতখানি চিনি বা জুস পরিমাণে কতটুকু নেবেন, তা মনিটরে টাচ করে জানিয়ে দিন। এরপর ভেন্ডিং মেশিনরূপের এই রোবট কমলা ছুলে জুস করে প্লাস্টিক গ্লাস কভার দিয়ে ঢেকে পাইপসমেত আপনাকে সার্ভ করবে।

ভেন্ডিং মেশিনের কফি কোনো দেশেই খেয়ে জীবনেও তৃপ্তি পাইনি। কিন্তু আই–জুস শুধু খেতেই অসাধারণ না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোবোটিক রান্নাবান্না দেখাটাও আনন্দদায়ক।

আইজুস ভেন্ডিং মেশিন। ছবি: লেখিকা
আইজুস ভেন্ডিং মেশিন। ছবি: লেখিকা